দোঁহা

প্রচ্ছন্ন-অপ্রচ্ছন্নের কবিতা: সতীন্দ্র অধিকারীর নিজস্ব আশ্রমে

 


সব্যসাচী মজুমদার

দেখুন বাংলা ভাষা এবং প্রতিবেশে এমন কিছু জাদু আছে যাদের সন্নিবেশ কখনও বাস্তবতা ভাবতে দেয় না। তাকে ক্রমাগত পরাবাস্তবের দিকে ঠেলতে থাকে। কিংবা যে বাস্তবে যেতে পারিনি কখনও, যাব বলে ভাবিওনি সেইসব অদূরবর্তী শব্দের সন্ধান করে যায় বাংলা কবিতা অনিবার। একটি অনিবার্য কাজ তার। সঙ্গে লিরিক থাকবে। মানে, স্বরের উচ্চাবচতায় সে পাঠকের সঙ্গে আলাপ করবে পাঠের পরবর্তী প্রহর জুড়ে। তাদের অনুরণন জুড়ে থাকবে আপনার সমাজ বাস্তবতা-পরাবাস্তবতায়। আজকে এরকমই এক তরুণ কবির গ্রন্হ পাঠ করতে চলেছি যাঁর কাব্য ভাষায় আমাদের সমজীবনের স্বর ও স্বরান্তর মিশে আছে।

বাঁকুড়া জেলা থেকে লিখছেন সতীন্দ্র অধিকারী। জেলা কথাটা নির্দিষ্ট করার একটি বড় কারণ, সতীন্দ্রের কবিতা। নিবিড় পাঠে দেখা যায় স্হানিক ভূগোল কিভাবে আবহমান চিহ্নগুলোকে বহন করে নিয়ে চলেছে ভূগোল নিরপেক্ষ পাঠকের জন্য,

"শুধু অভ্যাসবশত এখনও তাকিয়ে থাকা জানালার দিকে। কবেকার জীর্ণ চামড়ার হাসিখানি স্বর্ণ চাল, দু' এক পয়সা...

অথচ কতদিন হয়ে গেল আজ। গাঁয়ে গাঁয়ে আর হাপু বলতে আসে না কেউ

দৃশ্য হয়। উৎসব ভেসে ওঠে খেজুরের রসে..."(হাপু)

এই চিহ্নগুলোই তো বাংলা কবিতার শরীর তৈরি করে। মানে, বলতে চাইছি, এই হাপুর জন্য আক্ষেপ, এই খেজুরের রসের দৃশ্য, আপক্কের ভাষা, এই রোমান্টিক প্রক্ষেপ আর রোমান্টিক থাকে না, বরং এগিয়ে এসে এই বাংলার, হাহাকারের বাংলায় দুটো একটা ক্ষিদের হারিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে দিয়ে বড় অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।

পড়ছিলাম সতীন্দ্র অধিকারী প্রণীত 'উৎসের অক্ষর বীজ' নামক কাব্যগ্রন্থটি এবং এই কাব্যেরই আরেকটি কবিতা উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করব পূর্বে রচিত কথা কয়টির সমর্থনে,
 
"আমাদের কথারা খরচ হয়ে গেছে কবে। একাকার ভেসে ওঠা আঘ্রাণের খেজুরের রস

শুধু অভ্যাসবশত এই বেঁচে থাকা!

আজীবন যা রোদ্দুরের মতো অন্ধকার... দ্বিতীয় চোখ গাঁয়ের হাবু মোড়ল জানে—

ধানের ক্ষেতে কতবার সিয়াত করতে হয় আমাদের!" (গ্রামকথা)

মজাটা এখানেই 'সিয়াত' শব্দের অর্থ আপনি জানেন না। এই আলোচকও নয়। আর শব্দার্থ দিয়ে বুঝতে গেলে কবিতার সঙ্গে যাওয়া যাবে না কিছুদূর। কবি শব্দটিকে এমন আসনে বসিয়েছেন যে তার গায়ে সমস্ত আলো এসে পড়ছে। আর স্হান নিরপেক্ষভাবে কৃষক সমাজ বুঝে নেয় শব্দটির গুহ্য ইঙ্গিতটিকে।

এভাবে স্হানবিন্দুকে ব্যবহার করে ভাষাকে ইঙ্গিতময় করে তোলার প্রবণতা খুব বিরল নয়। কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বটে। কেননা সতীন্দ্র এই গ্রন্হে আশ্বাস স্হাপন করছেন ঠিক সেই যাপন বৃত্তান্তে, সম্পূর্ণ সাজানো লিরিক্যাল জাদু প্রবণতায়। ডিসটোপিয়ায় দাঁড়িয়ে একজন বাঙালি মানুষের এই বর্ম বিস্ময়কর বটে। সে ফেটে পড়ছে না বরং অনিবার্যদের হারিয়ে যাওয়াটাকে বলছে, তৈরি করে দিচ্ছে তার যাপনবাসনা,

"তবু কেন অবসাদ বলো! দু'চোখময় নির্দিষ্ট কোনো স্থান নেই জেনে

মায়ের পিছু পিছু

ভেসে ওঠা কবেকার উপস্থিতি তরকারি লাগা এঁটো বাসন, সার্ফের অভাবে কাদামাটি...

আর আমার হাতে গড়ে ওঠা কালী প্রতিমা। এখন রাত হয় আগের মতো...

সাজিয়ে দি পিঁড়ে

শান্ত হবেন বরুণ দেব।"  (অসুখ :তিন)

লক্ষ্য করুন পাঠক, 'সার্ফ' শব্দটির ব্যবহার। আসলে তো ডিটারজেন্ট। কিন্তু সেই কবে প্রথম বাঙালি সার্ফ কোম্পানির ডিটারজেন্ট ব্যবহার করেছে, কিন্তু আজও অন্য কোম্পানির ডিটারজেন্ট ব্যবহার করলেও তার 'সার্ফ' হিসেবেই চিহ্নিত। কনজিউমারিজমের কী নিদারুণ নমুনা! এবং একই সঙ্গে ভাবুন, এমন একটি পরিবেশে সতীন্দ্র শব্দটিকে রাখলেন, যেখানে বাসন মাজার জন্য মহার্ঘ্য সার্ফ কোম্পানির ডিটারজেন্ট পাউডার ব্যবহার করা অসম্ভব। খুবই সস্তা কোম্পানির পাউডারের অভাবও যখন সার্ফে মুখ ঢেকে পরিবেশিত হচ্ছে, নিদারুণ ডার্ক কমেডি তৈরি করে। আপনার একই সঙ্গে মনে পড়ে শঙ্খ বাবুর সেই অমোঘ বিজ্ঞাপনের কবিতা।

আবার ক্রমশঃ কবিতাটির শেষের দিকে আসুন, কালী প্রতিমা-পিঁড়ে আর বরুণ দেবের শান্ত হওয়া লোকাচারের টোটেম গড়ে তুলে নাগরিক প্রবণতার স্বস্তি চায়। কবি এই ক্রমে অবয়ব পাল্টে ফেলা প্রকৃতির ভেতরেও কিন্তু আরেকটি অবস্হানের কথা বলছেন। যে অবস্হানে পৌঁছতে গেলে এই প্রচলিত বাস্তবতাকে অস্বীকার করতেই হবে, আক্ষরিক অর্থে পূনর্নিমাণ না ভেঙে আরেকটি নির্মাণের দিকে যেতে হয়।
যেমন এই কবিতাটি-

"এখনও রাত হলে

রান্নাঘরের দিকে দাঁড়িয়ে থাকতে

দেখি মাকে... আর কবেকার ভেঙে চুরে যাওয়া মুখগুলি

সত্যি!

এখন আর নিয়তির কথা মেনে নেওয়া ছাড়া কিছুই পারি না আমরা

মাঠের পর মাঠ জুড়ে

অলৌকিক হেমন্তের এই চলে যাওয়া টুকু!" (অসুখ:আট)

হেমন্তের চলে যাওয়াটুকু দেখতে পাওয়ার ভেতরে কী অসীম চেতনা শক্তি প্রয়োজন, তা, আপনি, হেমন্ত হারিয়ে যাওয়া বাংলায় অনুমান করতে পারছেন। একটা ঋতু লোপাট হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে লোপাট হয়ে যাবে আমন।আমন শব্দের সঞ্চার। কেবল নিয়তি হিসেবে নিই এক অলীক রান্নাঘরে বন্দী লোকায়ত। আত্মভুকের অবয়ব থেকে কবিসত্তা দেখতে পায় লক্ষীবর্ণের বিলোপন আর  নিজের মাংস রান্নার স্বাদে ও সংকটে তুলে ধরে সম্ভাব্য আশ্রয়। যে চলে যাচ্ছে তাকে আঁকড়ে ধরে সম্পৃক্ত করতে চায় সতীন্দ্র তার সংকলনে। সব কিছু স্হান পায় না অবশ্য।পায় কিছু কিছু অনিবার্য প্রশ্ন ও প্রস্তাব,

"আমাদের একটাই খাট।

আমি শুয়ে পড়লে বাবা মাদুর পাতেন বারান্দায়

আর বাবা শুয়ে থাকলে

আমি।

খাট ও মাদুর কিম্বা

মাদুর ও খাট

আমাদের ভীষণ রকম দাউ দাউ অর্থনীতি!" (খাট)

কাব্যগ্রন্হটি পাঠকের আদর পেলেই সার্থক হবে এই পাঠ প্রতিক্রিয়া।



প্রকাশক যাপনচিত্র 
প্রচ্ছদ প্রশান্ত সরকার 
দাম ৫০ টাকা

2 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন