দোঁহা

ম্যাজিক-এ-মশালা

 


সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

–"হুঁঃ! একে তো বউ রাঁধেনা! তা আবার তপ্ত আর পান্ত!" 
মুখে দিয়েই পাস্তা আর কোল্ড-কফির ট্রেটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ব্যঙ্গ করে বলে ওঠেন করুণাময়ী। 
–" বুড়ির মাথাটা একদম গেছে গো! নতুন নাতবৌ রেঁধেছে। একটু ভালো বললে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো শুনি!" 
ফুঁসে ওঠে কাজের মেয়ে বাসন্তী। 
–"উঁহ্! সারাদিন যায় আলে-ডালে/ ধান শুকাবে চাঁদের আলে!কাজ ফেলে এখন হাঁ করে কথা গিলতে বসেছেন উনি!!"
শ্লেষ ঝরে পড়ে কিরনময়ীর কথায়। 
বাসন্তীও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। শুরু হয় তুমুল বাক-বিতন্ডা।এদিকে প্রমাদ গোনে জয়া। নতুন বৌমা কি ভাবছে কে জানে! সত্যি বাপু! বুড়ির কথার বড়ো জ্বালা! ঠিক এই কারণেই শাশুড়ীকে কোনো দিন আপন করতে পারেনি সে। 

আসলে সমস্যা কিন্তু অন্য জায়গায়। একসময় ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন করুণাময়ী।ভেবেছিলেন তাঁর সোনার-চাঁদ নাতির জন্য ডানা-কাটা পরী আনবেন। কিন্তু বিধি বাম। সে সাধ আর মিটলো কই! নাতি পছন্দ করে নিয়ে এসেছে ছোটখাটো শ্যামলা এই মেয়েটিকে। বৌমা জয়া কেও ছেলে পছন্দ করেছিল। বৌ, নাতবৌ দুটিই যে মনের মতো হয় নি তাঁর। 
–"এত বৌ লম্বা বেগুন গাছে আঁকশি দেয়!" তাঁর ছ'ফুট এক ইঞ্চির নাতির পাশে সাকুল্যে পাঁচের নাত-বৌ দেখে ব্যাজার মুখে গজগজ করে যান। 

যা'হোক সমস্যার সমাধান করে তিন্নি নিজে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দিদি-শাশুড়ীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, 
–"রাগ কোরো না ঠাম্মি! তোমার কি পছন্দ বলো আমি বানিয়ে দেব।"

–"হ্যালো গাইসজ্! ওয়েলকাম টু মাই ব্লগ 'তিন্নির রান্না-বান্না'। আজ দেখো আমি কি বানিয়েছি! আমার দিদি-শাশুড়ির খুব প্রিয় একটি পদ। আর এতে এ্যাড করেছি এক সিক্রেট 'ম্যাজিক-এ-মশালা'! যাতে টেস্ট হয়েছে জাস্ট ফাটাফাটি! কি আছে এই মশলায় আর কোথা থেকে পেয়েছি এই রেসিপি জানতে হলে পুরো ভিডিওটি দেখতে ভুলোনা কিন্তু! আর খাওয়া শেষে ঠাম্মি কি বলবে তাও দেখাবো তোমাদের। তাই শেষটা একদম মিস কোরোনা তোমরা।" 
তিন্নি ভিডিও করে যায় আর সাথে বকে চলে। কি যে আজকাল 'হ্যালো গাইসজ্' হয়েছে বোঝেনা জয়া।   

তিন্নি আজ ঠাম্মিকে সারপ্রাইজ দেবে। এই বিশেষ রান্নাটি ঠাম্মির মা নাকি দারুণ বানাতেন। মাসি-ঠাম্মি থাকেন গ্রামে। তাঁকে ফোন করে ঠাম্মির পছন্দের এই রেসিপি যোগাড় করে বানিয়েছে মেয়েটা। 
দুপুরে খেতে বসেন করুণাময়ী।
–"কেমন লাগছে ঠাম্মি?"
পরিবেশনের কিছুক্ষণ পর দুরু-দুরু বুকে জিজ্ঞাসা করে তিন্নি। কিরণময়ী চুপচাপ খেতে থাকেন। কোনো উত্তর দেননা। টান টান উত্তেজনা। ফলাফল কি হতে চলেছে জানা নেই। খাওয়া শেষে গম্ভীর মুখে উঠে যান। আলমারি খুলে কিছু একটা বের করে দু'হাত পিছনে রেখে এগিয়ে যান তিন্নির দিকে। সোনার কঙ্কণ-জোড়া পরিয়ে দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে সুর করে বলে ওঠেন–
"রান্না তোমার খাসা! 
(যেন) মায়ের ভালবাসা! 
গুনবতী কণ্যে, 
কাঁকণ তোমার জন্যে।"
নিজের চোখকে বিশ্বাস হয়না জয়ার। তার বিশ্ব-নিন্দুক শ্বশ্রূমাতা কিনা নাত-বৌ এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ!
–"মা! ব্যাপারটা কি হলো? আপনার তো নাত-বৌ পছন্দ ছিল না!", ফিসফিস করে শুধায় জয়া। 
–"আরে চুপ করো বৌমা! তিন্নি শুনতে পাবে যে!"
–"তা মা! তিন্নি যে দেখতে--"
–"আঃ বৌমা! ওর কতো গুন! ওপরে চাকুণ চিকুণ/ভেতরে ভস্কা বেগুন নিয়ে লাভ আছে কিছু! এতদিন পর মাকে মনে পড়ে গেল গো আমার!" দু'চোখ ভরা জল নিয়ে উত্তর দেন কিরণময়ী। যাক বাবা! মধুরেণ সমাপয়েৎ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচে জয়া। এত বছরে জয়া যা পারেনি করে দেখায় তিন্নি।

আ-র-
গা-ই-স-জ্! 
দেখলে তো জীবনের ম্যাজিক-এ-মশালার গোপন উপকরণ কিন্তু একান্তই আন্তরিকতা, ভালবাসা আর সযতনে লালিত সম্পর্কের উষ্ণতার অনুভূতি। যার সংযোজনে জীবন নামক পদটি পরম উপাদেয় হয়ে ওঠে।
ব্লগটি দারুণ ভাইরাল হয়। তিন্নির রান্না, সাথে করুণাময়ীর ছড়া-কাটা দারুণ উপভোগ করে সবাই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন