দোঁহা

সংসদ ভবনের 'ডাক্তারবাবু'রা




প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

খুব সম্ভবত ২০১৬ সাল, অগস্ট মাস।

লোকসভা অধিবেশন সরগরম। অন্ধ্রপ্রদেশের স্পেশাল স্ট্যাটাসের দাবি'তে আন্দোলনে নেমেছেন ওয়াইএসআরসিপি ও টিডিপি সাংসদেরা। 'ওয়েলে' নেমে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তুলছেন স্লোগান। এককথায় মোদি সরকারের তুলোধনা করছেন।

তৎকালীন স্পিকার সুমিত্রা মহাজন বারবার তাঁদের সিটে ফিরে যেতে বলছেন। কিন্তু বিক্ষুব্ধ সাংসদেরা তাতে নারাজ। বারবার মুলতুবি হচ্ছে সভার কাজ। 'ব্রেক' নিয়ে আবারও হচ্ছে শুরু। কিন্তু পরিস্থিতি একই। ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে আবহ।

সেই বিক্ষুব্ধদের দলেই ছিলেন ওয়াইএসআরসিপি সাংসদ বি রেনুকা। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে থেকে তিনি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। হঠাৎই শরীর খারাপ করায় ফিরে যান আসনে, এবং ঢলে পড়েন। মুহূর্তে সদনে হইচই থেমে যায়। সকলেই উৎকণ্ঠিত, আশঙ্কিত।

ঠিক সেই সময় দেখা যায় তাঁদের। সংসদের ডাক্তার বাবুদের। হতে পারেন তাঁরা জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী বা সাংসদ। কিন্তু তাঁদের আসল পরিচয়, তাঁরা ডাক্তার। আর্তের নিঃস্বার্থ সেবার জন্য যাঁরা 'হিপোক্রেটিক ওথ' নিয়েছেন কোনও এক সময়।

ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে ছুটে এলেন ড. হর্ষবর্ধন (প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী), ড. মহেশ শর্মা (তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রী), ড. সঞ্জয় জয়সওয়াল (পশ্চিম চম্পারনের সাংসদ)। তৃণমূলের বেঞ্চ থেকে ছুটে আসেন ড. কাকলি ঘোষ দস্তিদার। অন্যান্য আসন থেকেও ছুটে এসেছেন বেশ কয়েকজন৷

এক নিমেষে যেন বসে গেল মেডিকেল বোর্ড। প্রেস গ্যালারি থেকে আমরা, সাংবাদিকরা অবাক হয়ে সেই কাণ্ডকারখানা দেখছি। সংসদের সেই ডাক্তার বাবু'রা অবশ্য ভ্রুক্ষেপহীন।

কেউ পালস দেখছেন, কেউ এগিয়ে দিচ্ছেন স্টেথো, জলের বোতল। কেউ কেউ তখন শুরু করেছেন আলোচনা, কেস হিস্ট্রি নিয়ে। কেন অজ্ঞান হয়ে গেলেন সাংসদ? কী খেয়েছেন? নাকি না খেয়ে নেমেছেন আন্দোলনে? বিপি কতো, সুগার কতো ইত্যাদি ইত্যাদি...

মনেই হচ্ছে না এটা পার্লামেন্ট। শাসক-বিরোধী কাজিয়া যেখানে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। সর্বক্ষণ একে অন্যকে 'ধোবি পাছার' দিতে উদ্যত সকলেই। কিন্তু সেই পরিচিত দৃশ্যটিকে আমূল পালটে যেতে দেখেছিলাম সেদিন। মার্শাল ও হাউস এটেন্ডেন্ট্-রা আসার আগেই মূর্ছিত সাংসদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সকলেই। অধিকাংশই তাঁরা সাংসদ তথা চিকিৎসক।

তাঁদের সম্মিলিত, ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন রেনুকা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন সকলে। সংসদের ডাক্তারবাবুরা আবারও তাঁদের আসনে ফিরে আসেন। আবারও শুরু হয় সভা। প্রত্যাশিত হইচই, দক্ষযজ্ঞ।

প্রায়ই একই রকম ঘটনার সাক্ষী থেকেছি ২০১৪ সালে, লোকসভায় 'মরিচগুঁড়ো' হামলার সময়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সুশীল কুমার শিণ্ডে সেদিন "অন্ধ্রপ্রদেশ পুনর্গঠন বিল" পেশ করছেন সদনে। মুহূর্তে উত্তাল হল দাক্ষিণাত্য শিবির। প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন সীমান্ধ্র সাংসদরা। টিডিপির এম ভেনুগোপাল রেড্ডি সেক্রেটারি জেনারেলের মাইক উপড়ে নেন, ভেঙে দেন কাঁচের গ্লাস৷

আরও এক ধাপ এগিয়ে বিজয়ওয়াড়ার সীমান্ধ্র কংগ্রেস সাংসদ এল রাজাগোপাল বাঁধিয়েছিলেন এক দুঃসাহসিক কাণ্ড। 'ওয়েলে' নেমে তিনি ছুঁড়ে দেন 'পিপার স্প্রে'। নিমেষে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সভা৷ মরিচগুঁড়োর ঝাঁঝে তখন দমবন্ধকর অবস্থা সকলের। নিঃশ্বাস নিতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে। এক নিমেষে গোটা লোকসভা নাৎসি 'কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে' পরিণত হয়। নারকীয় গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয় লোকসভা। তৎকালীন স্পিকার মীরা কুমার 'মার্শাল ল' জারি করে সভা মুলতুবি করে দেন।

বহু মানুষ, সাংসদ মন্ত্রী সাধারণ দর্শক সাংবাদিকরা সেদিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। একের পর এক অ্যাম্বুলেন্সে তাঁদের পাঠানো হয় দিল্লির বিভিন্ন হাসপাতালে। সেই সময়েও দেখেছি সংসদ ভবনের ডাক্তারবাবুরা নিজেদের কথা না ভেবে এগিয়ে এসেছেন সাহায্যে। সাংসদ-মন্ত্রীর তকমা ঝেড়ে ফেলে চিকিৎসকের উর্দি চাপিয়ে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সে এক অকল্পনীয় দৃশ্য।

সাংসদের চিকিৎসকদের নিয়ে আলোচনা খুব কমই হয়। তাঁরাও এই বিষয়ে একটু নিভৃতচারী। সচরাচর তাঁদের 'মেডিকেল প্রফেশন' নিয়ে মুখ খোলেন না। কিন্তু বিপদে আপদে তাঁদেরই দেখেছি সবার আগে এগিয়ে আসতে।

লোকসভা হোক বা রাজ্যসভা - দুই কক্ষেই রয়েছেন বা ছিলেন একাধিক প্রবীন সাংসদ। মুলায়ম সিং যাদব, শরদ পাওয়ার, ফারুখ আবদুল্লা, শান্তা কুমার, লালকৃষ্ণ আডবানী, মুরলী মনোহর জোশি, সনিয়া গান্ধী, সুষমা স্বরাজ বা অরুণ জেটলির মতো বর্ষীয়ান নেতারা দীর্ঘদিন ধরে সামলেছেন কাজ। প্রবীনদের স্বাস্থ্যের প্রতিও তাই সজাগ থাকতেন পার্লামেন্টের চিকিৎসক-সাংসদেরা৷ প্রায়ই সিনিয়র'দের স্বাস্থ্যের খবরাখবর নিতে কার্পণ্য করতেন না তাঁরা।

শুধু সাংসদ বা মন্ত্রী-সান্ত্রী'রাই নন, সাধারণের সেবাতেও এগিয়ে আসতে পিছপা হননি সংসদের চিকিৎসকেরা৷ সেদিকটা না বললে অবিচার হয়৷

তৃণমূল কংগ্রেসের পার্লামেন্টারি পার্টি অফিসে দেখেছি চা টোস্ট দিয়ে আড্ডা মারতে মারতে অক্লান্ত হাতে 'ইনফরমাল প্রেসক্রিপশন' লিখে দিচ্ছেন কাকলী'দি, শান্তনুদা, মানস ভুঁইয়া, রত্না দে নাগ বা মমতাজ সংঘমিতা-রা। সাংবাদিকদের জিজ্ঞেস করছেন, "শরীর কেমন... কোনও অসুবিধা নেই তো...এই ওষুধ খাও, সেই ওষুধ খাও!"

সেন্ট্রাল হলের বাইরে তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ড. সুভাষ ভামরে-কে দেখেছি এক বয়স্ক অ্যাটেন্ডেন্ট'কে জিজ্ঞেস করছেন, "জো দাওয়াই দিয়া উহ খা রহে হো না?" আপ্লুত সেই বৃদ্ধ অ্যাটেন্ডেন্ট কৃতজ্ঞতায় তখন জড়োসড়ো।

মহারাষ্ট্রের সাংসদ ড. শ্রীকান্ত শিণ্ডে রিডিং রুমে কাগজ ওল্টাতে ওল্টাতে এক সতীর্থের জন্য 'দাওয়াই' লিখে দিচ্ছেন। বলছেন, এক্ষুণি কোর্স শুরু করো, 'নেহি তো গড়বড় হো জায়গা'। তার পরেই মৃদু গলায় ধমক - "দারু পিনা কম কিজিয়ে'!

বিহারের বিজেপি সাংসদ ও চিকিৎসক সঞ্জয় জয়সওয়ালের মুখে শুনেছি তাঁর 'আদর্শে'র গুণগান। মোদি নন, তিনি প্রাতঃস্মরণীয় চিকিৎসক ড. বিধানচন্দ্র রায়। প্রতি বছর দিল্লিতে 'ডক্টরস ডে' পালন করতেন সাংসদ শান্তনু সেন। সবাইকে উপহারে দেওয়া হতো বিধানচন্দ্র রায়ের একটি ছোট্ট মূর্তি ও জীবনী।

পার্লামেন্ট দেখতে আসা কচিকাঁচা স্কুল পড়ুয়াদের সাথে সংসদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে নিতান্তই খেলার ছলে তাঁদের চোখ টেনে, নিরীক্ষণ করতে দেখেছি প্রীতম মুণ্ডে, কখনো বা হীনা গাভিত-কেও।পার্লামেন্টের এক নিরাপত্তা কর্মীর হাতে ওষুধ তুলে দিতে দেখেছি বিজেপি সাংসদ ড. কিরিট ভাই সোলাঙ্কি কে। বলছেন, "জরুরত পড়ে তো বোল না!"

অতিমারীর সময়েও পার্লামেন্টে সাংসদ-ডাক্তাররা নেমেছিলেন তাঁদের চিরাচরিত কর্তব্যপালনে। কেউ খুলেছেন অস্থায়ী হাসপাতাল, কেউ নির্বাচনী কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে দিয়েছেন পরিষেবা। দিনের পর দিন পরে থেকেছেন হাসপাতালে।

সংসদের পরিচয় শুধু রাজনৈতিক আখাড়া হিসেবে নয়, সহমর্মিতার পীঠস্থানও সংসদ। দিনের পর দিন, কোনও না কোনও ভাবে, পরিচিত-অপরিচিতের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এই চিকিৎসকেরা। যদিও তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় বা কর্মকাণ্ড নিয়েই বরাবর ব্যস্ত থেকেছি আমরা। ভুলে গেছি তাঁদের চিকিৎসক সত্ত্বাটিকে। যদিও তাঁরা এসবের পরোয়া করেন না।

কিংবদন্তি চিকিৎসক ও রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধানচন্দ্র রায়ের জন্মতিথি উপলক্ষে আজ যখন দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে 'ডক্টর্স ডে', তখন সংসদের এই চিকিৎসকদের কথা না হয় একটু স্মরণ করার চেষ্টা করলাম আমরা।

প্রতিবেদন শেষ করা যাক, একটা মজার তথ্য দিয়ে৷

যে দেশবরেণ্য চিকিৎসককে স্মরণ করে ১ জুলাই সারাদেশে 'জাতীয় চিকিৎসক দিবস' পালন করা হয়, আজ পর্যন্ত বিধানচন্দ্র রায়ের কোনও মূর্তি বা প্রতিকৃতি ঠাঁই পায়নি সংসদ চত্বরে।

সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৮ সালে ভারতীয় সংসদ ভবনে তিন প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'প্রতিকৃতি' দান করেছিলেন বিধান রায়৷ চিত্রকর অতুল বসুর আঁকা সেই সব প্রতিকৃতি তৎকালীন প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ উদ্বোধন করেছিলেন।

অথচ আজ পর্যন্ত সংসদে ঠাঁই পায়নি 'ভারতরত্ন' বিধানচন্দ্র রায়ের কোনও প্রতিকৃতি বা মূর্তি।

'ডক্টর্স ডে'-তে এও এক 'বিস্ময়কর' সমাপতন। 'একটি পেরেকের কাহিনি' আজও বুঝি অচর্চিত'ই রয়ে গেছে কেন্দ্রীয় 'ক্ষমতার অলিন্দে'...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন