দোঁহা

প্রব্রজ্যা



 সংহিতা বন্দ্যোপাধায়

 প্রথম দেখেই বুঝেছিলাম ভিখারি নয়। ট্রেনে   রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে যে যা দিত নিতেন । একদিন আমি টাকা   দিতে যেতে নিলেন না!
“কী হল?”
বিষন্ন হাসলেন তিনি –
“দরকার নেই, দিনে তিরিশ টাকা লাগে আমার, টাকা উঠে গেছে, আর নেব কেন? জানো তো টাকা মাটি- “
“বাকিটা জমালে তো ভিক্ষা করতে হত না! এত সুন্দর রবীন্দ্র সঙ্গীত গান , কোথায় থাকেন আপনি?’
“স্টেশানে, গান ভাল লেগেছে তোমার?”
 প্রশ্নগুলো এড়িয়ে গেলেন তিনি। 
“আপনিতো শিক্ষিত, ভিক্ষা করছেন কেন ?”
 আমাদের বন্ধু দীক্ষা আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছে। বছর পঁয়ষট্টির ফর্সা    শীর্ণ নুব্জ্য শরীর   পরনের  শাড়ির মালিন্য , অবিন্যস্ত চুল কিছুই তাঁর  হাসিমুখের প্রশান্তি  কেড়ে নিতে পারেনি! 
“এম এ করেছিলাম, ইংরাজিতে!” কথাগুলো বলতে বলতে দরজার কাছে মেঝেতে বসে পড়লেন তিনি ।   বিকেলের আলো  মুখের ওপর , পিছনে ছুটে যাচ্ছে সবুজ মাঠ, কাশবন…তিনি বাইরে তাকিয়ে   গেয়ে চলেছেন,
”আজ যেমন করে গাইছে আকাশ!”
 আড্ডা ,ঝাল মুড়ি ,  আমাদের সেই দৃশ্যের আবেশ থেকে জাগতিক পৃথিবীতে ফেরাতে পারেনি সেদিন। 

পরদিন   ভীড় ট্রেনে ওঠার মুহূর্তে  চটি খুলে   লাইনে পড়ে গেল আমার !
দীক্ষা আমাকে টেনে তুলে নিতে  এক পায়ে চটি পরে আমি সিটে বসে পড়লাম । ঠিক হল হাওড়া স্টেশানে নেমে  জুতো কিনে নেওয়া যাবে।
“তোমরা আমার  কথা জানতে চাইছিলে?”
কখন উনি নিজেই কথা বলতে এসেছেন খেয়ালই করিনি!
“হ্যাঁ তো, বসুন । “
পাশে বসে, মৃদু হাসলেন উনি । তারপর  বলতে শুরু করলেন ।
“আমার তখন কুড়ি বছর , দেশ ভাগ হয়ে শরনার্থী শিবিরে, বাবা মায়ের কাছ থেকে ছিটকে গেলাম আমি আর আমার বোন । সেখানে একাধিক পুরুষের লালসার শিকার হয়েও বোনকে প্রাণপণে রক্ষা করতাম ।,তবু এক রাত্রে সেও হারিয়ে গেল !তারপর অনেক ঘাটে ঘুরে , নিজের পেট চালিয়ে  জেদ আর কষ্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছি শুধু বোনকে একদিন খুঁজে বের করব বলে । “
“তারপর? দেখা পেলেন?’
আমার প্রশ্নে, সেই বিষন্ন হাসি।
“তখন আমি যাদবপুরে এক সরকারি স্কুলের ইংরাজির শিক্ষিকা। কাগজে ওর জন্য বিজ্ঞাপন দিতাম , একদিন ও আমার ঠিকানায়  পৌঁছল, সঙ্গে ওর স্বামী। আমি তো ওকে ছোট্ট দেখেছিলাম, প্রথমে চিনতে পারিনি। তারপর ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কী কান্না!আমিও কাঁদলাম, আনন্দে, বেদনায়। বিয়ে করিনি , শুনলাম ওর বরের তেমন চাকরি কিছু নেই , এদিকে ওদিকে মজুর খাটে  ,ও নিজেও তাই, পড়াশোনা শেখেনি , আমি ওদের নিজের  বাড়িতে ডেকে নিলাম ,মাস ছয়েক বাদে ওরাই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল!”
“কী! কি করে?”
প্রায় চিৎকার করে উঠেছে দীক্ষা।
“বাড়ির দলিল বোনের নামে করে দিয়েছিলাম  ,ছোট বোন!ওরা  মারধোর করে,  বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। স্কুলে আর যাইনি  , পৃথিবীটা মিথ্যে মনে হল, এক কাপড়ে বেরিয়ে এলাম । তারপর এই স্টেশান, এই জীবন !  মনে হয় পূর্ব জন্মের কথা সব ।  এক শিক্ষিকার স্নেহ পেয়েছিলাম কলেজে, যতদিন বেঁচে ছিলেন নিজের কাছে রেখেছিলেন আমায় , একা থাকতেন সাথী ছিল রবীন্দ্রনাথ আর বই , গান আমার তাঁর কাছে শেখা।“
“ফিরে যাননি আপনি ? “
“নাহ ! কার কাছে যাব? কিসের মায়ায়? এই বেশ আছি,। ঈশ্বর , এমনি করেই মুক্তি দেন ”
ট্রেন হাওড়ায় ঢুকতে, দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি । 
আমরা কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে,মধুরিমা  বলল
“তোর জুতো কিনতে হবে তো, নামবি কী করে?”
আমি বললাম
“হুঁ”
 হাওড়া স্টেশানে অসংখ্য লোকের ভীড়ে খালি পায়ে হাঁটতে কেন যেন সেদিন একটুও অসুবিধে হয় নি আমার!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন