পল্লব দাস
ইংরেজি ও অন্যান্য ইউরোপীয় সাহিত্য পড়ানোর সময় অনেক অধ্যাপক বলেন, ভালো টেক্সট নাকি বিভিন্ন মানুষের কাছে বিভিন্ন ভাবে ধরা দেয়। কিন্তু, বেশিভাগ ক্ষেত্রে পড়ানোর সময় আমরা গতানুগতিকের বাইরে গিয়ে বোঝাতে চাইনা। শুরুতে একটা হিসেব কষে ফেলা যাক। লেখকের বোধকে স্থির ধরে নিলে বলা যায় নিজের বোধ ও চিন্তনের উপর নির্ভর ক’রে পাঠক লেখকের শব্দের অর্থ তৈরি করে। অর্থাৎ কোনো টেক্সট সহজবোধ্য না দুর্বোধ্য তা অনেকটাই নির্ভর করে লেখক ও পাঠকের মাঝে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দূরত্বের উপর। আমার মতে পাঠকের কাছে তা অতিক্রম্য কখনওই নয়। কোনো বিশেষ সময়ে লেখা কোনো টেক্সটে লেখক ঠিক কী বলেছেন তা তা কী কিছুদিন পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লেখকের পক্ষেই বলা সম্ভব? পাঠক তো আসেন তার পর। পাঠক ও লেখক কখনওই এক স্পেস দখল করতে পারেননা। কারণ দুজন আলাদা মানুষ - আলাদা অস্তিত্ব। তাঁদের চিন্তা কখনও এক রাস্তায় গেলেও ফারাক থাকবেই। এখন, দুজনের দূরত্ব বেশী হলে সেই অর্থ এবং আরোপিত অর্থের ব্যবধানও কিন্তু বাড়তে থাকে। এই ব্যবধান ঠিক ভুল নির্দেশ করে না; নির্দেশ করে মূলত গভীরতার অভাব অথবা চিন্তা ওই দর্শনের সীমাবদ্ধতা। ঠিক এই কারণেই যে কোনো টেক্সটের বহুস্তরীয় অর্থ নির্দেশ সম্ভব। পড়তে বসে এটা যত না উপলব্ধি করেছি, পড়াতে গিয়ে তা আরও বেশী উপলব্ধি করেছি। দেখেছি শ্রেণী, লিঙ্গ, যৌনতার বাছ-বিচার, ধর্ম, রাজনীতি, পেশাগত অবস্থান, এমনকি নিজের ব্যক্তিগত পরিসরে অবস্থান থেকে একই টেক্সটকে আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পড়া যায়। অবশ্য, যদি লেখকের আর পাঠকের বোধ সম্পূর্ণ উল্টো পথে হাঁটে তাহলে ভুল পাঠের সম্ভাবনা থাকে বৈকি!
যদিও এই নিবন্ধে আমি দুটি এলিজাবেথান নাটকের টেক্সটকে একটু অন্যভাবে পাঠ করা নিয়ে আলোচনা করবো, শুরুতে একটা অন্য উদাহরণ দিচ্ছি যেটা আমার ছাত্রছাত্রীদের থেকে ‘শেখা’। নাটকের নাম ইডিপাস রেক্স বা রাজা ইডিপাস। নাট্যকার - প্রাচীন গ্রীস দেশের সফোক্লিস। কেউ নাটকটিকে পড়েন চরিত্রের নাটক হিসেবে, কেউ দেখেন ভাগ্যের পরিহাস। আবার সমালোচকদের একাংশ উত্তর আধুনিক সময়ে নাটকটিকে ডিসাবিলিটি স্টাডির টেক্সট হিসেবে চর্চা করেন। এদিকে একদিন সময়ের আগে ক্লাসরুমে ঢুকে শুনি এক ছাত্র তার বন্ধুদের আলোচনায় বলছে, আসলে এটি একজন মাতৃ-রমনকারীকে কেন্দ্র করে লেখা প্রথম নাটক। যে ভাষা সে ব্যবহার করে তা সাবেকি ইংরেজি বা বাংলা কোনোটাতেই লেখা সম্ভব না। কিন্তু ভাবলে দেখবেন, খোদ ফ্রয়েড সাহেবও ব্যাপারটা নিয়ে বেজায় রকম ভেবেছেন। মা ছেলের সম্পর্কের যৌন দৃষ্টিকোণকে তাই তিনি ইডিপাস কমপ্লেক্স নাম দিয়েছেন। যাক গে, এদিকে ক্লাসরুমের আলচোনা কিন্তু এখানেই শেষ হয়না, তার এক বন্ধুর মতে রাজার ওই পাপ ঢাকা দিতেই এতো বড় নাটকের অবতারণা। ভাবুন শ্রেণী, মরালিটি – সব মিলে মিশে একাকার। দেখলাম একজন সাহিত্যের শিক্ষক ও সমালোচক হিসাবে প্রথম চাররকম পাঠের কোনটাই সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। তবে শেষের ওই পঞ্চমটির সম্ভাবনা থেকেই যায়। ওটি হচ্ছে সেই ভুল পাঠ যেখানে লেখক ও পাঠক উল্টো পথে হেঁটেছেন।
এবার আসি সিরিয়াস বিকল্প পাঠের কথায়। যদিও ব্রাডলির শেক্সপিয়ার গবেষণা আধুনিক কালে অনেকে গ্রহণ করেন না, তার শেক্সপিয়ারিয়ান ট্রাজেডি-তে তিনি ম্যাকবেথ নাটকটিকে ইডিপাসের পাশাপাশি ফেলে আদর্শ ট্রাজেডি হিসেবে আলোচনা করেছেন। লেডি ম্যাকবেথের চরিত্র পাঠ করলে ম্যাকবেথ ও তার স্ত্রীর মাঝে একটা ইডিপাস কমপ্লেক্স কাজ করতে দেখা যায় – এ কথা অস্বীকার করে লাভ নেই। এই নাটকটিকে সাবেকি ধারার সমালোচকরা চরিত্র-নির্ভর নাটক হিসেবেই দেখতে পছন্দ করেন। অনেকে ভাগ্যের প্রভাব দেখেন ডাইনিদের সাথে ম্যাকবেথের সাক্ষাতের মুহূর্তে, অথবা ব্যাঙ্কোর সন্তানের হত্যাকারীর হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার মধ্যে। কিন্তু, এ নাটকটায় আমার মতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রেরা হলেন ওই তিনজন ডাইনি এবং লেডি ম্যাকবেথ যাকে চতুর্থ ডাইনিও বলেন অনেক সমালোচক। ইংরেজি witch শব্দটি wizard শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। অথচ wizard শব্দটি শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হলেও সামাজিক ইতিহাস witch শব্দটিকে প্রায় গালাগালির পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। এটা তো পুরষতন্ত্রের ষড়যন্ত্র বৈ কিছু নয়! অত্যাচারিত, সমাজ থেকে বহিষ্কৃত তিন বিদুষীর প্রতিশোধের গল্প কি ম্যাকবেথ বলে না? তাঁদের রোষ রাষ্ট্রের নেতার প্রতি – রাজার সিংহাসনের প্রতি, সে রাজার আসনে যেই বসুক না কেন। প্রথমে তারা ম্যাকবেথ আর ব্যাঙ্কো – দুজনকেই ক্ষমতার লোভ দেখাচ্ছে। যদিও হলিনশেড বলছেন ম্যাকবেথ ও ব্যাঙ্কো একসাথেই ডানকানকে হত্যা করেছিলেন, শেক্সপিয়ার সে পথে হাঁটলেন না। তার কারণ কি কেবল দ্বীপরাষ্ট্রের সিংহাসনে বসা ব্যাঙ্কোর উত্তরপুরুষ? লেডি ম্যাকবেথকে প্রায় বাইবেলের ইভের মতন কলঙ্কিত করে দিলেন তিনি। ম্যাকবেথকে ডানকানকে হত্যা করতে বাধ্য করতে ব্যাবহার করলেন সেই যৌনতার অস্ত্র। লেডি ম্যাকবেথ তার নারীত্বের বিসর্জন দিতে চান। তার স্তন যেন কোনো শিশুকে দুগ্ধ পান করাতে ব্যবহৃত না হয়। একজন পুরুষের কাছে তার স্ত্রীর এই বিলাপ গভীর অর্থবহ। প্রথমে স্বামীর অধিকার পরে পিতার অধিকার – দুটি থেকেই বঞ্চিত করার ভয় দেখালেন। ম্যাকবেথের হাতে ছুড়ি, বিছানায় ডানকানের মাংস, অথবা আদমের গাছের আপেল – খুব পার্থক্য রাখলেন না। ঈশ্বরের মৃত্যু হল। শয়তানের রাজত্ব কায়েম হল। কিন্তু, তাও বা হল কই? রাজা ভগবান না শয়তান – তাতে কিছু যায় আসেনা। আসল শত্রু সিংহাসনটাই। অতয়েব শয়তানও তিন ডাইনির ফাঁদে পা দিলেন। শয়তানও তো পুরুষ – ভগবানের মতোই!
আরেকটি নাটকের কথায় আসি। নাটকের নাম এডওয়ার্ড দ্য সেকেন্ড । নাট্যকার ক্রিস্টোফার মারলো। নাটকটিকে সিংহাসনের রাজনীতি হিসেবে মূলত পড়ানো হলেও বা পাঠ করা হলেও এই নাটকের কেন্দ্রীয় অক্ষ বোধহয়, এডওয়ার্ড ও গেভস্তোনের মধ্যে সমকামিতার আভাষ। শেক্সপিয়ার তার বেশ কিছু কমেডিতে পুরুষ চরিত্রগুলির মধ্যে সমকামিতার আভাষ দিলেও, এতো সরাসরি সমকামিতা নিয়ে তিনিও লিখতে পারেননি। মারলো সরাসরি বলছেন যে গেভস্তোন প্রায় রাণী ইসাবেলার জায়গা নিয়ে ফেলছে। এডওয়ার্ডকে হত্যা করা হচ্ছে শূলে – এতেও মারলোর যৌন-চিহ্নের ব্যাবহার লক্ষ্যণীয়। এই নাটকটিও কেবল গৃহযুদ্ধ এবং সিংহাসন দখল করার নাটক হিসেবে না পাঠ করে এমন নাটক হিসেবে পাঠ করা উচিৎ যেখানে ব্যক্তির যৌনতার পছন্দ রাজার রাষ্ট্রনীতির সাথে সম্মুখ সমরে নামছে। মারলো দেখাচ্ছেন – রাজা ও ব্যক্তি- কোনও একজনের এই দুই সত্ত্বা গুলিয়ে গেলে কারও যৌন অবস্থানও রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি হতে পারে। এই জায়গা থেকেও কিন্তু এই নাটকে ট্রাজেডির আবাহনকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব।
সবটুকু বলার পরিসর বা প্রয়োজন এই নিবন্ধে কম। বরং যা বলা গেল না, তার খোঁজ পাঠককে অন্যান্য টেক্সটের বিকল্প পাঠে অনুপ্রাণিত করলে লেখকের শ্রম সার্থক হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যাবে।
