দোঁহা

মুর্শিদী

 


দীপিতা চ্যাটার্জী

ব্যস্ততা আর প্রযুক্তি, এই দুইয়ের সমন্বয়ে যে আধুনিকতার সৃষ্টি হয়েছে তাতে এক যান্ত্রিক জীবনযাপন করে চলেছে মানব জাতি। এই শহুরে বহুতল ও দূষণে দমবন্ধ হওয়া মন এখনো চায় মাটির স্বাদ নিতে। মাটির এক অদ্ভুত গন্ধ আছে, টানও আছে। ছোট থেকেই মন-টা গ্রামবাংলার মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ায় বাউল হয়ে। এখনো ঠিক সেভাবেই এই মন বাউল হয়ে যায় বাউল গানে ডুবে থেকে। একবার একটা গান মনে খুব দাগ কাটে। গানটা হয়তো অনেকেরই জানা আবার অজানাও বটে।

‘মুর্শিদ ধন হে কেমনে চিনিব তোমারে’

বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের এই গান শুনে অন্তহীন স্তব্ধতায় বিলীন হওয়া যায়। চিন্তা করতে বাধ্য করায় এমন গানের অন্তর্নিহিত অর্থ। শতাধিক বছর আগে ১৯১৬ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সিলেটের সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের একটি এলাকা দিরাই, সেই দিরাইয়ের উজানধল নামক গ্রামে একটি অতি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই খিদের যন্ত্রণা নিয়েই বড় হয়েছেন, দেখেছেন অর্থনৈতিক বৈষম্য। মাত্র আটদিন ব্রিটিশদের নৈশ বিদ্যালয়ে পাঠ নিয়েছিলেন তিনি। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গুজব রটানো হয়   বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ব্রিটিশ বাহিনী-তে যোগদান করে যুদ্ধ করতে হবে। এই আশঙ্কায় সবার সাথে তিনিও বিদ্যালয়  ছেড়েছিলেন। কিন্তু নিজের প্রচেষ্টায় আর সাধনায় যতটা সম্ভব ততটা পড়াশোনা শিখেছিলেন। শাহ আব্দুল করিমের মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল তিনি পড়াশুনা করুক। কিন্তু তাঁর বাবা কঠোর ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা চিনতো বলেই তাকে কাজ করার পরামর্শ দেন পরিবারের স্বার্থে। তখন তিনি রাখাল বালকের কাজ করেন। কিন্তু তাঁর গানের ও সুরের প্রতি প্রচন্ড ঝোঁক ছিল। খুব ছোটবেলা থেকেই সংগীতের শিক্ষা নেন গুরু বাউল শাহ ইব্রাহিম মস্তান বকশের কাছে। গান লিখতেন ও মাটির সারান্দি বাজিয়ে বাজিয়ে গান করতেন নিজের মতো আর সহকারীদের শোনাতেন। এভাবে সেই পড়াশোনা আর বাস্তবতা কে কাজে লাগিয়ে প্রায় দেড় হাজার গান রচনা করেছিলেন। এভাবেই গাইতে গাইতে ভাটিঅঞ্চলের অন্যতম বাউল ও গণ মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠলেন শাহ আব্দুল করিম।

বাংলাদেশ একটি নদী মাতৃক দেশ। এদেশের মানুষ তাদের দেশকে ধানের ও গানের দেশ বলেই মনে করেন। তেমনিই একজন ছিলেন শাহ আব্দুল করিম। তিনি কালনী নদীর তীরে বসে গান লিখতেন। ছিলেন মনে প্রানে বাউল। কিন্তু বাউল বলতে কি বুঝি আমরা? নির্দিষ্ট এক ধারায় গান গেয়ে বেড়ানো একতারা হাতে। কিন্তু এই বাউলও যে আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ হতে পারেন, প্রগতিশীলতার চর্চা করতে পারেন, গণমানুষের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হতে পারেন তা বোঝা যায় তাঁর গান এর মধ্যে দিয়েই। তাঁর গানের মধ্যে ফুটে ওঠে দেহতত্ত্ব, দর্শন, ভক্তিমূলক, বৈষম্য, সাথে প্রেম বিরহ ও বিচ্ছেদের কথা। তিনি ফকির লালন সাঁই, দূরবীন শাহ, রামধরণ এমন অনেকের গানেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

অসাম্প্রদায়িক এই বাউল গানের মধ্যে দিয়ে সাম্য ও মানবাধিকারের কথা বলেছেন।এর ফলে তাঁকে অনেক কষ্ট সহ্য  করতে হয়েছিল। তাঁর ওপর নেমে এসেছিল ফতোয়া। ঈদের জমায়েতে, জুমার নামাজে বারবার তিরস্কার করা হয়েছিল। তাঁর গান বন্ধ করার জন্যও অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেই সময় বাউল গানের শত্রু থেকে ভক্তকুল বেশি ছিল আসর শুনলেই মাইল মাইল দূরে থেকে লোকজন আসতো গান শুনতে। তাই গান বন্ধ করা অতটা সহজ হয় নি। তাঁকে এই গানের জন্য গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল একসময়ে। তাঁর প্রানপ্রিয় স্ত্রী সরলা ও শিষ্য আকবরের মৃত্যুর পর জনাজা পড়াতে চাননি তৎকালীন মসজিদের ইমাম। এতে তিনি খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। তিনি নিজের স্ত্রীকে মুর্শিদ বলে গণ্য করতেন।

ঐতিহ্য ও আধুনিকতার যে সংমিশ্রণ তিনি করেছিলেন এতো বছর আগে, তা সত্যিই ভাবায় বর্তমান সমাজকে। এক অজ পাড়াগাঁয়ে বসে দরিদ্রতার চরম সীমায় পৌঁছেও তাঁর এই ধরণের চিন্তাশক্তি জানান দেয় দূরদর্শিতার কথা। এই ধারায় তিনি লিখেছিলেন,

“আমি কুলহারা কলঙ্কিনী। আমারে কেউ ছুঁয়ো না সজনী”।

এই গানটিতে কৃষ্ণপ্রেমে পাগলিনী রাধার কষ্ট সমকালীন হয়ে উঠেছে। এভাবেই তিনি তাঁর গান ও সুরের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন সাম্প্রতিক সমাজ ও প্রাচীন প্রেমের ধারায়। অন্য সব বাউলদের থেকে আলাদা ছিলেন তিনি। উনি গনসংগীত লিখেছেন যা বাকি বাউলদের থেকে পাওয়া যায় না। এমনিই একটি গান,

“মনের দুঃখ কার কাছে জানাই ভাবি তাই, গরীব বাঁচবে কেমন করে”

কতটা সহজ সরল কিন্তু অর্থবহুল এই গান। সত্যিই তো গরীবদের দুঃখ কষ্টের কথা কেই বা জানতে চায় আর কেই বা কিছু করে তাদের জন্য। নাড়া দিয়ে যায়, ভাবায় মন'কে বারবার এমন গান। চেতনার পরতে পরতে এক চিন্তনের নকশা কেটে রাখে। এভাবেই গানের মাধ্যমে তিনি ভাটিঅঞ্চলের দুঃখ কষ্টের কথা সবাইকে জানিয়েছিলেন। এমন সব গান শিক্ষিত বিশেষজ্ঞ দের কাছেও বিস্ময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের অধ্যাপক ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীর কথায়, ‘ভাষা আন্দোলন নিয়ে ওনার গান আছে। তিনি তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে যে গণ চেতনা প্রকাশ করেছেন তা সত্যি অন্যরকম ঘটনা। তার প্রেমের গান গুলো ও অকৃত্রিম'।

 


তিনি দেহতত্ত্ব কে বেশি ভালোবেসেছিল। তিনি মনে করতেন এই দেহের মাঝেই সব আছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘যা নেই দেহ ভান্ডে, তা নেই ব্রহ্মান্ডে’। তিনি একদিকে ছিলেন ভক্তিবাদী, অন্যদিকে যুক্তিবাদী। তিনি ভক্তিকে যুক্তির নিরিখে বিচার করে নিতে পছন্দ করতেন। বলতেন, দেহতত্ত্বের সাথে দেহ শব্দটি আছে আর দেহ তো শরীর মাত্র। যার মধ্যে আছে চক্ষু, কর্ণ এই সব। শরীর নিয়ে তিনি সব বুঝতেন বলে লোকে তাকে পীর মানত। তিনি চিরাচরিত তত্ত্ব গানকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন। দেহতত্ত্বের গানকে উপস্থাপন করেছেন আধুনিক অনুষঙ্গ গাড়ির প্রতীক রূপে। তিনি লিখেছিলেন,

 ‘গাড়ি চলে না চলে না চলে না রে’। চড়িয়া মানব গাড়ি যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি।'

এমন সব গান কে বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর অন্যতম শিষ্য রুহি ঠাকুর বলেছিলেন, তিনি দেহ'কে গাড়ির সাথে তুলনা করেছিলেন। আর বন্ধুর বাড়ি অর্থে স্রষ্টা বা পরম ঈশ্বরকে বুঝিয়েছিলেন। তিনি শুধু গাড়ি নয় নৌকার সাথেও দেহ কে তুলনা করেছিলেন।
তিনি অসাম্প্রদায়িক  সংস্কৃতির প্রতি ছিলেন আস্থাশীল। তাঁর ছোটবেলার অসম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর সাথে বর্তমানের সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন কে তুলনা করে দুঃখ পেয়েছিলেন। ওই বেদনা কে তার গানের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন এইভাবে, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। গ্রামের নও- যোয়ান হিন্দু- মুসলমান/ মিলিয়ে বাউলা গান, ঘাটুগান গাইতাম/ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।  তিনি বলেছিলেন হিন্দু মুসলমানের দেশে গানের একটা দারুন পরিবেশ ছিল। তিনি এই বৈষম্য কোনই ভাবেই মেনে নিতে পারেন নি।

তিনি বিশেষভাবে কোন ধর্ম মানতেন না। তিনি মানুষে বিশ্বাসী ছিলেন। মানুষকে সম্মান করাই তাঁর ভেতরের ঈশ্বরের চরণে পুজোর সমান। হজযাত্রা বা মন্দিরে ঘুরে টাকা খরচের থেকে তিনি দুঃখী দারিদ্র মানুষদের সাহায্য করাটাই অনেক মহৎ কাজ মনে করতেন। তিনি মনে করতেন প্রচলিত সব ধর্ম ব্যবস্থাই সামাজিক বিদ্বেষ ও বিভেদের কারণ। এর জন্য মোল্লা ও পুরোহিত দের দায়ী করেছিলেন। যে ধর্মের জন্য ভাইয়ে ভাইয়ে বিভেদ সৃষ্টি হয় বিভাজন হয় সেই ধর্ম কে ধিক্কার জানাতেন। ওনার ধর্ম ছিল মানুষের সত্যতা ও অস্তিত্ব আর কিছু না। এমন মানসিকতা উদারতা চিন্তাশীল নির্লোভ বাউল মেলা দুষ্কর।  
তিনি ঈশ্বরকে সর্বশক্তি হিসেবে মান্য করতেন ব্যক্তি হিসেবে নয়। তিনি শূন্যকে সর্বশক্তি হিসেবে গণ্য করতেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ব্যক্তি কখনো একই স্থানে ভিন্ন রূপে ভিন্ন ভাবে অবস্থান করতে পারে না। শক্তি তা পারে। তবে তিনি অবাস্তব কিছুতেই বিশ্বাস করতেন না। যা দেখেন নি তা মানবেন কি করে এই ছিল তার বক্তব্য। তিনি লিখেছিলেন,

‘দেখা দাও না কথা কও না
আর কত থাকি দূরে।
কেমনে চিনিব তোমারে, মুর্শিদ শোনো হে’।

কি অসাধারণ ভাব ও যুক্তিপূর্ণ আবেদন। তিনি বলেছিলেন যার কোনো দিন দেখা পাওয়া যায় না তাকে চিনবো কি করে আমরা সাধারণ মানুষ। কেমন করেই বা মানব মুর্শিদ হিসেবে। ঈশ্বর হিসেবে তার সরল ও যুক্তিপূর্ণ বাক্য ছিল, ‘শুনি উনি আছেন। দেখি তো নাই কোনদিন।' ভাবের কোন স্তরে পৌঁছলে মানুষ এমন সব চিন্তা করতে। পরকাল উনি মানতেন না। দেহ হলো মাটির মতো, যা মাটিতেই মিশে যায়। সব শূন্য। শূন্যে গিয়ে মিলিয়ে যায়। এই সমস্তই গভীর চিন্তার নিদর্শন।
শিষ্য রুহি ঠাকুরের কথায় জানা গেছে, একবার সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন এক সভায়। তিনি যা বক্তব্য রেখেছিলেন তার সবটাই সুন্দর করে গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন শাহ আব্দুল করিম। সেই থেকেই বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচিতি তার। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তোমার মত শিল্পী কে উপযুক্ত মর্যাদা দেয়া হবে। শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে করিম ভাইও বেঁচে থাকবে।' কথা শিল্পী হুমায়ূন আহমেদ তার গান সম্পর্কে মূল্যায়ন করে বলেন 'ওনার গান প্রাচীন ও বর্তমান এই দুইয়ের সংমিশ্রণ। এভাবেই তার গান ধীরে ধীরে প্রচারিত হয় সমস্ত বাংলাদেশে ও পরে ভারত ও অন্যান্য দেশেও।' তাঁর প্রকাশিত বইগুলো  হলো: আফতাব সংগীত ( যা তিনি প্রানপ্রিয় স্ত্রী এর নামে নামকরণ করেছিলেন), গণসংগীত, কালনীর ঢেউ, ধলমেলা, কালনীর কুলে ও ভাটির চিঠি। ওঁনাকে নিয়ে অনেক বই প্রকাশ হয়েছে। ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। বাংলা একাডেমি তাঁর দশ টি গানের ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। এছাড়া পেয়েছিলেন নানা পুরস্কার ও সম্মাননা।

সম্পূর্ণ নির্লোভ, সৎ মানুষ টি সারাজীবন নিজের আদর্শ প্রচারেই আগ্রহী ছিলেন। নিজের গান বা লেখা নিয়ে অনেকে ব্যবসা করছেন দেখেও তিনি চুপ ছিলেন। কারণ সুর নাম না থাকলেও গানের কথার মধ্যে দিয়ে আদর্শ টা প্রচার হলেই তিনি খুশি। আর সেই আদর্শ হলো একদিন এই পৃথিবী বাউলের হবে।


 ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক ক্লিনিকে ফুসফুসজনিত রোগে মৃত্যু বরণ করেন শাহ আবদুল করিম।  জীবনের শেষ সীমায় এসে তিনি স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। দুই বাংলায় তিনি লোকগানের জাদুকর হয়ে ওঠেন। পূর্বে যারা তাকে গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছিল , যারা গানের বিরুদ্ধে ছিল, যারা ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়েছিল সবাই পরবর্তীতে ওনার জন্য গর্ব বোধ করেন।
 

তাঁর মৃত্যুর পর এতগুলো বছর কেটে গেল তবুও এখনো এ পৃথিবী বাউলের হলো না। এখনও বাউল কে গান গাইতে গেলে নির্যাতিত ও নিপীড়িত হতে হয় উগ্র মৌলবাদীদের দ্বারা। তাঁর আদর্শকে সম্মান জানিয়ে একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেখানে গানের মধ্যে দিয়ে আদর্শকে স্বাধীন ভাবে প্রসার করা যায়। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে দিয়ে তিনি যে দর্শন ও চিন্তাধারা প্রচার করেন তা চিন্তাশীলদের কাছে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। তিনি তাঁর সৃষ্টি  সুরের মধ্যে দিয়েই অমর থাকবেন আমাদের মাঝে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন