দোঁহা

সলিল চৌধুরী : সঙ্গীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

 


মিঠুন মুখার্জী 

বাংলা সঙ্গীত জগতের এক বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সঙ্গীত শিল্পী হলেন সলিল চৌধুরী। তার বহুমুখী প্রতিভা বাংলা সঙ্গীত জগতকে করেছে সমৃদ্ধ। সঙ্গীত রচনা থেকে শুরু করে সুর দেওয়া ও গান গাওয়ায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে কোনো ভাবেই অস্বীকার করা যায় না ‌। এই প্রবাদপ্রতিম প্রতিভাধর ব্যক্তিটি ১৯২৫ সালের ১৯ শে নভেম্বর গুয়াহাটির সোনারপুরে জন্মগ্ৰহন করেন। পিতা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী একজন সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ এবং তার কাকাও সঙ্গীতধারার শিল্পী হিসেবে উভয়েই সলিল চৌধুরীর শিল্পীসত্তাকে বিকশিত করে তুলেছেন। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক সংগঠন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের তিনি একজন সদস্য ছিলেন। এই সংস্থায় গান রচনা করে, সুর দিয়ে গ্ৰামে গ্ৰামে আপামর জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেন তিনি। সলিল চৌধুরীর প্রথম চলচ্চিত্র 'পরিবর্তন' এবং শেষ চলচ্চিত্র 'মহাভারতী'সহ মোট চল্লিশটি চলচ্চিত্রে তিনি কাজ করেছিলেন। হিন্দি চলচ্চিত্র 'দো বিঘা জমিন'-এ তিনি সঙ্গীত পরিচালকের কাজ করেছিলেন। ‌বাংলা ও হিন্দি ছাড়া মালায়লাম চলচ্চিত্র সহ ভারতীয় অন্যান্য ভাষায় তৈরি অনেক চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে 'মধুমতি' চলচ্চিত্রের জন্য ফিল্মফেয়ার সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার ও ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের কাছ থেকে সঙ্গীতনাটক একাডেমির সম্মানে ভূষিত হন।
     সলিল চৌধুরী গণসঙ্গীতের ক্ষেত্রে কোরাস গায়ন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তিনিই প্রথম ক্যয়ার সঙ্গীতের প্রবর্তক ছিলেন। তার কালজয়ী কয়েকটি সঙ্গীত হল --- 'ও আলোর পথযাত্রী', 'ঢেউ উঠছে কারা টুটছে','হেইসা মারো','মানব না বন্ধনে' প্রভৃতি। আবার বিমলচন্দ্র ঘোষের লেখা 'উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা' গানটিতে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ক্রিসক্রস গতি বা প্যাটান এবং পিয়ানোতে হারমোনিক  কর্ড ব্যবহার করেছেন। 'সুরের এই ঝর ঝর ঝর্ণা' গানটিতে প্রয়োগ করেছেন ভোকাল হারমনি। 'আজ নয় গুন গুন গুঞ্জন প্রেমে' গানটিতে কাউন্টার পয়েন্ট বা অবলিগেটো ব্যবহৃত হয়েছে। তার সমকালীন সমস্ত খ্যাতনামা ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পীই তাঁর রচিত ও সুরারোপিত গান গেয়েছেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও সুকান্ত ভট্টাচার্যের বেশ কিছু কবিতায় সুর আরোপ করে সেগুলিকে গান হিসাবে কালজয়ী করে দিয়েছেন তিনি।
           রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে বাংলা গানে সার্থক কম্পোজার হিসেবে সলিল চৌধুরীর কথাই সর্বাগ্রে মনে আসে। সলিল চৌধুরী কী কথায়, কী সুরের আঙ্গিকে, যন্ত্র-আয়োজনে প্রচলিত রীতিনীতি ভেঙে বাংলা গানকে নবদিগন্তের সন্ধান দিলেন। পুরনোকে অস্বীকার করা নয়, ঐতিহ্য মেনেই তাঁর অন্য পথে যাত্রা। সলিল চৌধুরীর সুরে কলকাতা ও বোম্বের একঝাঁক শিল্পীরা অসংখ্য গান গেয়েছেন। তারমধ্যে অনেক গানই কালজয়ী হয়ে আছে। তার সুর দেওয়া এমন কিছু কালজয়ী গান ও গাওয়া শিল্পীর নাম নিম্নে দেওয়া হল-
        ক) লতা মঙ্গেশকর-  

১) সাত ভাই চম্পা 
 ২) না যেও না 
 ৩) ওগো আর কিছু তো নাই
 ৪) কি যে করি 
 ৫) কে যাবি আয় ।
      

খ) সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়-
১) যা রে যা ফিরে যা
২) গুণ গুণ মন ভ্রমরা
৩) সজনী গো কথা শোন

৪) গা গা রে পাখি গান

৫) গহন রাতি ঘনায় ।
   

 গ) সবিতা চৌধুরী-   

১) হলুদ গাঁদার ফুল 
২) সুরের এই ঝর ঝর ঝর্ণা 
৩) মরি হায় গো হায়
৪) ঘুম আয় ঘুম আয় 

৫) মনোবীনায় এখনই কেন।
 

ঘ) দ্বিজেন মুখোপাধ্যায-
                                       ১)শ্যামলবরণী ওগো কন্যা
 ২) পল্লবিনি গো সঞ্চারিনী
  ৩) একদিন ফিরে যাব চলে 
  ৪) রেখো মা দাসেরে মনে।
 

ঙ ) প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়-


 ১) নাও গান ভরে নাও
 ২) সেই ঝিম ঝিম সুরে 
 ৩) আসা শান্তির আহ্বান।
      

এছাড়াও সলিল চৌধুরীর অসংখ্য গান রয়েছে যেগুলো বিভিন্ন শিল্পীরা তাদের কন্ঠে গেয়েছেন। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গান ও শিল্পীর নাম নিম্নে দেওয়া হল-
১) মন মাতাল সাঁঝ সকাল (মুকেশ)
২) আমি চলতে চলতে থেমে (পিন্টু ভট্টাচার্য)
৩) যায় যায় দিন (বিশ্বজিৎ)
৪) এমনি চির দিন তো (অনুপ ঘোষাল)
৫) কি হল চাঁদ (সাগর সেন)
৬)চলে যে যায় দিন(অরুন্ধতি হোম চৌধুরী)।
   

বাংলা বহু সিনেমার গানে সুর দেওয়ার পাশাপাশি হিন্দি, মালায়লাম, তামিল সহ অনেক ভাষার গানে তিনি সুর প্রদান করেছেন। যে সমস্ত বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি সুরারোপ করেছেন তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল- পাশের বাড়ি (১৯৫২), একদিন রাত্রে (১৯৫৬), গঙ্গা (১৯৬০), কিণু গোয়ালার গলি (১৯৬৪), মজিনা আবদুল্লা (১৯৭৩)। গানগুলি হল-
    ১) ঝির ঝির ঝির বর(ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পাশেরবাড়ি)
    ২)  এই দুনিয়ায় ভাই (মান্না দে , একদিন রাত্রে)
    ৩) আমায় ভাসাইলি রে  (মান্না দে, গঙ্গা)
   ৪) দক্ষিণা বাতাসে(সবিতা চৌধুরী,কিনুগোয়ালার গলি)
   ৫) বাজে গো বীনা ( মাণ্ণা দে , মজিনা আবদুল্লা)
   ৬) বুঝবে না (লতা মঙ্গেশকর, কবিতা)।
      প্রায় ষাটটির বেশি হিন্দি চলচ্চিত্রে সুরও দিয়েছেন সলিল চৌধুরী। তার মধ্যে কয়েকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল-
      ১) আজারে পরদেশি ( লতা মঙ্গেশকর, মধুমতি)
      ২) সুহানা সফর ( মুকেশ, মধুমতি)
      ৩) ইতনা না মুঝসে তু (লতা ও তালাত মেহমুদ,ছায়া)
      ৪) জিন্দেগী ক্যায়সে (মান্না দে, আনন্দ)
      ৫) কোই হোতা জিসক আপনা ( কিশোর কুমার, 
           মেরে আপনে)
      ৬) অন্যায় দিল কাহা তেরি ( দ্বিজেন মুখার্জী,মায়া)
      ৭) গঙ্গা আয়ে কাঁহাসে (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কবুলি-
          - ওয়ালা)
      ৮) জানেমন জানেমন (আশা ভোঁসলে ও জেসুদাস)
          ইত্যাদি।
   পরিশেষে বলা যায় সলিল চৌধুরী শুধু বাংলা নয় সমগ্ৰ ভারতবর্ষের সঙ্গীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার বহুমুখী প্রতিভার প্রশংসা সঙ্গীত প্রিয় মানুষেরা আজও করে থাকেন। সমসাময়িক বড় বড় সঙ্গীত শিল্পী, সুরকার ও গীতিকারদের মধ্যে তিনি একেবারে ব্যতিক্রম। সবদাই নতুনত্বের স্বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি ‌।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন