দোঁহা

প্রাচীন ফসল : নতুন ভাবনা।

 


সুমি দত্তগুপ্ত

২০২১ সাল acid reflux এ জেরবার আমি গিয়েছিলাম একজন gastroenterologist এর কাছে। তিনি বললেন,এটা লাইফ স্টাইল disease। তাই আপনাকে খাদ্যাভ্যাসে ও পরিবর্তন আনতে হবে। নো কার্বস লিখে দিলেন প্রেসক্রিপশন এ। ভাবছি,কি জ্বালা,আমরা তো কার্বস দিয়েই পেট ভরি,থালা সাজাই।  রোজ কার্ব না খেয়ে ,অনেক সবজি,মাছ,মাংস,ডিম,কিংবা salad দিয়ে  পেট ভরানো মধ্যবিত্ত  পরিবারে অসম্ভব।,কারণ আমরা এখনও ভাবতে পারি না,আমি খাব,পরিবারের বাকি সদস্যরা দেখবে। তাই মুখ দেখে ডাক্তার বললেন,রাগী খান,ফাইবার বেশী,আপনার সমস্যা মিটবে।

 বন্ধুদের কাছে শুনেছি,দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে শিশুদের, ডাক্তাররা সেরেল্যাক বা নেস্টাম খাওয়াতে একেবারেই বারণ করেন, তার বদলে রাগী এবং কলা দিয়েই তার সিরিয়াল খাওয়ার অভ্যাস শুরু হয়।

মিলেট এর প্রকারভেদ রয়েছে। প্রধান মিলেটের মধ্যে রয়েছে জোয়ার,বাজরা,রাগী। আর অপ্রধান মিলেটের মধ্যে রয়েছে কাওন,শ্যামা চাল আর পোষাকী মিলেটের মধ্যে রয়েছে কুট্টু,চাওলাই ইত্যাদি।
 

কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায়,হরপ্পা সভ্যতায় আমরা জোয়ার,বাজরা খাদ্য শস্য হিসাবে প্রচলিত ছিল। আমাদের বৈদিক সাহিত্যেও মিলেটের বর্ণনা পাওয়া যায়। মৌর্য যুগের ইতিহাসের আকর গ্রন্থ কৌটিল্যের অর্থ শাস্ত্র,কিংবা মুঘল যুগে আবুল ফজলের আইন ই আকবরী তে ,ও দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন সাহিত্যেও মিলেটের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। ভারতবর্ষের এই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ফসল আধুনিক ভারতীয়দের খাদ্যতালিকায়  এতদিন হারিয়ে গিয়েছিল কোনও অজানা কারণে।

আমাদের বাংলায় একাদশীর দিনে অনেকেই কাওন বা শ্যামা চাল খেয়ে থাকেন। তাই কাওন,শ্যামা চাল আমাদের কাছে অপরিচিত নয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে আমরা অমরান্থের উল্লেখ পাই। হালফিলের মধ্যপ্রদেশ,বিহার, ছত্তিশগড়ে অমরান্থের , বা রাগীর লাড্ডু বা মোয়া খুব ই জনপ্রিয়। মিড ডে মিলেও এখন এই মোয়া বাচ্চাদের দেওয়া হয়। অমরকণ্টক এলাকার মন্দিরগুলোতে ও কিন্তু প্রসাদি হিসেবে এই মোয়া দেওয়া হয়।

বর্তমান বিশ্ব যে স্থূলতা এবং সেই সংক্রান্ত ডায়াবেটিস ,হার্টের সমস্যায় ভুগছে ,সেই সমস্যা মুক্ত হতে গেলে উচ্চ ফাইবার যুক্ত খাদ্য ,খাদ্যতালিকায় রাখা প্রয়োজন। যা সহজে হজম হবে  অনেক ক্ষণ পেট ভরা থাকবে ,এবং খাদ্যে শর্করা বৃদ্ধি কম হবে। ডায়েটিশিয়ানেররা তাই বলে থাকেন ।  গর্ভাবস্থার আগে ও পরে  মায়ের ও সন্তানের পুষ্টি, ও সম্পূর্ণ খাদ্য হিসেবে মিলেট এর গ্রহণযোগ্যতা অনস্বীকার্য ।

 আজকের পরিবর্তিত পরিবেশে , আমরা যেখানে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নয়,গ্লোবাল বার্নিং এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি,সেখানে পরিবেশ বান্ধব ফসল চাষে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।  মিলেট ম্যান অফ ইন্ডিয়া খদ্দর ভাল্লে যিনি শুধু পরিবেশবিদ নন,একজন কৃষক ও বটে। তিনি বলেন ,কম জল, ও উচ্চ তাপমাত্রায় এই ফসলের চাষ  যুগোপযোগী। 
 

২০২৩ সালকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক বাজরা বর্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে দেশে,দেশে বাজরা চাষকে জনপ্রিয় করে তুলতে চেয়েছে। মাটির ক্ষয় রোধ করে, এবং নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ,উন্নত মাটি গঠন করে ,পরিবর্তিত জলবায়ু তে খরা প্রতিরোধী , পরাগ আনয়নে সহযোগী , এবং তার ফলে বাস্তু তন্ত্রের খাদ্য,খাদক সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রেখে পরিবেশ বান্ধব ফসল হিসেবে বাজরা চাষের প্রয়োজনীয়তা  কৃষক বন্ধুদের বোঝানো এতদিনে সম্ভব হয়েছে।

এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিলেট এখন ভারতবর্ষেই চাষ হচ্ছে। ওড়িশা,ঝাড়খণ্ড,উত্তরপ্রদেশ,মধ্যপ্রদেশ,রাজস্থান,কর্নাটকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এ এখন মিলেট চাষ হচ্ছে।

শরীরের প্রয়োজনে ,জলবায়ুর পরিবর্তনে, খাদ্যের অপর্যাপ্ততার কারণে ,পুষ্টির গুণাগুণ ,ক্যালসিয়াম,আয়রন চাহিদা মেটাতে প্রান্তিক মানুষজনের কাছে মিলেট এর কার্যকারিতা আর ও ভালোভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন। কারণ তাদের দৈনন্দিন পেট ভরাবার খাবার হতে পারে মিলেট,অর্থবানের সৌখিন প্যালেট হওয়ার চেয়ে সেটা বেশি জরুরি।

 মানবসভ্যতার আদিতে যে ফসলের জন্ম,সেই ফসল তাহলেই প্রভূত সম্ভাবনাময় ফসল হিসেবে যে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে, তার যথার্থ প্রয়োগ,এবং সার্থকতা মানুষের দরবারে স্বীকৃত হবে।

  


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন