সৌরনীল ঘোষ
আমরা যারা সিনেমা নিয়ে অল্প-বিস্তর চর্চা করে থাকি তারা সকলেই ক্রিস্তফ কিয়েস্লোফস্কির [১৯৪১-১৯৯৬] নাম শুনেছি। আন্দ্রে ওয়াইদার যোগ্য উত্তরসূরি, এবং পোল্যান্ডের বিখ্যাত ন্যাশনাল ফিল্ম স্কুল থেকে স্নাতক এই পরিচালক আন্তর্জাতিক সিনেমার আঙিনায় তার বিখ্যাত ডেকালগ সিরিজ এবং কালার ট্রিলজির জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
আজ তার ডেকালগ সিরিজেরই একটি ছবি নিয়ে কথা বলবো। তবে তার আগে ১৯৮৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিরিজটির একটি ছোট করে ভূমিকা করে নেওয়া যাক। টেলিভিশনের জন্য নির্মিত এই ডেকালগের প্রত্যেকটি ছবির সময়-সীমা মোটামুটি একঘন্টা, এবং সিরিজের দশটি ছবির সবকটিই বাইবেলে বর্ণিত টেন কমান্ডমেন্ট বা দশ ধর্মীও-বাণীর আধুনিক পরিগ্রহন। পরবর্তীকালে এই টেলিভিশন সিরিজের পঞ্চম ও ষষ্ঠ পার্টদুটি নিয়ে কিয়েস্লোফস্কি দুটি ফিচার ফিল্ম নির্মাণ করেন -যথাক্রমে – “A Short film about Killing”, এবং “A Short film about Love”.
আমাদের আলোচ্য ডেকালগের ষষ্ঠ পার্টকে বিস্তৃত করে নির্মিত ফিচার ফিল্ম – “A Short film about Love”.
স্রেফ যৌনতার বাইরেও “ভালোবাসা” বলে একটি জিনিসের অস্তিত্ব আছে যারা বিশ্বাস করে বা বিশ্বাস করতে চায় তাদের মুগ্ধ করবে মাত্র ছিয়াশি মিনিটের এই হাফ-সাইলেন্ট ছবিটি।
ধৈর্য্য, ত্যাগ, সহনশীলতা – শুধু একটিবারের জন্য তাকে দেখা, এই সমস্ত কিছুই কী তবে driven by lust? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ফ্রয়েড সাহেব যতই তার Civilisation & it’s Discontents বইতে প্রেমকে লিবিডোর sublimation বলে দাবী করুক না কেন, শারিরীক চাহিদাকে ছাপিয়ে যায় সত্যি কারের ভালোবাসার তীব্র আবেগ।
উনিশ বছরের তরুণ টোমেক জানলা দিয়ে টেলিস্কোপের মাধ্যমে উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে থাকা বয়েসে অনেক বড়ো ম্যাগডাকে দেখে – সে যখন কাজ থেকে ফেরে প্রতিদিন সাড়ে আটটার সময় টোমেকের ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। ম্যাগডার কাপড় চেঞ্জ করা, স্নান সেরে ভেজা চুলে বেড়োনো, পুরুষের সাথে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত যাপন – জানলা দিয়ে সমস্ত কিছু লক্ষ্য করে সে।
পোস্ট-আপিসে কর্মরত টোমেক ইচ্ছে করে মানি অর্ডারের চিঠি দিয়ে আসে ম্যাগডার নামে, যাতে ম্যাগডা একটি বারের জন্য পোস্ট আপিসে গেলে কাউন্টারে কর্মরত টোমেক তাকে আরেকটু বেশি সময়ের জন্য দেখতে পায়।
এরপর সে সত্যি সত্যিই একদিন ম্যাগডাকে বলে –“I Love You”!
অনেকটা বয়েস পেরোনো ম্যাগডা অনভিজ্ঞ কিশোরের কাছে জানতে চায়- “কী চাও?”, “আমাকে চুমু খেতে?”, “আমাকে শারীরিক ভাবে ভোগ করতে?”, “ভিতরে আসবে? ফ্ল্যাটে আমি একা।"
এই কী চাওয়ার উত্তরে টোমেক শুধু একটি শব্দ বলে –“Nothing!”
তার ফ্ল্যাটে বহু পুরুষ আসে এবং প্রায় প্রত্যেকের সাথেই রতি সুখে লিপ্ত হয় ম্যাগডা, তাই এরম একটা উত্তরে স্বভাবতই বিচলিত হয়।
তবুও হাল ছাড়েনা। টোমেকের সাথে ডেটে যাবার পর, তাকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে চেয়ারে বসিয়ে সিডিউস করার চেষ্টা করে , অনেক কষ্টে চেপে রাখার চেষ্টা করলেও টোমেক ম্যাগডার উরুর স্পর্শে উত্তেজিত হয়ে বীর্যপাত করে ফেলে প্যান্টে।
ম্যাগডা নির্লিপ্ত ভাবে জানায় –“ব্যাস!, এর মধ্যেই হয়ে গেলো? See That’s all there is in love. ভালোবাসা মানে এইটুকুই, নাও পাশের ঘরে তোয়ালে আছে”।
প্রচন্ড রাগের মাথায় অপমানিত হয়ে ছুঁটতে ছুঁটতে বেরিয়ে আসে টোমেক তারপর নিজেকে বাড়ির বাথরুমে লক করে হাতের শিরা কেটে ফেলে সে।
কেন শিরা কাটে টোমেক? ম্যাগডা তাকে সিডিউস করার কয়েক মুহূর্ত আগে জিজ্ঞাসা করেছিল –“তুমি যখন আমাকে টেলিস্কোপ দিয়ে অন্য পুরুষের সাথে যৌনতায় লিপ্ত হতে দেখো, তখন তোমার আনন্দ উত্তেজনা হয়?”
টোমেক জানায় প্রথম প্রথম হতো কিন্তু এখন সে এসবের উর্দ্ধে উঠে গেছে।
হয়তো ম্যাগডার প্রতি ভালোবাসাকে সে যৌনতার উর্দ্ধে স্থান দিতে চায়, হয়তো সে ম্যাগডার কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিল সত্যিই সে ম্যাগডাকে ভালোবাসে তার শরীরটাকে উপভোগ করা তার একমাত্র উদ্দেশ্য নয় |
যাই হোক এই ঘটনার পর ম্যাগডা তীব্র অনুতাপে ভোগে, হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরে বেড়ায় শুধু একটি বারের জন্য বলবে বলে –“টোমেক তুমি সেদিন যা যা বলেছিলে সেটাই ঠিক”।
ছবির শেষ দৃশ্য দেখে মনে হয়, ম্যাগডার ট্রান্সফরমেশন সম্পূর্ণ হয়েছে।
সে টোমেকের টেলিস্কোপে চোখ রেখে কল্পনা করে অতীতের সেই দিন যেদিন কোন কারনে ভীষণ রাগ করে টেবিলে বসে কান্না-কাটি করছিলো সে, শুধু একটি পার্থক্য ম্যাগডা দেখতে পায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে টোমেক!
Tags:
প্রবন্ধ