অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
“... that all faiths, religions, creeds and such other institutions became in turn the mere supporters of the tyrannical and exploiting institutions, men and classes. Rebellion against king is always a sin, according to every religion.” [‘Why I am an Atheist’, Bhagat Singh, Published Posthumously in September, 1931]
গতানুগতিক চলচ্চিত্র সমালোচনা বলতে যা বোঝায়, তা লিখতে বসিনি। বরং বলা যেতে পারে এ এক অনুভূতির সফর। জেরোম লরেন্স ও রবার্ট ই লি’র নাটক ‘ইনহেরিট দ্য উইন্ড’ অবলম্বনে নির্মিত ছবি ‘এ হোলি কনস্পিরেসি’র বিষয়ে দু’চার কথা আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে হলো। ২০১৯এ মোদী সরকারের বিরুদ্ধে খোলা চিঠিতে নিজেদের মতামত প্রকাশের জন্য সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও নাসিরুদ্দিন শাহের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা রুজু করা হয়। ‘এ হোলি কনস্পিরেসি’কে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এই ছবিটি যেন বা তারই জবাব হিসেবে নির্মিত। এই ছবির মাধ্যমেই কুশীলব দুজন, তাঁদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন বর্তমান ভারতের অবস্থাকে। দ্বর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করতে চেয়েছেন বর্তমান সময়ে যে অবিজ্ঞান ও অবৈজ্ঞানিক মানসিকতার ক্রমাগত প্রচার, তার বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানকে। ‘ইনহেরিট দ্য উইন্ড’ নাটকটিও সেই কথাই বলতে চেয়েছিল, আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে, ১৯৫৫ সালে যার প্রথম মঞ্চায়ন।
১৯২৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি প্রদেশে কুখ্যাত ‘মাঙ্কি ট্রায়াল’এর পরিপ্রেক্ষিতে, জেরোম লরেন্স ও রবার্ট ই লি’র কলমে রচিত হয় সেই কালজয়ী নাটক ‘ইনহেরিট দ্য উইন্ড’, বাংলায় এই বিশেষ প্রসঙ্গটির এক সুন্দর অনুবাদ রয়েছে। কলকাতারই অশোকনগর নাট্যআননের তরফে এই একই নাটক অবলম্বনে মঞ্চস্থ হওয়া বাংলা নাটক ‘অ-পবিত্র’এরই শেষ অংশের একটি সংলাপে তার প্রতিধ্বনি শোনা যায় – যেখানে বিবাদী পক্ষের উকিল হেনরি ড্রামন্ডের মুখে উচ্চারিত হয়, “মনে রেখো! তুমি অ-পবিত্রতার উত্তরাধিকার!” ১৯২৫এর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বের বিপরীতে ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ানোকে খ্রিস্টীয় ধর্মগুরু ও রক্ষণশীল রাজনীতিকেরা পাপকর্ম বলে মনে করতেন। এক স্কুলশিক্ষক তার ছাত্রদেরকে সেই সময় বিবর্তনবাদ পড়ানোর চেষ্টা করলে, স্থানীয় পাদ্রীর উসকানিতে তাকে জেলে ভরা হয়। সেই বিচারই ‘মাঙ্কি ট্রায়াল’ নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। অন্ধবিশ্বাসের বিপরীতে যুক্তি ও বিজ্ঞানের যে যুগ যুগান্তের লড়াই, তারই এক অন্যতম মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায় টেনেসির এই বিচার। সেই অবলম্বনেই মূল নাটক ‘ইনহেরিট দ্য উইন্ড’, অথবা বাংলায় ‘অ-পবিত্র’, ও আজ শৈবাল মিত্রের সিনেমাতে ‘এ হোলি কনস্পিরেসি’র উদযাপন।
কিছু কিছু নাটক কালজয়ী হয়ে ওঠে। যেমন কিনা সোফোক্লেসের ‘আন্তিগোনে’, অথবা শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’, কিংবা ইবসেনের ‘এ্যান এনিমি অব দ্য পিপল’, ঠিক তেমনই এই নাটক ‘ইনহেরিট দ্য উইন্ড’। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে, আজকের পরিপ্রেক্ষিতে যার অসামান্য সুন্দর গল্পকে ‘এ হোলি কনস্পিরেসি’র মাধ্যমে দারুণ ভাবে প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয়েছেন পরিচালক। বিশেষ ভাবে, আজকের ভারতবর্ষে সংখ্যাগুরু রাজনীতিকদের তরফে যে ভাবে এক অদ্ভুৎ ভারতীয় স্বর্ণযুগের অবৈজ্ঞানিক সমস্ত চিন্তাকে, প্রচারকে বলপূর্বক সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কলেজে-বিদ্যালয়ে সেই আকাশকুসুম বৈদিক বিজ্ঞানের নামে চরম অবিজ্ঞান অথবা অপবিজ্ঞানকেই পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে, সেই কথাই এই ছবিতে প্রাঞ্জল ভাবে উঠে এসেছে। এছাড়াও কেমন ভাবে সেই সংখ্যাগুরুর বক্তব্যকে সাধারণের উপর চাপিয়ে দিতে গিয়ে এক আরও অদ্ভুৎ ‘সামঞ্জস্য নীতি’র আলোকে দেশের বহুত্ববাদকেই সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হচ্ছে, আদিবাসীদের নিজস্ব সত্ত্বাকে সম্পূর্ণ ভাবে অবদমিত করে তাদেরকে ‘হিন্দু’ বলে চালানোর যে নোংরা প্রচার করা হচ্ছে, এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদেরকেও একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে – এই ছবি তারই কথা বলতে চেয়েছে। এই প্রসঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও নাসিরুদ্দিন শাহ ভিন্ন আর কারোকেই বোধহয় এমন দুটি চরিত্রের জন্য নির্বাচন করা যেত না। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো আড়াই ঘণ্টা সময় কাটিয়েছি।
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল রূপোলী পর্দাতে সৌমিত্র ও নাসিরুদ্দিনের এই প্রথম ও এই শেষ মঞ্চ ভাগ করে নেওয়া। কেন যে এর আগেও কখনও, কেউ এমনটা করবার কথা ভাবেননি সে আমাদেরই দুর্ভাগ্য। কিন্তু সমস্ত সময় জুড়েই এই দুইজন মানুষের আশ্চর্য সাবলীল অভিনয়, অসাধারণ সংলাপ এই সিনেমাকে যেন এক আলাদা মাত্রাতে তুলে নিয়ে গিয়েছে। রেভারেন্ড বসন্ত চ্যাটার্জি’র চরিত্রে সৌমিত্র’র অভিনয় দেখতে দেখতে ‘গণশত্রু’র কথা মনে পড়ছিল। যদিও এক্ষেত্রে তিনি ধর্মভীরুদের পক্ষে, বাদী পক্ষের উকিল হিসেবেই অভিনয় করেছেন। জীবনের শেষ কয়েকটি ছবির মধ্যেও যে এভাবে অলৌকিক প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটানো সম্ভব তা তিনিই প্রমাণ করলেন। অন্যপ্রান্তে বিবাদী পক্ষের উকিলের চরিত্রে অনবদ্য নাসিরুদ্দিন। এই দুইজনের প্রতিটি তীক্ষ্ণ সংলাপে, প্রতিটি যুক্তি ও পালটা যুক্তির সংঘর্ষে বারংবার উঠে আসতে চেয়েছে আজকের ভারত। ধর্ম ও রাজনীতির নামে যে চূড়ান্ত বর্বরতা ও অশিক্ষার প্রাদুর্ভাব ঘটে চলেছে – তারই অসহায় উপাখ্যান। রূপোলী পর্দার এই সমস্ত সংগ্রামকেই যে আদতে আজ বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে আনতে হবে। নয়তো সেই গোমূত্রের ভারতেই আমাদের ভবিষ্যৎ।
এই ছবির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি তার সংলাপ ও অভিনয়। পার্শ্বচরিত্রেরা সকলেই দুই বিরাটাকায় প্রোটাগোনিস্টের পাশেও নিজেদের জাত চিনিয়েছেন। রেশমির চরিত্রে অমৃতা চট্টোপাধ্যায়, সাংবাদিকের চরিত্রে কৌশিক সেন, শিক্ষক কুণাল বাস্কের চরিত্রে শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়, এঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের সাবলীল অভিনয়ে সিনেমাটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। এরই পাশাপাশি কোর্টরুমের সওয়াল-জবাব চলাকালীন প্রতিটি সংলাপ আমাদেরকে আলাদা করে ভাবতে বাধ্য করেছে, যার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে শৈবাল মিত্রের প্রাপ্য, এই ছবির যিনি একাধারে পরিচালক ও সংলাপ রচয়িতা। কেবল চোখে পড়ে বলতে, স্কুল ভাঙচুরের দৃশ্যটিকে সরাসরি দেখানোরই বোধহয় খুব একটা প্রয়োজন ছিল না। বিশেষ ওই কয়েক সেকেণ্ডের অংশটিকে একটু যেন খাপছাড়া মনে হয়েছে। এছাড়াও রাতের হিল্লোলগঞ্জকে দেখাতে গিয়ে একই অংশের নৈশকালীন ড্রোন ফুটেজের একাধিকবার ব্যবহার একটু হলেও চোখে পড়েছে। সবশেষে কুণাল বাস্কে’র মতো একজন কখনই হিন্দুনেতা বাবু সোরেনের কথায় ‘ঘর ওয়াপসি’র মতো একটি কর্মসূচীতে শামিল হবে বলে মনে হয় না। এই প্রসঙ্গটিকেও একটু অন্যভাবে দেখানো যেত বলে মনে করি।
কিন্তু এই সবকিছুকে মনে রেখেও বলব, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই ছবির প্রয়োজনীয়তা ছিল সবচেয়ে বেশি। ‘অ-পবিত্র’ নাটক অথবা ‘হোলি কনস্পিরেসি’র মতো সিনেমা আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ভীষণ, ভীষণ ভাবে দরকার হয়ে পড়েছিল। কিছুকাল আগে একটি প্রবন্ধে লিখেছিলাম, “মানুষকে বুঝতে হবে মানুষের সবচেয়ে বড় অবদান মানুষ ও মনুষ্যত্ব। ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেননি, মানুষই ঈশ্বরভাবনার জন্ম দিয়েছে। অবাঞ্ছিত ধর্মবিশ্বাস অথবা অপ্রয়োজনীয় ধর্মভীরুতাকে হাতিয়ার করে যদি কোনও দল বা গোষ্ঠী রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ক্ষমতা দখলে সক্রিয় হয়ে ওঠে, তবে সবচাইতে আগে তারই বিরোধিতা করা প্রয়োজন। আমরা কি খাব, কি পরব অথবা কি পড়ব, তা কোনও আকাশচারী ঈশ্বরের এক্তিয়ারভুক্ত নয়। মানুষই কেবল নিজেদের অক্ষমতা দেখাতে, অথবা দুর্বলের ক্ষমতা জাহিরের প্রয়োজনে এমন একেকটি ধারণাকে সৃষ্টি করেছে।” এই সিনেমাতেও সেই একই সংলাপ কুণাল বাস্কের মুখে মূর্ত হয়ে উঠেছে, “উচ্চবর্ণের মানুষেরা তাঁদের স্বার্থ চরিতার্থ করবার প্রয়োজনেই এক প্রতিহিংসাপরায়ণ ঈশ্বরের জন্ম দিয়ে থাকে।” সেই ঈশ্বরকেই আমরা ভজনা করতে বাধ্য হই। প্রবন্ধের শুরুতে ভগৎ সিংয়ের বিখ্যাত উক্তিটিতেও সেই একই বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটেছে। এমন ঈশ্বর-ধারণাকে আমরা মানতে অস্বীকার করি। বিজ্ঞান ও যুক্তি ভিন্ন আধুনিক সমাজে আর কোনও কিছুরই অস্তিত্ব নেই।
যদিও, বারংবার মূল নাটক, তার বাংলা অনুবাদ অথবা এই সিনেমাটিতেও এই বক্তব্যটিই ফুটে উঠতে চেয়েছে যে – প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভাবনার অধিকার আছে, নিজস্ব চিন্তার অধিকার আছে। সেই থেকেই বহুত্ববাদের জন্ম হয়। বিকশিত হয় বিবিধের সৌন্দর্য। বহুত্বেই আমাদের দেশের সার্থক প্রকাশ, ও তার দেশভাবনার উদযাপন। সামঞ্জস্য চাপিয়ে দেওয়া যায় না। আমাদের এই লড়াই অপবিজ্ঞান ও অবিজ্ঞানমূলক প্রচারের বিরুদ্ধে। মানুষের বিশ্বাস মানুষের কাছে থাকুক। সে সযত্নে তার আচার-বিচারকে লালিত করুক। কিন্তু ‘রাস্তায় বেরুলে সংবিধানই একমাত্র অধিকার!’। নাটক ‘অ-পবিত্র’এ বাদী ও বিবাদী দুই উকিলের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন যথাক্রমে অসিত বসু ও সব্যসাচী চক্রবর্তী। সিনেমাতে এই দুই চরিত্রেই অভিনয় করেছেন যথাক্রমে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও নাসিরুদ্দিন শাহ। সাংবাদিকের চরিত্রে মঞ্চে ও পর্দাতে অভিনয় করেছেন যথাক্রমে চন্দন সেন ও কৌশিক সেন। এঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের নিজস্ব পরিসরে নিজেদেরকে উজাড় করে দিয়েছেন। বারংবার, ২০১৪ পরবর্তীতে, দেশের এই চরম সংকটের সময়ে এমন একেকটি সৃষ্টির মাধ্যমেই জারি হয়ে থেকেছে ফাসিস্তদের বিরুদ্ধে লড়াই, বিজ্ঞাননির্ভর যুক্তিবাদী শিক্ষাব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার লড়াই। এমনকি সিনেমাতে এসে যা সরাসরি ফুটিয়ে তুলেছে – আদিবাসী জনতাকে নিজেদের নগ্ন রাজনৈতিক স্বার্থের প্রয়োজনে ব্যবহার করার যে একের পর এক নীচস্য নীচ উদাহরণ – তারও বিরুদ্ধে লড়াই, এই ভাবনাকেই। মানুষের আছে বিরুদ্ধ চিন্তার অধিকার। রয়েছে নাস্তিকতা ও আস্তিকতা উভয়েরই অধিকার। কিন্তু সবচেয়ে বেশি করে যা রয়েছে, তা হলো প্রশ্নের অধিকার। যাচাই করে নেওয়ার অধিকার। যুক্তির অধিকার। মনের ভিতরেই গুনগুনিয়ে তাই, বেজে ওঠে হঠাৎ -
"Ring the bells that still can ring
Forget your perfect offering
There is a crack, a crack in everything
That's how the light gets in"…(Leonard Cohen)
কেবলই আলো আসুক, প্রয়োজনে তা আসুক আজ ঈশ্বরেচ্ছার বিরুদ্ধেও!