দোঁহা

রশীদ হারুণের কবিতা


অবসন্ন সম্প্রদায়

সূত্রলেখ :

তোমাতে উর্বর ব্যথা— ভাবো,
লতিয়ে উঠছে
একগুচ্ছ আত্মোপলব্ধির সৌরলতা।

১.
গাঢ় ও নীলের আভা ছড়ানো আকাশ-চোখ
দেখে যাচ্ছে আয়ু বাগানের গহীনতা :
একটি সবুজ ছাতা, মনের কোথাও—
রেশম বিকেলে বসে আছো
মেঘের কাঁধের নিচে, পদ্মাচরে।
কাশফুলেরা বার্নিশ করছে হাওয়ার ফার্নিচার!
ঘাসেদের কুরচি আর হাওয়াদের গুঞ্জরণ,
তোমাতে রচনা করছে গানের তাঁত।
অনেক জানালা খোলা—
বিধৌত একটি লেবুগাছ হয়ে ওঠো।
অবসন্ন সম্প্রদায়, শোনো—
কবিতা পড়ছে হলুদ তাবুর তলে...

২.
দ্যাখো, বুনো মাশরুম গলে যাচ্ছে ছায়ার চলকে
বৃষ্টি, শেষ ধুয়ে যাওয়া মরসুম—
তীক্ষ্ণ গুল্মলতা ঘিরে বায়ু বয় :
নারকেলফুলে ভরে আছে সমস্ত উঠোন
নিমডাল নুয়ে এসে বারান্দা ছুঁয়েছে
বৃষ্টি শেষে আয়াতে উড়ছে মাওলানা-মেঘ
এবং আমরা হাঁটি পেয়ারা ফুলের নয়নের নিচ দিয়ে
আর এইসব শোনে কানখাড়া চালতার পাতা!

সবকিছু সুশ্রী, তবু, কোথাও বেদনা লেগে আছে।

৩.
এখন, আর্শির মধ্যে আরেকটি আর্শি ঢুকিয়ে দিয়েছি—
কাঠবিড়ালির লেজ আলজিভের ডগায়—
একস্থানে বসে, যে পৌঁছান যায় আমি জানি!
চিন্তার মৌনতা ঝরে টুপটাপ টুপটাপ... এবং আমার,
দীর্ঘশ্বাস, মেঘের উড়ন্ত ঘরে, তোমাকে দেখছে—

দেহশূন্যতার টেলিপ্যাথি দেহ নিয়ে আসে, তুমি জানো!

৪.
একটা মেহগনির চূড়ার চেয়েও কানিবক বড়!
আমার কি সাধ্যি আছে কারও দেহডালে ঝুপ করে বসা!
তবু যাই, কোথাও আর্শির বিন্দুর ভেতর থাকি!
আমার পর্ণকূটিরে ব্রাশ করছে শরৎ আলো।
জল নেমে গেলো আরও নিচে—
এবং তোমার চোখ নড়ছে আমলকির ডালে—
যেন, ঝুলে আছে একগুচ্ছ কাঁচফল।

বৃষ্টি ছিল— অনেক ভিজেছে মসজিদ ও মন্দির।
পবিত্র সন্ধ্যার কাছে গোলচাঁদ উঠেছে অনেকবার,
তবু, শ্যাওলার ফাঁক গলে অসহন পিচ্ছিলতা!

৫.
এখন, উজ্জ্বল স্নান শেষে আশ্চর্য ঔষধ পান করো—
ভেতরের জল ফুঁড়ে হাসে শিউলির মেধা।
বর্ষায়, তোমার নার্সারিতে একটু বেড়েছে গানগাছ—
বেশি যত্নশীল হও, আর, প্রতিটি ডিমের হলুদ কুসুম
এবং জীবন এক শৈলীর সৌরজগত!

ক্রোধহীন, নরম বেদনা নিয়ে বসে থাকো, ভাবো—

৬.
ঋতুগুলিকে প্রকৃত করো— চাহিদা-বাহিত তোমার পল্লব
অর্থময়তার কুশলতা ছেড়ে বেরিয়ে আসুক।
শাদা ও সবুজ, হলুদ ও রঙলেখা, পবিত্র ফুল ও ফলে,
দিনের আলোর মধ্যে, নীল ও রাত্রিলিখিত আকাশগঙ্গায়,
তোমার নয়ন মুর্ছা করো, আর দ্যাখো—
একঝাঁক মেঘ-অশ্ব তোমার উপলব্ধির প্রান্তরে চরে।

চোখের কার্নিশে কিছুটা বেদনা থাকা ভালো!

৭.
জলের নিয়ম ঘিরে ব্যথাতম আবর্তন তোমাতে বাহিত;
জল চলে গেছে, তবু কেন রয়ে যায় জলদেহ!
শোধন হয়েছে বলে বিস্ময় ও আবেগের জল—
একদিন, আজ, পদ্মাপাড়ে, তোমার কাঁধের
কাশফুল ছুঁয়ে আছে আমার চোখের আলো!

শাদা শাদা মেঘ ওড়ে...

৮.
চোখঘোড়া চেপে চাঁদে যাচ্ছি— এইমাত্র উঠেছেন তিনি।
দূরত্বময় ভ্রমণ এক জলপ্রপাতের তীর—
প্রতিটি ভাবনা বাক্যরচনা লিখছে ভেতর-ভেতর।
পথে, পান্থশালা, কিছু গাছ দারোয়ান হয়ে আছে।
গল্প করি, রাত্রি— আহরণ হলে শীতলতা,
একটি চন্দ্রিকা-রাত দার্শনিক হয়ে ওঠে!

শিষ্য, তলদেশ থেকে উঁকি দিয়ে দেখছি ঘোড়াটি নেই।
বোধ আর বোধহীন নিজেরা লিখছে বর্ণমালা—
চুপচাপ, চুপচাপ... বসো, আর নির্জনতা শোনো।

৯.
তাড়া খাওয়া কুকুরটি এসেছে হারানো পাড়া থেকে,
চুপিসারে, বিদ্যুৎ তারের তল দিয়ে সোজা-লেজ,
একটা ভয়ার্ত লোল আর শ্বাস বয়ে যাচ্ছে একা একা...

এবং হঠাৎ, ঘেউ, পুরো পাড়া মালিকানার কুকুরক্ষেত্র।

এ-রকম অভিজ্ঞতা, আমাদের আছে—
মানুষ পাড়ায় আমাদের বাস, এবং আমরা,
প্রতিদিন অন্যপাড়া হয়ে বাহিরে বেরুই আর ফিরে আসি।

জগৎ কি মায়াময়, নাকি ঘেউময়! ভাবো, আর শোনো—
অসংখ্য মানুষঘেউ... ঘেউ

১০.
দূরের গম্বুজ থেকে হলুদ আলোর শীর্ণ প্রপাত নাচছে,
আর, অলৌকিক হ্রদ সোনালী আঙুল নাড়ে—
মহৌষধির বেদনা এবং তোমার তাবৎ চোখের ধ্বনি
এখানে মিশ্রিত। দূরে, গাছজনগণ কালো হুডি পরা।

হৃদয়ে, যেখানে তুষারপাত চলছে, কিছুই দেখিনা—

তবে, আনন্দের তলে দুঃখরা মানুষ-উদযাপন করছে!

১১.
একা— এই হাওয়াজল বইছে।
কোলাহলে, উদিত বন্ধুসকল নৌকো চড়ে যাচ্ছে—
কোথায়! উদ্দেশ্যশূন্য একটা গহীন চর, আর,
সঙ্গের ভেতর নড়ে ওঠে নিঃসঙ্গের নিস্তব্ধতা।

সমস্ত দূরত্বে গেঁথে আছে হৃদয় রচিত পথ।
একা— এই হাওয়াজল বইছে।

১২.
তোমার সঙ্গেই চলছে তোমার কথাবার্তা—
এবং দুজন তুমি
একটি দিগন্তে অহোরাত্র কথা পান করে যাচ্ছ;
এই এক সখা, তোমাকে যাবে না ছেড়ে।

সখা, কেন যে দেওনা দেখা, সখা!

কেউ কি ফুপিয়ে কাঁদছে, ভেতরে!

মেঘ ওড়ে...

১৩.
শরতের সঙ্গে দেখা— সে আমার বয়েসি পুরুষ।
এটা নয় কেন, কোন মেয়ের মৌলিক নাম!
বৃষ্টিও মেয়েবাচক— অনেক ভেবেছি, শিউলি দেখেছি,
জল কমে আসা জগতসংসারও দেখে যাচ্ছি, আর,
গর্ভবতী নারী দেখে কিছু উপকারিতা শিখেছি—

বর্ষা, এক আদি নারী— তার পেট ফুঁড়ে আসে শরৎ পুরুষ!



শেষলেখ :

জলাশয়ে, মধ্যরাতে, চূর্ণিত
চাঁদ পড়ে গেছে— তুলতে এসেছি—
আমরা মানুষ, অবসণ্ন সম্প্রদায়!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন