অরূপ সরকার
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় কিছু পঙক্তি বাংলা কবিতার পাঠক পাঠিকাদের ব্যাপক অংশের মুখে মুখে ফেরে। কোনো কোনো সমালোচকের ধারনা পূর্ববঙ্গের সাম্প্রতিক কবিদের লেখায় অন্যান্য পূর্বসুরীর তুলনায় জীবনানন্দের প্রভাব সর্বাধিক। জীবনানন্দ দাশের লেখা বাংলা ভাষার জনমুখী প্রয়োগের নতুনতর উত্তরনের জন্য আদৃত। তাঁর লেখা 'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থ ঘিরে পাঠক পাঠিকাদের ব্যাপক কৌতুহল। তা একদিন উপগাথার মত এক লৌকিক প্রতীক গড়ে তুলবে হয়ত। এই প্রসারিত পটভূমি জীবনানন্দের বিস্তারিত পরিচিতির দাবিদার নিশ্চয়।
বাংলা কাব্যে জীবনানন্দের উত্থান নজরুলের সমসাময়িক। মানুষের জয়গানে মুখর প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর কালের আধুনিক যুগে তাঁর লেখার হাতেখড়ি। যে 'বঙ্গবাণী' পত্রিকাতে শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবী' প্রকাশিত হয়েছিল সে পত্রিকাতে জীবনানন্দ দাশের দীর্ঘ ঘোষণাপন্থী কবিতাটি ছাপা হয়েছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর তিনি আরোও উদাত্ত কবিতা লিখেছিলেন, এই যুগ যখন ব্যাপক উৎপ্রেক্ষার পরে গভীরাশ্রয়ী হল, তিনি আরও গভীর সুরে কথা বলতে প্রবৃত্ত হন। নজরুল যখন গজল ও গীত রচনা করেছেন, তখন জীবনানন্দ রূপকথার মালমশলা নিয়ে লিখতে শুরু করলেন। জীবনানন্দের কবিতায় জীবন বিমুখতা ছিল না। এটা আসলে জীবনের নতুন দর্শন। তাঁর মধ্যে কখনোই প্রাণ প্রাচুর্যের অভাব ছিল না। বহু কবিতাই তার সাক্ষ্য দেয়।
হাওয়ার রাত, সিন্ধু সারস এর দৃষ্টান্ত স্বরূপ।
সুর হল তাঁর কবিতার প্রাণ। লৌকিক বাংলা কবিতার সুরে বিংশ শতাব্দীর সাধারণ মানুষের পদাবলী লিখেছেন জীবনানন্দ দাশ। তিনি যে গদ্য কবিতা লিখেছেন তাও একই গ্রামে বাঁধা। সাধু ক্রিয়াপদ আর গ্রামীন কথা মালা হয়ে সুরের তটিনী তে ভেসে চলেছে। বেশ কিছু বর্বর শব্দ আছে। কিন্ত সব পেলব হয়েছে লেখার সুরের ঝংকারে।
জীবনানন্দের এই সুরের পক্ষপাতীরাই একসময়ে ব্যতিক্রম দাবি করে বসেন। সেই দাবী মেটাতে গিয়ে তিনি ইচ্ছাকৃত বেসুরো কবিতা লিখেছেন, 'সাতটি তারার তিমির' যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। শেষের দিকে তিনি এই ব্যাতিক্রমের ধারাবাহিকতা কে বহাল রেখেই। নিয়ে এসেছিলেন নতুনতর দর্শন।
জীবনানন্দ শ্রেষ্ঠ কবিতার ভুমিকায় লিখেছেন, আমার কবিতাকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যায়িত করা হয়েছে, কেউ বলেছেন এ কবিতা প্রধানত সমাজ চেতনার, ইতিহাস ও প্রকৃতির। অন্য মতে এ কবিতা অবচেতনার, সুরিয়ালিস্ট। এ সবই আংশিক সত্য, সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা নয়। তিনি দেশ কাল পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত ও আক্রান্ত। মানুষের জীবন পতন ও উত্থানের ইতিবৃত্ত তিনি ছিলেন মানব পথিকের অন্তহীন যাত্রার দরদি সঙ্গী। তাঁর নিজের কথাতেই এই স্বীকৃতি আছে।
"'সে অনেক রাজনীতি রুগ্ন নীতি মারী
মন্বন্তর যুদ্ধ ঋণ সময়ের থেকে
উঠে এসে পৃথিবীর পথে আড়াই হাজার
বছর বয়সী আমি"
এখানে উল্লেখযোগ্য জীবনানন্দের সমাজ চিন্তা ও রাজনৈতিক চেতনা প্রথমে জাতীয়তাবাদ চিন্তার অনুসারী। 'বিবেকানন্দ' হিন্দু মুসলমান, 'দেশবন্ধু' কবিতায় তিনি এদেশের জাতীয়তাবাদের ধারার উদ্দীপনা কে প্রকাশ করেছেন। এসব নজরুল ও অন্যান্য কবিদেরও প্রিয়।
বিবেকানন্দ ও দেশবন্ধু, নজরুলের কাছে চিরন্তন মহামানব। জীবনানন্দের চিন্তনে এ ধারা খুব স্বল্পক্ষণ স্থায়ী। এরপর তিনি মানব জাতির ভূগোল এ প্রবেশ করেছেন স্বজাতি ও স্বদেশের সীমা অতিক্রম করে। তাঁর মাথার ভেতর যে বোধ কাজ করে তা মানুষের জীবন সমস্যার ক্লান্তি শূন্যতা এবং অপূর্ণতা।
ক্রৌঞ্চের মত উপলব্ধির একাত্মতাই রসোত্তীর্ণ কবিতা। এ বিষয়ে আধুনিক যুগে জীবনানন্দ ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অনন্য। এঁরা এক একটি কবিতা ও শব্দের পিছনে অকল্পনীয় সময় ব্যয় করেছেন। এই সময় ব্যয় কে কখনোই অপব্যয় ভাবেন নি। বলা বাহুল্য তারা রচনায় পরিমানের থেকে গুণকে মুল্য দিতেন বেশি।
জীবনানন্দের কবিতার কাঠিন্য হল এলিয়ট বর্ণিত কাঠিন্য। তিনি তাঁর কবিতার অনেক লাইন শূন্য রেখে যান। তা পূরণের দায়িত্ব পাঠকের, তা পাঠক দের দেয় এক সাহিত্য মন্থিত অভিজ্ঞতা।
(ক্রমশ)