সঙ্গমের আলোছায়া
১.
নিঃশব্দ সংলাপ
আলোর ভিতর
ঠোঁটের অন্ধকার। ভয়ার্থ কম্পন। তারপর
কাঁটার মেশিন গিলছে নিঃশ্বাস।
হাত বাড়াই ঘামের-আঙুলে জড়িয়ে ওঠে দেয়াল
২.
জলঘড়ি
জলের নীচে বুদবুদ
ভেসে যাচ্ছে মুখের কাল—
আঙুল ডোবানো গর্ভের অন্ধকার। চামড়ার
নীচেও কম্পিত সময়যিশু
হাঁটি অথচ মাটি কই
রাতের স্বাদে ভিজে থাকা জল
শ্যাওলা-জড়ানো স্মৃতি খুঁড়িয়ে হাঁটে ভবিষ্যত।
হঠাৎ নিজেরই চোখ নিজেরই পাঁজর
ছুঁতে গেলে গলার অতল নীচে
নিঃশ্বাসের বালি।
৩.
চোখের ভিতর দরজা
এখন আর কেউ নেই।
সেই যে দরজা হয়ে দাঁড়িয়েছি
চোখের ভিতর।
ঘামে ভেজা দরজার স্বপ্ন খুলে শরীর
মাঝখানে শব্দহীন ঝড়।
ঘুম ভাঙে দেয়ালের ফাঁকে
হেঁটে যায় এক জন্মের নিষ্পাপ
জানি না একবার ঢুকলে ফিরে আসা যায় কিনা!
৪.
কিছুই না
প্রথমে শব্দ গেল তারপর মুখ অতঃপর উত্তমপুরুষ
পায়ের নীচে মাটি
জানলাম পা-ই ছিল না।
সময় বয়ে যাচ্ছিল যন্ত্রের ভিতর
তাই সে নিজেকে গুনতে পারলো না
তাকিয়েছিলাম
একরাশ দৃষ্টি ছুঁয়ে-যাওয়া অনুপস্থিতির গায়ে
কিছু না-হয়েও
আঙুলে না-ধরা নাম ছিল না তার
একদম আমার মতো। হয়তো কিংবা এক সর্বনাম
অন্ধকার বলেও কিছু হয় না
কিছুই না। তাই সে এত জমাট।
৫.
কালো আয়না
তার দেহে চোখ গাঁথলাম
যেখানে আলো নেই ছায়া ফুটে আছে
আমার মতো নয়
দীর্ঘ কালো হাসির-জ্যামিতিতে
সে আমাকে চেবায়
অন্ধকারের ছিবড়ে বানায়
জিজ্ঞেস করি— তুই কে?
সে বলে না কিছুই
কাছে যাই—
একটা ফাঁকা ফ্রেম
যেখানে কেবলই কালো
নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে আয়নায়।
৬.
পুনর্জন্মের আগে কিছুক্ষণ
কোনও শব্দ ছিল না
কিন্তু শুনতে পেলাম
একটা আলো হাঁটছে খুব ধীরে
তার পায়ে শব্দ নেই
ভেবেছিলাম আমি মরে গেছি
তাই জিজ্ঞেস করিনি কিছুই
কিন্তু আলো প্রশ্ন করলো
যে প্রশ্ন আগে আমিও করতাম।
বুঝলাম মৃত্যুই শেষ নয় একটা মুহূর্ত
যখন ছায়া আর শরীর একসাথে হাঁটতে শেখে।
তাকালাম। আলোর দিকে
ওর ভিতর খটাখটে পাথরের অন্তর্জাল
৭.
নতুন চামড়া
রাত কেটে গেলে চামড়া নরম হয়ে আসে
শব্দ ভিজে আসে যখন
ঘষে দেখি— একটা নিষ্পাপ দাগ
আরও নীচে একটা কালো বরফ
পুরোনো ধীরে ধীরে খসে
ঝরে যায় মরা পাতা
পাতারা কথা বলে না। বাকল বলে।
“তুই যা ছিলি তা আজ আর তুই নয়।”
একটা স্মৃতির বন্দুক গেঁথে
ভুলিনি। অথচ মনেও দাগ নেই
নতুন স্পর্শ ব্যথা ও ভয়
আর সেই অন্ধকারের পরিচয়
যা আর আগের মতো মিলছে না
৮.
রক্তের ইশারা
রক্ত কাঁপছে অন্যভাবে
আমার নয়। অথচ আমারই ইতিহাস
অভিমান শিকড়ের বন্যতা ছেঁড়া চিৎকার
কানের পাশে হাত রাখলে তার ধ্বনি
কোনো এক ভাষার মোড়কে
রক্তে ইশারা ফেলে হাঁটার ভঙ্গিতে
চোখের ক্লান্তিতে হঠাৎ থেমে যাওয়া ঘুমের ভেতর
একদিন লেখা হয়
শরীর নয়। তবুও রক্তের বিন্দু ছুঁয়ে বইছে
৯.
নক্ষত্রের হাড়
হঠাৎ বুঝি জীবনের ভারী কাঁধ
রাত্রির গহ্বরে যে দাগ লেগে আছে
আলোর ত্বকে। সেও কোনো নক্ষত্রের মৃত্যু থেকেই এসেছে
ঝনঝন হাড়ের অনুভব
সুরের মহাজগত পৃথিবীর ভাষায়
একা নয়। মানুষও বহন করে
ধ্বংস হওয়া ধুলোর সূর্যে
আর জন্মহীন কান্নার গ্রহে
হাঁটলেই নড়ে পুরোনো তারা
স্থির আকাশ ঝরে নিঃশব্দে
জানি না হাড়ে লেখা মহাবিশ্বের অসীম শরীর
১০.
পায়ের নীচে নদী
পায়ের নীচে জল। শুনতে পাচ্ছি মৃদু গুঞ্জন
এক শূন্য থেকে অপর শূন্যে
শরীরনদী। স্রোতের অদৃশ্য ছুঁয়ে মনুষ্যত্বের কিনারা
পাথরের আকস্মিক সমস্ত ভীতির বাঁকে
এই নদীই নিয়ে যায় অজানা এক জাগরণে
হাত ছুঁয়ে জলের ফিসফিস
ভেসে থাকা। হারিয়ে যাওয়া
ফিরে আসা নদীর মতোই
নিজেকে নতুন গড়নে।
১১.
নিঃশব্দ জ্বলন্ত
নিঃশব্দ ভিতরে কিছু আগুন
স্পর্শ নেই। ছুঁয়ে দেয় নরম কাপড়। যেমন অন্ধকার
আলোও গোপন। ছায়ার দুটো ডানা
গলির মোড়ে পাখির নিঃশব্দ সন্ধ্যা
দানবের আলো। ছোট্ট মোমবাতি জ্বালে
আত্মা কথার চুনসুরকি মুক্তির জ্বলন্ত মুহূর্তে
নিঃশব্দ আত্নসাতে
এক নীরবতা। আবার জন্মায় নতুন অন্ধকারের মোড়ক