দোঁহা

গল্প-দাদু


 অভিষেক ঘোষ
১.
তোমরা কেউ গল্প-দাদুকে চেনো ? কী বললে ! চেনো না ? তোমাদের কথা ভেবে দুঃখ হয় !

আমি কিন্তু ছেলেবেলায় একজন গল্পদাদুকে চিনতাম । তিনি আসতেন দুর্গা পুজোর বোধনের ঠিক পরপর বা মহালয়ার পর, প্রতিপদে । তখন আমরা ছোটো, পাঁঠাবলি তখনও দু-চোখে হাত চেপে রেখে, আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখতাম । চকোলেট বোম ফাটলে আঁতকে উঠে দু'হাতে কান ঢাকতাম । সেই বয়সে অচেনা মেয়েরা কথা বলতে এলে, লজ্জায় গালদুটো ভারী লাল হয়ে যেত । আমরা জানতুম, আমাদের স্কুলে পুজোর ছুটি পড়ে গেলে, মা দুর্গা অসুর বধ করতে আসেন । আর আসেন গল্পদাদু । আকাশে তখন দিব্যি মেঘের ভেলা ভাসে । আর গল্পদাদু-র ময়লা পাজামা আর কোঁচকানো মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবী থেকে ভেসে আসে অদ্ভুত একটা খুসবু ! আমরা জানতুম, ওটাই গল্পের গন্ধ !

গল্পদাদু আমাদের বাড়িতে থাকতেন, দু-চারদিন বড়োজোর । হাতে করে আনতেন সিঙ্গারা আর জিলিপি । কিন্তু সব কিছুই গুনে গুনে — মাথাপিছু একটা সিঙ্গারা আর দুটো জিলিপি । বারান্দার জীর্ণ সোফাটায় বসে হাঁক দিতেন, “বউমা গেলে কোথায় ?”

মা এককাপ চা হাতে নিয়ে এসে বলতেন, “এতদিনে বুঝি আমাদের মনে পড়ল ?”

“বউমা, দেশের গরিব মানুষেরও শত্রুর অভাব নেই — একগাদা মরলে আরেক গাদা জন্মায় । মা দুর্গা একা কতদিক সামলাবেন বলো ? তাই আমরা ! যতটুকু পারি পরার্থে কাজ করি । কিন্তু কিছুতেই তোমাদের এই চেনা মুখগুলো ভুলতে পারি না — তাই ফিরতে হয় ।”

“আপনার সাথে কথায় কে পারবে !”

“বউমা, দাদুভাই-কে আবার কিছু কথা দিয়ে যেতে এলাম । সভ্যতা এগোচ্ছে, আর কথার জঞ্জালও বাড়ছে । তাই কথাগুলো দিয়ে যেতে হবে — বিশুদ্ধ কথা । কাজের কথা নয়, কিন্তু খাঁটি কথা ।”

“বেশ কথা, আমরা তো কেউ নই ! আপনি আপনার দাদুভাইয়ের সঙ্গেই তাহলে গল্প করুন” — এইটুকু বলে ছদ্ম-অভিমান দেখিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গিয়েই পিছন ফিরে হাসিমুখে মা বলতেন, “পারশে মাছ খাবেন তো ? ওকে আনতে বলি ?”

একগাল হেসে বুড়ো বলতো, “তোফা !”

২.
তোমরা হয়তো ভাবছো, গল্পটা আদেও বলবো নাকি কেবল ভূমিকাই করে যাবো !

তাহলে বলি শোনো, তখন আমি মোটে ক্লাস টু-তে উঠেছি । তখনো মাঝে মাঝে বিছানায়… ওই ইয়ে.. হিসি — যাহ্ বলে ফেললাম !

যাক গে — ঐ বয়সে অনেকেরই হয় । তারপর অনেক হ্যাপা — বিছানা-বালিশের চাদর কাচাকাচি — তোষক রোদে দেওয়া ।

তা সেবারও গল্পদাদু এসেছিলেন…. । গল্পও এনেছিলেন প্রচুর । কিন্তু মা সেই গোপন কথা-টা ঠিক তাঁর কাছে বলে দিলেন । বুঝতেই পার'ছ, কেমন রাগ হয়েছিল ! ছোটো বলে কি আমরা মানুষ নই ? ঐ সব কথা কাউকে বলে দিলে সম্মান নিয়ে কেমন টানাটানি পড়ে বলো দেখি ! মায়ের উপর খুব রাগ হয় আর মনে মনে শপথ করতেই হয়, আজ থেকে খাবোই না । কিন্তু বুঝতেই পারছো — রোববারের সকালের জলখাবারে লুচি আর ছোলার ডাল গরম গরম এলে ওসব রাগ-ফাগ কোথায় উবে যায় !

যাইহোক, মা চেয়েছিলেন গল্পদাদু আমার এই ঘুমের ঘোরে হিসি হয়ে যাওয়ার সমস্যাটার উপশম ঠিক করবেন । গল্পদাদু কিন্তু মোটেও আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করলেন না । বরং গম্ভীর হয়ে বললেন, “দাদুভাই ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়েছিলে নাকি ?”

আমিও ভরসা পেয়ে বললাম, “জানো তো রোজ রাতে ঘুমের মধ্যে একটা লোককে দেখি ।”

গল্পদাদু বলেন, “কেমন দেখতে সে ?”

“খুউব লম্বা, মাথায় হ্যাট, পায়ে বুট আর হাতে একটা কালো বল নিয়ে নাচায় ।”

“খুব বিপদের কথা দাদুভাই । মুশকিল হলো !”

“কেউ মানতেই চায় না !”

“আচ্ছা তুমি কোনো শব্দ শুনতে পাও ?”

“হ্যাঁ । ঐ বলটা খালি ড্রপ খায় — ওঠে নামে, ওঠে নামে আর থপ থপ করে শব্দ হয় । জানো ঐ শব্দটা আমার দিকে এগিয়ে এলেই — ”

“বুঝেছি, হিসি হয়ে যায়, তাই তো !”

ম্লান মুখে সম্মতি জানাতেই হয় ।

গল্পদাদু বলেন, “ভয় পেলে চলবে না । ঐ সাহেবটা কী চায় জানতে হবে ।”

“কী করে জানবো ?”

জিজ্ঞেস্ করতে হবে — ”

“ওরে বাবা !”

“ভয় কী ! সাহেবকে বলবে, তোমার ঐ বলটা আমায় দাও দেখি, খেলবো !”

আমি আঁতকে উঠে বলি, “ওরে বাবা ! ও আমি পারবো না ।”

“ধুর্ এতো ভয় পেলে চলে ! আমি তো আছি, সাহেব তোমায় কিছু বলতে গেলেই, আমি তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দেবো, ঠ্যালা মেরে মেরে । ”

“কিন্তু — ”

“চেষ্টা করেই দেখো না — ”

 ৩.
এরপর যা হয়েছিল, সংক্ষেপে বলি শোনো । সেই রাতে ঘুমের মধ্যে সাহেব তো এল । কালো বলটাও ফের সাহেবের হাতের আলগা ইশারায় মাটিতে ড্রপ খেতে খেতে, আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল — সঙ্গে সাহেবও । আতঙ্কের চোরা স্রোতে ডুবতে ডুবতেও বলেই ফেলি, “বলটা দাও না ! খেলব !”

তখনি সাহেব মাথা তুলে তাকালো ! কিন্তু একি ! এ যে গল্পদাদু ! সাহেবের কোট-প্যান্ট-হ্যাট-বুট বদলে গিয়ে কখন যেন খদ্দরের পাঞ্জাবী আর পাজামা হয়ে গেছে । রাগী রাগী সাহেবের কালচে কালচে ছোপ ছোপ টুপির অন্ধকারের নীচে জ্বলজ্বলে চোখ দুটোর বদলে দেখা দিয়েছে শরতের নীলাভ আলো আর মায়াময় দুটো হাসিমাখা চোখ — গল্পদাদু !

বলো দেখি, এরপরও কি চুপ করে থাকা যায় ! আমিও পারলাম না — চেঁচিয়ে উঠলাম, “গল্পদাদু !”

ওমা ! যেই না ডেকে উঠেছি, গল্প দাদুও অমনি বলে উঠলেন, “এই নাও দাদুভাই — বলখানা ধরো !”

শরীর ছুঁড়ে বলটা ধরতে যেতেই বিছানা থেকে গড়িয়ে গেলাম ! ভাগ্যিস্ বিছানাটা নীচু ছিলো !

তোমরা বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, কিন্তু মাটিতে পড়ে গিয়ে সেদিন মুঠো করা হাতে সত্যি একটা ক্যাম্বিসের বল পেয়েছিলাম । আজ মনে হয়, ইংরেজি নয়, শব্দটা বাংলায় হবে, শক্তির প্রতিশব্দ — ‘বল’ ।





 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন