দোঁহা

নিশি-ডাক


অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

অনেক রাত্তিরে অশোকের ঘুম ভেঙে যায়। সে বিছানার উপর উঠে বসে। পাশের ঘর থেকে সে কোনো আওয়াজ পায় না। সে নিশ্চিন্ত হয়। শ্রাবন্তী ঘুমোচ্ছে। হাজার হোক সামনের সপ্তাহেই তার যাওয়ার তারিখ। সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়তে যায়। তারপর কী মনে হতে সে উঠে বসে আবার। তেষ্টা পেয়েছে। একটু জল খাওয়া দরকার। সে খাট থেকে নামে। শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে খাবার ঘরের দিকে যায়। জানালা দিয়ে সে দেখে পূর্ণিমা-রাত। এক মায়াবী নীল আলোয় তাদের ঘরগুলো কেমন স্বর্গীয় মনে হয়। সে অনুভব করে জ্যোৎস্নার আলোয় তাদের ঘর ভেসে যাচ্ছে। শ্রাবন্তী ঘরে নেই। ঠিক যে ভয়টা পাচ্ছিল অশোক।

 এতদিন কেটে গেছে। তবু এতকাল পরেও। কেন যে অশোক এই নিয়ে ভয় পাচ্ছিল সে জানে না। তবু তার আশঙ্কাই সত্যি হল। এরপরেও সে শ্রাবন্তীর ঘরে যায়। তার কাজের জায়গাটা ঘুরে-ফিরে দেখে। ছাদের দরজা এপার থেকে বন্ধ। সদর খুলতে গিয়ে অশোক দেখল উপরের ছিটকিনিটা নামানো। আর ভুল নেই। শ্রাবন্তী এই পথেই বেরিয়েছে। সে হাতকাটা গেঞ্জির উপর গরম শার্টটা চাপিয়ে নেয়। শেষ কার্তিকের শান্তিনিকেতন। বাতাসে ঠাণ্ডা ভাব। রাস্তায় নেমে সে জোরে পা চালায়। হাতের স্মার্টওয়াচ বলছে রাত তিনটে বাজতে দশ। আকাশে এখনও জ্যোৎস্না। যদিও চাঁদ অনেকটাই পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। অশোক জানে কোথায় গেলে শ্রাবন্তীকে পাওয়া যাবে। সে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়‌।

 পাড়টা খাড়াই নেমেছে অনেকদূর। বিস্তীর্ণ নাবাল জমি সামনে। কোপাই নদীর পাড়। নদীতে জল কমে এসেছে। এই জায়গাটা স্থানীয় লোক ভিন্ন তেমন কেউ চেনেনা। শ্রাবন্তী পাড়ের একেবারে শেষপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্বেতপাথরের মূর্তির মতো। অশোক দূরে দাঁড়িয়ে ধাতস্থ হতে খানিক সময় নেয়। তার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসে। এবারে এগোনো যায়। “টুকুন,” শ্রাবন্তীর পিঠে হাত রাখে অশোক। শ্রাবন্তী চমকায় না। সে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষরাত। এক অবাক জ্যোৎস্না-ধোয়া নিস্তব্ধতায় ওরা দু’জনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কেউ কোনও কথা বলে না।

 “বাবা।”

“তোর ঘরে গিয়েছিলাম।” অশোক বলে।

 “টিকিটগুলো দেখলে?” ওরা কেউ জোরে কথা বলে না।

“দেখলাম।”

 কোপাইয়ের খাত বেয়ে একটা শিরশিরে বাতাস বয়ে যায়। ওরা আবারও চুপ করে থাকে। শ্রাবন্তীর পিঠে এখনও অশোকের হাত। ওর কাঁধের উপর আলতো চাপ পড়ে। “বসবি?” অশোক শ্রাবন্তীকে জিজ্ঞেস করে।

 “তোমার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে বাবা?” অশোকের হাত ধরে শ্রাবন্তী। দু’জনে বসে পড়ে অসমান জমির উপর।

 সেই রাত। এখনও স্পষ্ট মনে আছে তার। এখানেই ওরা ছুটে এসেছিল। তবু অনেকটা দেরী হয়ে গিয়েছিল তখন। নীচের পাথরগুলোর উপর ভরা বর্ষার সময় ছাড়া জল থাকে না। মাথা নীচু করে সেগুলোর উপরেই ঝাঁপ দিয়ে পড়ে, কত অনায়াসেই না সবটুকু যন্ত্রণার অবসান ঘটানো যায়।

 “সেই রাতের চেয়েও, আগের দিনের সন্ধ্যেটা ভুলতে আমার কষ্ট হয় বেশি।” শ্রাবন্তী বলে ওঠে হঠাৎ। অশোক ওর হাতের উপরে হাত রাখে। “আমরা কেউ তো ভাবিনি, ওভাবে ওইদিনই তোর মা হঠাৎ বেরিয়ে চলে যাবে। কেমোর সুযোগটা অবধি নিল না একবার।” অশোকের গলায় শান্ত ভাব। “মা ঠিকই বুঝেছিল ক্যানসারের ধরণ। মা জানত ওভাবে অথর্ব হয়ে বেঁচে থাকাটা মা সহ্য করতে পারবে না। তাই,” শ্রাবন্তী চুপ করে যায়।

 “আমাদের ভুল হয়েছিল।” শ্রাবন্তী বলে আবার। “আগের দিন রাতেও, আমরা শুধু চেঁচামেচিই করে গেলাম।”

 কতশত অবসাদ, কাটাকুটি এসে মেশে। ডাঃ বিনোদিনী গুহ চেয়েছিলেন মেয়েকে ডাক্তারি পড়াবেন। মাথা উঁচু করে তাঁর মেয়ে একদিন বিদেশ থেকে নামী সার্জনের শিরোপা মাথায় নিয়ে ফিরে আসবে। ডাঃ গুহের সংসার সাজানো হলেও সুখের ছিল না। অশোক ছবি আঁকত। ডাকাবুকো ডাক্তারের সঙ্গে প্রেম জমলেও সংসার জমেনি। ডাঃ গুহ মনে করতেন তাঁর স্বামী ক্রমশ মেয়েকে আর্টের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। সেই নিয়ে বিবাদ-অশান্তি, ঝামেলা। কমবেশি লেগেই থাকত সবসময়। ক্যানসার ধরা পড়ার পর কেমোথেরাপি শুরু হওয়ার আগের দিন – আবারও সেই নিয়েই কথা কাটাকাটি, বাদানুবাদ। ডাঃ গুহ বুঝেছিলেন চিকিৎসায় ফল হবে না। অবসাদ তাঁর শরীর ও মন ছেয়ে ফেলেছিল। অনেকদিন। তারপর,

 এতগুলো বছর।

 শ্রাবন্তী ডাক্তারি পাশ করেছে। এমনকি স্নাতকোত্তরের প্রবেশিকা পরীক্ষাতেও সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই বিলাসপুর যাবার কথা রয়েছে তার। সিআইএমএস বিলাসপুর, এমডি (জেনারেল মেডিসিন)। মেধাতালিকায় সেখানে তার নাম সবার উপরে। কিন্তু তার ঘরের টেবলের উপর ছড়ানো-ছিটনো পাসপোর্ট। ভিসার কাগজপত্র। অশোক থমকিয়ে দাঁড়ায়। আবারও সেই কোপাই নদীর পাড়।

 “আমি শুধু ভাবছি তুই পারলি কী করে?” আমস্টারডাম ইউনিভার্সিটিতে আর্ট হিস্ট্রির কোর্স। আবারও নতুন করে জীবন শুরু করবে শ্রাবন্তী। “আমি মা’কে কথা দিয়েছিলাম। মা যা চেয়েছিলেন আমি করব। কিন্তু তারপর। জীবনটা সাজাব আমার মতো করেই।” অশোক আর শ্রাবন্তী সামনের দিকে তাকায়। “আমি কথা রেখেছি।” অশোক মাথা নাড়ে। “তুমি কতদিন গাও না বাবা,” মেয়ে বলে। অশোক চোখ বোজে। হয়তো বিনোদিনীকে মনে করতে চায়।

 “এখনো গেল না আঁধার, এখনো রহিল বাধা,

এখনো মরণ-ব্রত জীবনে হল না সাধা,

কবে যে দুঃখজ্বালা হবে রে বিজয়মালা,

ঝলিবে অরুণরাগে নিশীথরাতের কাঁদা …”

অশোক গাইছে। জ্যোৎস্নালোকিত কোপাই-বন।

শ্রাবন্তী নীচে তাকিয়ে দেখে শুকনো চড়ার উপর এক ঝাঁক কাশ ফুটে আছে। এখনও। এই কার্তিকেও।

শেষরাত্রের পূর্ণিমা-আলোয় তারা দুইজনে দেখে চারিদিক কেমন ফুটফুটে হয়ে আছে। এতটুকুও হাওয়া বইছে না।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন