কৌশিক সেন
নির্বিকল্প সমাধির পর সভ্যতাকে বর্ণনাতীত করে তুলতে আমাদের একটি উপগ্রহ প্রয়োজন।অন্ততপক্ষে একটি। রক্তাক্ত হৃদয়ে জোয়ার আনতে একটি, কেতুর ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য একটি, ডিমলাইটের আলোয় ছন্দ মিলিয়ে পদ্য লিখতেও একটি উপগ্রহের প্রয়োজন। এমনকি বদ্ধ উন্মাদ হতে গেলেও একটি নাইটল্যাম্প জ্বালিয়ে রাখতে হয় শিয়রে...
ওসব কথা থাক, আসুন চাঁদের কথা বলি।
একটি আদর করবার চাঁদ, একটি ষোলোকলার আসমান, একটি কাকজ্যোৎস্নার মাখোমাখো অন্তর। নিরাভরণ দ্বীপে লাট্টু ঘোরাবার জন্য টুনিবাল্বের দরকার নাই, কিন্তু মাত্রাবৃত্তছন্দে নিখুঁত শিহরণ আনতে, একফালি মিষ্টিকুমড়োর মত চন্দ্রকলা অপরিহার্য। বাঁশবাগানের মাথার ওপর যদি তিনি উঠতে নাও পারেন, কবির মাথার ভিতর তাঁর উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী!
ছাড়ুন তো, চলুন চাঁদ নিয়ে বসি!
দোল পূর্ণিমা নিশি, নির্মল আকাশ...মৃদুমন্দ মলয় বাতাসে কেমন আঁশটে গন্ধ! পাশ ফিরে শুলে ভিজে যায় বেয়াদপ জ্যোৎস্নার জলে। বুড়িটা চরকা কাটা বন্ধ করে দিয়েছে বোধহয়। কই আওয়াজ পাইনা আজকাল! টেঁসে গেল নাকি! মধ্যমবর্গীয় মেঘেরা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। যা রূপ কোজাগরীর! আমিই ফিদা হয়ে যাই!
কি যে বলেন, আসুন চাঁদের কথা বলি।
তোমার জন্য শতরঞ্চি পেতে রেখেছি কতদিন। জানি, কবিতা আসে না এ পোড়া কলমে, তবু তো অস্তমিত উপগ্রহকে পাগলের মত ডেকেছি, কিশোরবেলার প্রেমিকার নাম ধরে! খাতা খুলে রেখেছি, কবে তুমি ঝাঁপিয়ে পড়বে এই বিক্ষত নশ্বরতায়! স্বপ্নের ভিতর রকেট উড়ে যাওয়ার সুপারসনিক আওয়াজে ঝাঁঝরা হয়ে গেছি, কিন্তু একদিনও কোনো রকেট নেমে আসেনি আমাদের একচিলতে ছাদে!
*
সেই কোন ভোরে উঠেই চাঁদা নিয়ে বসেছি। আরে দাদা, ভয় পাবেন না, চাঁদার রসিদবই নয়, জ্যামিতি বাক্সে থাকেনা, সেই চাঁদা। সূক্ষ্মকোণ, সমকোণ, স্থূলকোণ মেপে চলেছি ধরতি থেকে চন্দ্রিমা, থুড়ি, চন্দ্রমার দূরত্ব। মিষ্টি করে দু'এক ছটাক সরলরেখা টেনে দিচ্ছি নিখুঁত দুরত্বে।
বুঝে দেখুন, এবার কিন্তু চাঁদের কথা বলছি, সিরিয়াসলি!
মাছ কাটলে মুড়ো দেবো, ধান ভানতে কুলো দেবো, কালো গরুর দুধ দেবো...শোন পোড়ামুখো, তোকে জাস্ট লোভ দেখাচ্ছি! চাঁদের কপালে যদি সত্যিই টিপ দিয়ে যাস, তবে তোকে রাফেল কিনে দেবো, গড প্রমিস! একটা বিন্দি পরিয়ে যা মাইরি!
আরে ধৈর্য ধরে শুনুন তো, চাঁদের কথায় তো বলছি!
চান্দ সুরজ বহুত হল বস, এবার চামেলির কথায় আসি। হাঁ জী, সে ফুল জ্যোৎস্নায় ফোটে। সকলে ঘুমিয়ে পড়লে ডাক পাঠায়, জানলা দিয়ে...ডেকে নিয়ে যায় দো-মোহনার ঝিলে। তারপর লাশ ভেসে ওঠে দু-চারদিন পর। জ্যোৎস্নার আলোয় স্পষ্ট দেখেছি এসব।
হ্যাঁগো হ্যাঁ, চাঁদের কথাই বলছি বাবুরা!
চাঁদের হাসি বাঁধ ভাঙবার পর সেই বাঁধ পুনর্নির্মাণ করতে কয়েক জন্ম লেগে গেল। ঠিকেদার যে কত কুবেরের ধন ট্যাঁকে গুঁজলো, তার কোনো হিসাব নাই। ধরতাই ছেড়ে রাহু-কেতু এসে ভিড় জমালো মথুরা-বৃন্দাবনে। মেঘের ভিতর থেকে পদ্মকুড়ি তুলে ঘরে রাখলো মঙ্গলকাব্যের মিস কমলেকামিনী।
দেখুন, এসব সিরিয়াসলি চাঁদেরই কথা কিন্তু!
চাঁদ সুলতানা থেকে টিউশন ব্যাচের চন্দ্রিমা, সকলেই জেনে গিয়েছিলো, এ চাঁদুর দ্বারা কিস্যু হবেনা। চাঁদ দেখতে গিয়ে যাকে তাকে দেখে ফেললে ডাঁহা ফেল করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নাই। তাইতো এই চন্দ্রবদন ঢেকে রাখতাম গ্রহণের আঁধারে!
*
জানি জানি, এ শতক চাঁদের নহে।ধান কাটিবার হাতিয়ারটিকে প্রতিপদের চাঁদ ভাবিতে লাগিয়াছি ইদানিং। প্রশিতভর্তিকার দেশ হইতে কুকুর শৃগাল আনিয়া সমাবেশ করিলে দিব্যি জমিয়া ওঠে অমলজ্যোৎস্নার বনভোজন। ইহাতে আর যাহাই হউক, কাব্যরস জমিবেনা।
তবে বসিতে আজ্ঞা হউক, চন্দ্র লইয়া কিছু শোনাই!
আহা রুটি, ঝলসানো রুটি! ক্ষুধার রাজ্যে কি নিদারুণ মেটাফর! গদ্য লিখিতে গেলে এরূপ উপমা ব্যবহার এক গর্হিত কর্ম। আচ্ছা, পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি না হইয়া ক্ষুধার্ত বালকের ডেলিভারিকৃত পিজ্জাও তো হইতে পারিত! না, মানে ভাবিয়া দেখুন, পুরু করিয়া মজ্জেরেলা চীজ আর অরিগ্যানো ছড়াইয়া পরিবেশন করিলে, আহা বুদ্ধপূর্ণিমার চাঁদ চাটিয়া পুটিয়া সাবাড় করিব!
কাব্যি নয় গো, নির্ভেজাল গদ্য শুনিয়া যাও!
বড়ই সিক্ত। টুপটুপ করিয়া রস ঝরিতেছে। এমতাবস্থায় রক্তকরবীর শাখায় উড়িয়া আসিল গদ্যরূপি বায়স। কর্কশ কণ্ঠস্বর হইলেও উহার চক্ষু যেন চন্দ্রভাতির ন্যায় নির্মল। আহা, মরি যদি সেও ভালো!
আহা, বালাই ষাট, খামোখা মরিবেন কেন! আসুন, গদ্য শুনিয়া জীবন ধন্য করুন!
চাঁদ উঠিয়াছে, ফুল ফুটিয়াছে, কদমতলায় প্রেমিকযুগল ওষ্ঠমিলনে লিপ্ত। এই সুযোগে আসুন, চুলচেরা বিশ্লেষণ করিয়া বলি, সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত কোন চান্দ্রমাসে বিক্রমাদিত্য উপাধি লাভ করিয়াছিলেন। কোন তিথিতে আমার সেই মিতাক্ষরা নদীটি গাভীন হইয়া ওঠে, কোন মাহেন্দ্রক্ষণে একটি চন্দ্রসম্ভবা গদ্যের প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়!
*
'চাঁদ উঠেছিলো গগনে'...ভয় পাবেননা, গালিগালাজ করবো না মোটেই। রোদ্দুর যদ্দুর যায় যাক, আমার দৌড় ওই মসজিদ অব্দিই! গগনে যখন কাজের মাসীর মেজে দেওয়া খাগড়াই কাঁসার বগিথালাটা চকচক করে ওঠে, চাঁদবদনির তাথৈ নৃত্যের উপক্রম হয়, তখন আমিও নেচে উঠি। আহা, সেকি তুরীয় আনন্দ!
ওলো সই, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই চাঁদের কথায় কই!
নিলু মেসোর চন্দ্রারোহনের পর নাই নাই করে তিপান্ন বছর অতিক্রান্ত। কিন্তু বুড়িমায়ের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রসঙ্গটা নির্ঘাত চেপে গিয়েছিলেন মেসো। নইলে বুড়ো বয়সে নিজের নাপিতের বিরুদ্ধে মামলা করে বসেন! গরীব মানুষ, মেসোর চুল বেচে দু’পয়সা রোজগার করলই না'হয়! আর শুধু নিলু মেসোই বা কেন, শেফার্ড সাহেব তো সেখানে গিয়ে আর একা একা গল্ফ খেলতে পারেন না! বুড়ির কাছে গো-হারান হেরে সেই যে বাড়ি ফিরলেন, আর ওমুখো হলেননা!
না বাপু, বলছিতো কাব্যি করতে পারবনি, চাঁদের কথায় কইছি!
হ্যাঁ, যেকথা বলছিলুম, বুড়িমায়ের বেজায় দুঃখু। চোখের জল ফেলতে ফেলতে কইলো, সার্মন সাহেব আর হ্যারিসন সাহেব যেবার গেছিলেন, পাঁচটি ইঁদুর নিয়ে গেছিলেন। কি কিউট ছিল ইঁদুরগুলো! একেবারে বুড়িমায়ের পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াতো সর্বদা। বড্ড মায়া পরে গিয়েছিলো বুড়ির। রেখে যেতে পারতো! সাথে করে ফেরত নিয়ে আসবার পর বুড়ির সেকি কান্না! ঐযে, হলুদ রঙের জল পরে আঙিনা ভিজে যায় যখন, ওতো বুড়িমা এখনও ইঁদুরগুলোকে ভুলতে পারেনি, তাই!
বলছি বলছি, খুলেই বলছি সব কথা। চাঁদের কথাই...
নিশিরাত, বাঁকাচাঁদ আকাশে...এত চুপিচুপি বাঁশি বাজালে চলে! বুক ফুলিয়ে সকলের সামনে বাজাতে হয় মশাই! হুঁ হুঁ বাওয়া, সকলের কি আর চৌরাশিয়া সাহেবের মত বুকের পাটা আছে! আরে, বৃন্দাবনের কানাইয়েরই ছিল না! তবে হ্যাঁ, ছোকরাটা বাজাতো চমৎকার। আয়ান ঘোষের বেহায়া বউটা কেন, আমিই ফিদা হয়ে যেতাম!
*
দেখুন মশাই, দশটা না, পাঁচটা না, একটা মাত্র উপগ্গোহ পেয়েছি, একটু পাগলামি না করলে চলে! চাঁদের জন্মদিনে ভদকা খাবো আর ওড়না হয়ে বক্ষমাঝে লুটিয়ে থাকবো চিরটাকাল। ঠিকই বলেছেন বাবু, এ চাঁদ আসলে আমাদের কেষ্টপুরের কৃষ্ণকলিই বটে!
কি আর করি বলুন, চাঁদ ছাড়া কোনো গতি নাই যে!
আসলে মুশকিল বাড়িয়েছিলেন বাবু ডিএল রায় সাহেব। চাঁদের আলোতে ওঁনার আবার মরণের সাধ জেগেছিল। নাহ, অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে সে যাত্রা ওনাকে আটকেছিলাম। তারপর মনযমুনায় কত কত কিউসেক জল বয়ে গেছে, তার কি ইয়ত্তা আছে!
চাঁদ নিয়ে মাইরি বড্ড ইমোশনাল হয়ে পরেছি, বুইলেন!
ভেবে দেখুন, রাজার মেয়ে পারুল অথচ বেদের মেয়ে জোছনা! কেমন যেন আঁশটে গন্ধ পাচ্ছেন না! জোছনা কোমর দুলিয়ে বীণ বাজাবে, আর তালে তালে সাপ নাচবে আর আমরাও নাচবো। জোছনার সাথে রাজকুমারের আশনাই হবে, হেব্বি ক্যাচাল হবে। ব্যাপক ড্রামাবাজি! আহা, ও জোছনা যেন বেদেনীর মতই!
আচ্ছা, চাঁদ নিয়ে বড্ড বেশী বলছি নাতো! নেশা হয়ে গেছে নাকি!
জোছনা করেছে আড়ি, আসেনা আমার বাড়ি...ধুর বাবা, আপনার বাড়ি মরতে আসতে যাবে কেন, বরং আপনি যান না বাবা! এসব রাতে তো সবাই বনে যায়! চলুন না উৎসব করি, বনভোজনে মাতি, গান গাই মনের আনন্দে! দশটা নয়, পাঁচটা নয়, আফটার অল একলৌতা উপগ্রহ আমাদের!