সূর্যাভ বিশ্বাস
আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে জন্মেছি আর বেড়ে উঠেছি,তারা জানবেন আমাদের এই বেড়ে ওঠার গতিটার মধ্যে একটা নির্মল আনন্দের বুদ্বুদ ছিলো।অথচ আমরা মানি বা না মানি বদলে যাচ্ছি আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো করে প্রতিদিন।এ এক আশ্চর্য অন্তর্লীন প্রক্রিয়া।অথচ মাঝে মাঝে যেটুকু সময় এই জীবনটার সাথে কাটিয়ে ফেললাম তার দিকে ফিরে তাকালেই সবচেয়ে বেশী করে মনে পড়ে ছোটোবেলার স্মৃতি।বিশেষত দুর্গাপুজোর স্মৃতি।যদিও স্মৃতিরও বয়স বাড়ে,পুরোনো স্থাপত্যের মতো আলগা হয়ে আসে তার কারুকাজ তবুও একটা পিছুটান,নাছোড়বান্দা হয়ে জেগে থাকে অন্ধকার মাথার ভেতর আর খুঁজে চলে বাইরে বেরিয়ে আসার ছুঁতো।সুযোগ পেলেই জাপটে ধরে আমাদের,করে তোলে স্মৃতিকাতর।তবু প্রতিবছর দুর্গাপুজোর প্রাক্কালে মনে হয় আমি ফিরে গেছি আমার সেই ছোটোবেলার দুর্গাপুজোয়।
বর্ষা ফুরিয়ে এলেই একটু একটু করে রোদ যখন তার তেজ খুইয়ে ফেলতো আমরা অপেক্ষায় থাকতাম সেপ্টেম্বর মাস ফুরিয়ে যাওয়ার।সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি আকাশে রঙিন ঘুড়ির মেলা জানান দিত বিশ্বকর্মা পুজো ফুরিয়ে গেলেই মহালয়া।সপ্তাখানেক আগে থেকেই দাদু বসতো রেডিয়োটা মেরামত করতে।মনের ভেতর ঘোড়াদৌড়ের শব্দ পেতাম যেন।মহালয়ার ভোরে বেজে উঠতো দাদুর পুরোনো রেডিয়োটা। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ভরাট গলার স্তোত্রপাঠ।তখন নামে চিনতাম না কে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ।তবু যেন ওঁর ওই বিশুদ্ধ উচ্চারণ গেঁথে গেছিলো মাথার ভেতর।তাই আজও পুজো হোক বা অন্য যে কোনো সময় ওঁর স্তোত্রপাঠে চারপাশটা পুজো পুজো হয়ে ওঠে।
মনে পড়ে মেঠো পথ ভেঙে দুপাশে কাশের বন পেরিয়ে বাবার সাথে মৃৎশিল্পীর বাড়ি গিয়ে ঠাকুর তৈরী দেখে আসার কথা।রথের দিন থেকে শুরু হতো প্রতিমা গড়ার কাজ।খড়ের প্রতিমা থেকে দোমাটি,রঙ,ডাকের সাজ সিংহের দাঁত,কার্তিকের ময়ূর,লক্ষ্মীর পেঁচার মারমুখী চেহারা,গণেশের ইঁদুর,সরস্বতীর হাঁস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম।এই দেখার ভেতর লুকিয়ে থাকতো অপার বিস্ময়,অনন্ত কৌতূহল।সেই কৌতূহল যেন এতবছর পরেও মেটে না।কাদা মাটি মেখে কি অক্লান্ত শ্রম আর নিষ্ঠাকে পুঁজি করে আর খারাপ আবহাওয়াকে সঙ্গী করেই মৃন্ময়ী মূর্তি গড়ে তোলেন দক্ষ মৃ্ৎশিল্পীরা।
স্কুলে ছুটি পড়ত পঞ্চমীতে। কিন্তু মনে মনে ছুটি নিয়ে নিতাম মহালয়ার দিন থেকেই। তখন বছরে দুটো মাত্র পরীক্ষা হতো হাফইয়ার্লি আর অ্যানুয়াল পরীক্ষা। হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা ফুরিয়ে তখন আমরা তাকিয়ে থাকতাম বছর শেষের অ্যানুয়াল পরীক্ষার দিকে। একটু একটু করে পড়া সেরে রাখলে আর চিন্তা থাকতো না বছরভর। ঠিক এই সময়গুলোতেই প্রকাশিত হতো নানান গল্প উপন্যাস কমিক্সে ভরা রঙিন রঙিন পত্রিকা।পাড়ার পেপার কাকুকে বলে রাখলে আনিয়ে দিতো রঙবেরঙের মন ভালো করা পত্রিকা। যেগুলো নিয়েই কেটে যেত পুজো আর তৎপরবর্তী আলসে দুপুরগুলো। টানটান উত্তেজনা আর ছমছমে রহস্যময় আনন্দে।পড়ার বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়ার কি যে আনন্দ তা আজকের জ়েন-জ়িরা হয়তো টেরই পাবে না।
ছোটোবেলায় অনেকটা সময় আমি কাটিয়েছি একটা আবাসনে। সেখানেই কিছু বন্ধু জুটেছিলো আমার। এদের ঘিরেই পুজোর চারটে দিন কিভাবে যেন কেটে যেত খুব দ্রুত। বাড়ির লোকজনের সাথে ঠাকুর দেখতে যেতাম রিক্সায় করে। ভিড় কোনোদিনই আমার পছন্দের নয় তবু কেন জানি না দুর্গাপুজোর ভিড়ের ভেতর একটা অদ্ভুত আমোদ লুকিয়ে থাকে। নতুন নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ,রঙবেরঙের আলো,সুগন্ধীর গন্ধ সব মিলিয়ে হৈহৈ চৈচৈ ব্যাপার। আজ জামাকাপড় আরও বেশী ফ্যাশানদুরস্ত হয়েছে,নতুন নতুন রকমারী বাহারী আলোয় সেজে উঠছে মন্ডপ। কিন্তু মন খুশি করা সেই আমোদটা বোধ করি অনেকটাই কমে গেছে এখন।
প্রতিটা শব্দের একটা নিজস্ব প্রবাহ আছে।আছে একটা নিজস্ব স্নিগ্ধতা।মনে পড়ে একটা সময় আশা অডিও থেকে পুজোর সময় বাংলা গানের ক্যাসেট বেরোলে বাবা নিয়ে আসতো কিনে। কত কত আধুনিক গান শুনে কত নতুন শিল্পীকে চিনেছি। পুজোর গান মানেই নতুন সুর,নতুন কথা।মন্ডপে মন্ডপে আশা লতা কিশোর মান্না দে-র গান এখনও এই মফস্বলের ছোট্ট ছোট্ট পুজোগুলোতে কান পাতলেই শোনা যায়।
পুজো আসে, পুজো চলে যায়।সারাবছরের প্রস্তুতি চারদিনে ফুরিয়ে যায় চোখের নিমেষে। দশমীর বিকেলের মধ্যে একটা অব্যর্থ বেদনার নিঃশব্দ পদসঞ্চার ঘটে। এখানকার চৌধুরী বাড়ির ঠাকুর ভাসানের আগে নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর রীতি বহু পুরোনো। কৈলাসে শিবের কাছে মা দুগ্গার বাড়ি ফেরার খবর আগাম দিতে উড়ে যায় সেই নীলকন্ঠ পাখি দিগন্তে।চোখের ওপর ভাসে বাবার সাথে প্রথম থেকে ঠাকুর গড়া দেখতে যাওয়ার আশ্চর্য কৌতূহল। ধাপে ধাপে যা সৃষ্টি হয় তা নিমেষে বিলীন হয়ে যায় এক লহমায়।তবুও মানুষ আনন্দের কোনো ঘাটতি রাখেনা এই চারটে দিন। কেউ কেউ পুজো পেরিয়ে পায় হয়তো একটা জামা। পুরোনো প্যান্টের সাথে সেটা পরেই তার কি আহ্লাদ।হয়তো নতুন প্যান্ট তার একটা হবে কিন্তু তার জন্য আরও একটা বছরের অপেক্ষা।অথচ যার সামর্থ্য নেই, প্রাচুর্য নেই হয়তো সে শরতের সকালে ঘুম ভেঙে উঠে দ্যাখে উঠোন ভর্তি হয়ে আছে শিউলিফুলে।
পুজো ফুরোলেই আমরা ছোটোরা বড়দের প্রণাম করে নতুন করে শুরু করতাম লেখাপড়ার প্রস্তুতি। বইয়ের ধুলো ঝেড়ে মন দিতাম পড়াশোনায়।অথচ মন পড়ে থাকতো প্রতিমাহীন মন্ডপের খাঁ খাঁ শূন্যতার দিকে। যেখানে আগামী বছরের পুজোর প্রত্যাশাকে উস্কে দিয়েই যেন জ্বলে থাকতো একটা টিমটিমে প্রদীপ।তখন বড়ো একলা লাগতো ভেতর ভেতর। অপেক্ষা দিয়েই অপেক্ষাকে পরাস্ত করার চেষ্টায় কেটে যেত দিন ।
হিমের গোপন শব্দের মতো বাতাস থেকে কর্পূরের মতো উবে যেত পুজো পুজো গন্ধটাও। দিন ছোটো হয়ে এলেই পাড়াগাঁয়ে সন্ধ্যে একটা পাতলা কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে নেমে আসত।ভোরবেলায় পায়ের দিকের জানলা খুলতে বারণ করত মায়েরা। একটা হালকা কাঁথা রাখা থাকত পায়ের কাছে। যা ভোররাতে উঠে আসত বুকের ওপর। তবে পুজো ফুরিয়ে কালীপুজো আসার মাঝের এই সময়টায় কোনো কিছুতেই মন বসানো যায় না। নতুন উদ্যম ফিরে পেতে বেশ কিছুটা সময় বেশী লেগে যায়।রোদ খেলতে থাকে গোপন খেলা। বেলা আরও খানিকটা ছোটো হয়ে আসে।টেস্টপরীক্ষা,অ্যানুয়াল পরীক্ষা ঘাড়ের কাছে এসে নিঃশ্বাস ফেলে। চুপিসারে আসতে শুরু করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া হেমন্ত। ধানের গোছায় মখমলের মতো রোদ,ফিঙের চকিতে উড়ে যাওয়া, সর্দিগরমে মাখন ডাক্তারের চেম্বারের সামনে বিকেলের দিকের ভিড় পেরিয়ে জীবন চলতে থাকে আঁকেবাঁকে। মনের ভেতর পুজো ফুরোনোর দুঃখ ফিকে হতে হতেই শিকারী বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে শীতকাল।সে গল্প না হয় পরে করা যাবে অন্য সময় অন্য কোনোখানে...
