দোঁহা

গদ্য কবিতা

 


জয়িতা ভট্টাচার্য 

ফেসবুক খুলে আমরা প্রতিদিন আজকাল নিত্য নতুন ও সহস্র কবিতা দেখি। এর মধ্যে কোনোটি ছড়া,কোনোটি অন্ত্যমিল বিশিষ্ট সাবেকি কবিতা অথবা গদ্য কবিতা।কিছুদিন আগে অবধিও সাধারণ পাঠকের মধ্যে গদ্য কবিতাকে সঠিক কবিতা বলা যায় কিনা এ নিয়ে একটা খুঁতখুঁতে ব্যাপার ছিল। এর প্রধান কারন ছোটো থেকে স্কুলে যে সাহিত্য পড়ানো হয় তার অধিকাংশই অন্ত্যমিল  যুক্ত  একটি নির্দিষ্ট আঙ্গিক ও ছন্দ বাঁধা রচনা যা আদর্শ কবিতা বলে বিবেচিত হয়।
      গদ্য কবিতা কিন্তু একেবারেই খুব পুনরাধুনিক কোনো প্রয়াস নয়।
     আমরা লক্ষ্য করলে দেখব সপ্তদশ শতকে গ্রীক ও হিব্রু বাইবেল যখন ইংরেজিতে অনূদিত হয় সেটি অভিনব গদ্য কবিতার আঙ্গিকে এক সুচলন গাথা। তবে ১৮৪২ সালে Aloysius Bertand এর লেখা Gespard La Nuit গদ্য কবিতাকে প্রথম পাঠক স্বিকৃতি দেয়।এরপর অনেকেই এই জাতীয় কবিতা রচনায় আগ্রহী দেখা যায়।
১৮৬৯ এ Bandelaire রচিত Petis poems en prose উল্লেখযোগ্য। এরপর রাবোঁ,অস্কার ওয়াইল্ড, এমি লোয়েল, ভার্জিনিয়া উল্ফ কিম্বা      দক্ষিণ আমেরিকার পারলো নেরুদা, বোর্জেস, ইতালির কবি মারিনেত্তি, রাশান কবি তুর্গেনিভ, মার্কিন কবি হুইটম্যান প্রমুখ এই ধারার সার্থক কবি বলা যায়।
মূলত ফরাসী বিপ্লবের পরবর্তী সময় থেকে এই গদ্য কবিতার উদ্ভাবন বলা যায়।মতান্তরে 
আভা গার্দে আন্দোলনেরই নানা 
ফলশ্রুতির একটি গদ্য কবিতার ক্রম জনপ্রিয়তা লাভ।
প্রসঙ্গত, আভা গার্দে শব্দটি ফরাসী "vanguard" থেকে এসেছে। যার মানে প্রথম সারির সৈনিক। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক হেনরি
দ্য সেন্ট সাইমন প্রথম প্রয়োগ করেন শব্দটির।তিনি প্রথাগত ও গতানুগতিক সৃজনের বিরুদ্ধে একটি radical বা আগ্রাসী ইন্টেলেক্চুয়াল আন্দোলনের সূচনা করেন যা বাঁধাধরা সীমার বাইরে শিল্পকে দেবে অনন্ত স্বাধীনতা। মনন ও প্রকাশের স্বাধীনতা।অর্থাত যোদ্ধা মতো চলমান শিল্পচর্চার বিরুদ্ধে গিয়ে নতুন ধারনা ও চিন্তার প্রচলন করা।
যদিও আমরা জানি প্রখ্যাত কবি টি এস ইলিয়ট এই আভা গার্দে র বিরোধিতা করেছেন তীব্র ভাবে।তবে তিনি নিজেও চেষ্টা করেছেন এই ধারায় লেখার।
আভা গার্দে কবিতার জনক হিসেবে অবশ্যই চার্লস ব্যোদলেয়ারের অবদান অনস্বীকার্য।
গদ্য কবিতা একটি বিশেষ ধারার কবিতা।রূপক ভাষাকে সমৃদ্ধ করে গদ্য কবিতা।একসময় নির্দিষ্ট ভাগে বিভক্ত ছন্দ ও সাধু ভাষা কবিতার বৈশিষ্ট্য ছিল।তখন ছন্দ মিল রাখা ছিল অনিবার্য। 
        বাংলা ভাষার প্রথম গদ্য কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ,"শিশুতীর্থ" তে ১৯৩১। প্রথম প্রকাশিত গদ্য কবিতার বই "পুনশ্চ "(১৯৩২)।
শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথ যে গদ্য কবিতাগুলি লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তার গুরুত্ব অপরিসীম।
বস্তুত সৃজনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অমূল্য অবদান রেখে যাননি।
"শ্যামলী"কাব্য গ্রন্থের "আমি" কবিতাটির কিছু  মূলত শেষ দুটি  প্যারা এই প্রসঙ্গে দেখা যেতে পারে।বলা বাহুল্য প্রথম স্তবকটি 
প্রায় সকলেরই মনে উজ্জ্বল 
     আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো
পাবে পশ্চিমে।
............................
............................
তত্ত্ব জ্ঞানী জপ করছেন নিশ্বাসে
প্রশ্বাসে___
না,না না__
না_পান্না,না_চুনি,না-আলো,
না-গোলাপ,
না-আমি,না-তুমি।
ও দিকে,অসীম যিনি তিনি স্বয়ং
করেছেন সাধনা
মানুষের সীমানায়,
তাকেই বলে'আমি'।

সেই আমি'র গানে আলো__ আঁধারের ঘটল সংগম,
দেখা দিল রূপ,জেগে উঠল রস;
'না' কখন ফুটে উঠে হলো 'হ্যাঁ'মায়ার মন্ত্রে, 
রেখায় রঙে,সুখে দুঃখে।।

        রবীন্দ্রনাথ পুনশ্চ র ভূমিকায় গদ্য কবিতা সম্পর্কে ব্যাখা দিয়েছেন,
"গদ্যকাব্যে অতি নিরূপিত ছন্দের বন্ধন ভাঙাই যথেষ্ট নয়,পদ্যকাব্যে ভাষায় ও প্রকাশ রীতিতে যে সলজ্জ অবগুন্ঠন প্রথা আছে তাও দূর করলে তবেই গদ্যের স্বাধীন ক্ষেত্রে তার সঞ্চরণ স্বাভাবিক হতে পারে।অসঙ্কুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেক দূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব এই আমার বিশ্বাস এবং সেই দিকে লক্ষ্য রেখে এই গ্রন্থে প্রকাশিত কবিতাগুলো লিখেচি।এর মধ্যে কয়েকটি কবিতা আছে তাতে মিল নেই, পদ্য ছন্দ আছে,কিন্তু পদ্যের বিশেষ ভাষা রীতি ত্যাগ করার চেষ্টা করেচি। যেমন "তরে","সনে" মোর প্রভৃতি যে সকল শব্দ গদ্যে ব্যবহার হয় না সেগুলিকে এই সকল কবিতায় স্থান দিইনি।"(২আশ্বিন ১৩৩৯)
    এতদিন যাবৎ পদ্যের ভাষারীতি ও আঙ্গিক পিঞ্জরে আবদ্ধ কবিতাকে ভাঙা হয়েছে গদ্য কবিতায়।
কবিতার "ভাষা" একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রসঙ্গত মনে আসে বিশ্ব কবিতা সাহিত্যের ক্লাসিক পরিকাঠামো বদল করার প্রয়াস দেখা যায়, ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর প্রথম দিকে language poetry একটি সাহিত্য আন্দোলন ঘটে মার্কিন দেশে,  Language নামের পত্রিকা থেকে এর সূচনা।এই ধারার কবিরা যেমন,বার্নার্ডেট মেয়ার, ব্রুস এণ্ড্রুজ, জেমস শেরী,চার্লস বার্নস্টেন প্রমুখ এই language movement এর সঙ্গে যুক্ত হন। ল্যাঙ্গয়েজ পোয়েট্রি পাঠকের ভূমিকার ওপর জোর দেয়। একটি কবিতার ভাষারীতি ও তার বিনির্মাণের ভার ও স্বাধীনতা পাঠকের। তাই তাঁরা সাধারণ মানুষের মুখের বুলি ও কাব্যের নির্দিষ্ট শৈলীর ভিন্নতা সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।যেখানে সাধারণ ভাষা কেবল একটি যোগাযোগ, কাব্য ভাষা অনেক গভীর ইসারা করে,ব্যবহার হয় ইমেজেরি, রূপক, সিম্বল।
     গদ্য কবিতার পর্বগুলো নানা মাত্রায় হয়।পর্বগুলোর দৈর্ঘ্যে কোনো বিশেষ সমতা বা মিল থাকে না।কোনো পদ বা চরণ যতি দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বিরাম চিহ্ন বা ছেদ চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়,অর্থ প্রকাশের সুবিধার্থে।গদ্য কবিতা ছন্দে লেখা হলেও তা পড়ার সময় সুরের আভাস পাই। এর পদবিন্যাস  কিছুটা নিয়ন্ত্রিত এবং পুনর্বিন্যাসিত হয়।
       সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বিখ্যাত 
প্রবন্ধ, "কাব্যের মুক্তি" লিখলেও নিজে তেমন কোনো গদ্য কবিতা লেখেননি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুনশ্চ কবিতায় লিখেছেন,
   "ওর ভাষা গৃহপাড়ার ভাষা___
  তাকে সাধুভাষা বলে না।
জল স্থল বাঁধা পড়েছে ওর ছন্দে ,
রেষারেষি নেই তরলে শ্যামলে।"
       রবীন্দ্রনাথের হাতে গদ্য কবিতার সূচনা হলেও তা সাবালকত্ব পেয়োছিল তিরিশের দশকের দুই কবির কাছে___
জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসু।
       সমর সেন মেদবিহীন ঋজু গদ্য কবিতায় নাগরিকতা ও বাম মতবাদ তুলে ধরেছেন তাঁর রচনায় কিন্তু মহৎ গদ্য কবিতা তেমন পাওয়া যায়নি তাঁর রচনায়।
রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত কবিতার সচেতন প্রয়াস ১৯৩৫ সালে কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত "হাওয়ার রাত"।রচনাকার জীবনানন্দ দাশ।
.. ....
একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে,
সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে 
দাঁতের___ নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বনের কাছে ওই সুন্দরী গাছের নীচে___জ্যোৎস্নায়,
মানুষ যেমন করে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে
        হরিণেরা আসিতেছে। 
___ তাদের পেতেছি আমি টের 
অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায়, 
ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়।...(ক্যাম্পে)
এখানে পদ্য কবিতার কাঠামো ভেঙে ফেলা হয়েছে।যতিচিহ্ন র ব্যবহার অভূতপূর্ব। যদিও প্রথম দিকে সাধু শব্দের প্রয়োগ দেখা যায় যেমন বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রেও পরে তাও পরিহার করেছেন।
জীবনানন্দ কবিতা পত্রিকায় লিখেছেন, "গদ্য কবিতার একটা বিশেষ ভঙ্গি যা ঠিক রবীন্দ্রনাথে পাওয়া যায় না__ তার ভেতর কল্লোল নিজের মন খুঁজে পেয়েছিল বোধহয়।" রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করার একটা সচেতন প্রয়াস দেখা যায়। জীবনানন্দ লিখছেন," ... আমাদের দেশে গদ্য কবিতার দাবি যখন নানা অদেয় জিনিস চাইছিলো যখন খানিকটা রবীন্দ্রনাথের সমর্থনে অথবা আজকে__ মার্কসীয় বিচারে কবিতা শুদ্ধ হলো কিনা কোথাও কোথাও তার আশ্চর্য আতিশয্যের ভিতরে।"
বুদ্ধদেব বসু গদ্য কবিতার নির্মাণ ও শৈলীর ক্ষেত্রে বোদলেয়ারকেই আদর্শ মেনেছেন। বোদলেয়ার ও রিলকের কবিতার অনুবাদের সময় তাঁর দ্বিতীয় পর্যায়ের এই কবিতাগুলো লিখেছেন বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। ১৯৬৪ তে ব্রুকলিন থাকাকালীন "একদিন চিরদিন "কবিতাটির পরবর্তী দুবছর গদ্য কবিতা লিখেছেন এই ধারায়।
১৯৬৬ ভারবি থেকে প্রকাশিত মরচে পড়া পেরেকের গান,অতঃপর একদিন চিরদিন ও অন্যান্য সতেরোটি কবিতার কাব্যগ্রন্থ। কিছু কবিতায় রয়েছে আংশিক গদ্য। 
তাঁর "দোকানিরা" কবিতাটি আদর্শ গদ্য কবিতার নিদর্শন, 

দোকানিরা 

ষোলো বছর আগে,যখন প্রথম এপাড়ায় এসেছিলাম, 
তখনের আসবাব ছিল অন্যরকম। 
ঘাস ছিল তখন,
যেখানে-সেখানে নারকোলের ঝাঁকড়া মাথা,
যেখানে-সেখানে গুল্মরের গুঁড়ো,
আর মাঠে মাঠে জমে থাকা বৃষ্টি,গ্যাসের আলোয় বেগুনি আর সবুজ,
স্বপ্ন আর বীজাণুর গরিভধারিণী।"
পরবর্তীতে বিনয় মজুমদারের দীর্ঘ যতিচিহ্ন বিহীন টানা লেখা গদ্য কবিতাগুলি আমাদের মনে নির্জন অভিঘাত সৃষ্টি করে।মনীন্দ্র গুপ্ত শামসুর রাহমান হয়ে ক্রমশ বাঁকবদল হতে থাকল বাংলা সাহিত্যের গদ্য এরপর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন