দোঁহা

শেকল ভাঙার স্বপ্ন

 


শুভজিৎ দত্তগুপ্ত  

পাহাড়ঘেরা গ্রামের ভেতর এক সরু কাঁচা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে রজনীর বাড়ি। ছোট্ট খোলা উঠোনে ঝরে পড়া শালপাতা, বোনের হেসেখেলে দৌড়ঝাঁপ—সবই যেন সাজানো ছবির মতো। কিন্তু সেই ছবির ভেতরেই লুকিয়ে আছে তীব্র বেদনা। রজনীর বয়স কেবল কুড়ি পেরিয়েছে, অথচ তার চোখে জমে আছে অজস্র ক্লান্তি।  

পড়াশোনা করতে চাইলে রজনীকে শোনা যেতে হতো—“মেয়েদের এত পড়াশোনার দরকার নেই। রান্নাঘরই তাদের আসল জায়গা।” বিয়ের চাপও আসতে লাগল বারবার। কিন্তু রজনীর বুকের ভেতরে অন্য এক আগুন জ্বলছিল। সে শুনেছিল, শহরে কিছু মেয়েরা স্কুল খুলেছে, নিজেরা কাজ করছে, এমনকি জমির দখল নিয়ে লড়াইও করছে। সেই খবর তার স্বপ্নকে আরও বড় করে তুলেছিল।  

একদিন গ্রামে এক সংগঠক এলেন। তিনি বললেন, “অধিকার চাইতে হয়, ভিক্ষা করে নয়, লড়াই করে।” এই কথাগুলো রজনীর বুকের ভেতরে বজ্রপাতের মতো বাজল। রাতের পর রাত সে ভেবে চলল—কেন শুধু জন্মের কারণে তার জীবন বাঁধা পড়বে? কেন সে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবে না?  

শুরু হল তার ছোট্ট সংগ্রাম। গ্রামের মেয়েদের একত্র করে রজনী বলল, “আমাদেরও অধিকার আছে। আমরা কাজ করব, জমি চাষ করব, স্কুলে যাব।” প্রথমে ভয় ছিল সবার চোখে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ভয় রূপ নিল সাহসে। একদিন যখন গ্রাম সভায় রজনী দাঁড়িয়ে বলল, “আমাদের জমির ভাগ চাই, আমাদের কণ্ঠস্বর শুনতে হবে”—তখন সবার মুখে স্তব্ধতা নেমে এল।  

পুরুষেরা হাসল, বিদ্রুপ করল, কিন্তু সেই হাসির ভেতরেই ধাক্কা খেয়ে জেগে উঠল প্রতিবাদের ঢেউ। রজনী জানত, লড়াই সহজ হবে না। কিন্তু সে আরও জানত, এই লড়াই শুধু তার নিজের নয়—এটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মুক্তির পথ।  

সন্ধ্যার অন্ধকারে আকাশের দিকে তাকিয়ে রজনী ফিসফিস করে বলল—  
“শেকল যতই শক্ত হোক, ভাঙতে হবেই।” 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন