দোঁহা

আমার ঋতুভাবনা


দেবজ্যোতি মিশ্র

স্মরণ তো তাঁকে করব যাকে স্মৃতি তার অন্তরের অন্দরমহলে ঠেলে দিয়েছে। যে সব সময়েই সঙ্গে রয়েছে, তাঁকে আর আলাদা করে স্মরণ করতে হয় না। সে আপনিই গড়গড়িয়ে ভাবনার মধ্য দিয়ে বাক্যবিন্যাসে চলে আসে...কথায়-কথায়... ছেঁড়া-ছেঁড়া...টুকরো টুকরো ভাবে। সেভাবেই আজ ঋতু’র কথা বলব।

এ ভাবনা ‘ঋতুভাবনা’। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যেই ভাবনা কখনও পর্ণমোচীর মতো আমার চিন্তাশক্তি থেকে ঝরে পড়েনি কিংবা ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে আমার মধ্যেকার ঋতুভাবনারও পরিবর্তন হয়নি কখনো। রাগ, অভিমানের কুয়াশার চাদর মাঝে-মধ্যে আমাদের বন্ধুত্বকে ঢেকে ফেললেও, যথাসময়ে আবার রোদ-ঝলমলে আবহাওয়ায় হেসেছে সে। এটাই ঋতু আর এটাই আমি। আমাদের বন্ধুত্ব। যা হৃদয়ের দেওয়ালে টুকরো টুকরোভাবে সবসময়েই ফ্রেমবন্দী। আজও ঠিক একইরকমভাবে অমলিন, উজ্জ্বল।

ঋতুর কথা উল্লেখ করতে গেলেই একটা ‘ভাবনা-মন্তাজ’ ভেসে ওঠে আমার চোখের সামনে...কিছু দৃশ্য, একটি মানুষ, তাঁর জীবন, তাঁর ডায়নামিকস্, তাঁর বেঁচে থাকার ইচ্ছে, জীবনের সঙ্গে তাঁর মোকাবিলা, তাঁর আর্টফর্ম এবং যে কথা বারবার আমার চিন্তাশক্তিতে উদগ্রভাবে প্রকট হয়, তা হল-রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শনে নূতন প্রাণ দাও...অর্থাৎ, নতুন করে নিজেকে দেখতে পাওয়া বা আবিষ্কার করতে পারা সেই মানুষটি-এ সমস্ত দৃশ্য নিয়েই ‘ঋতু', আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু যে অনেকের কাছের মানুষ, ঋতুপর্ণ ঘোষ আজ ইতিহাসের পাতায় এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর। শুধু বাংলার ইতিহাসেই নয়, ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর ইতিহাসের কাছেও। আসলে ইতিহাস তো আর বাংলা, ভারতবর্ষ বা পৃথিবীর হয় না। ইতিহাস মানে না কোনও গণ্ডী। ইতিহাস সময়সীমা, জাতি, ভাষা কোনও কিছুরই ধার ধারে না। একটা কন্টিনিউয়াস ফ্লোয়ের মধ্যে এই ঋতুর যে ‘ঋতু পরিবর্তন’ সেগুলো আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। কখনও দেখেছি কাজের ক্ষেত্রে, আবার কখনও বা ব্যক্তিগত স্তরে।
নক্ষত্র খসে পড়ার পাঁচটা বছর। মাঝে বয়ে গিয়েছে অনেকটা সময়। সেখানে এই পাঁচ বছর চলে যাওয়ার পরে, আজ লিখতে বসে আমার মনে হচ্ছে, আসলে একজন মানুষ চলে যাওয়ার পরই তাঁর মূল কাজটা শুরু করতে পারে। কিছু কাজ সে জীবদ্দশায় শুরু করে দিয়ে যায়। এবং তারপর সেই ক্রমপ্রবহমান ধারার মতো তাঁর সেই কর্মসৃষ্টিকে বয়ে নিয়ে যায় নতুন কেউ। একান্তই তাঁর মতো করে। খানিকটা রিলেরেস গোছের ব্যাপার। যেখানে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিকর্তা নির্বাচন করেন। সেই ব্যক্তিকে যাঁর হাতে তিনি নির্দ্বিধায় সপে দিয়ে যেতে পারেন তাঁর বাঁশিটা। এপ্রসঙ্গে মনে পড়ে, ‘বাঁশি তোমায় দিয়ে যাব কাহারো হাতে...ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথ ব্যাকুল ছিলেন তাঁর সাধের বাঁশি তিনি কার হাতে অর্পণ করবেন সেই ভাবনায়। ইতিহাসের এমত পদচারণায়, যেখানে একটি মানুষের কাছ থেকে আরেকটি মানুষ এক সৃষ্টির উল্লাসকে বয়ে নিয়ে যাবে-এই ব্যাপারটা আমি ঋতুর মধ্যে দেখেছিলাম। সত্যজিৎ-পরবর্তী সময়টা কেমন হবে-এই রচনার সূত্রপাত কিন্তু করে দিয়ে গিয়েছে ঋতুপর্ণ এবং রবীন্দ্রনাথ আর মহাভারত-এই দুইয়ের মধ্যে যে সেতুবন্ধন, সেই কর্মযজ্ঞের স্রষ্টাও সে। সে নিজের মতো রবীন্দ্রভাবনা কনসিভ্ করেছে, ডিকন্সট্রাক্ট করেছে, কখনও বা নিজমনে তর্কও করেছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। অনেকটা এভাবে... তুমি আমার পিতা। তুমি আমার গুরু। তোমার গৃহেই আমার যাপন। কিন্তু আমার পৃথিবীটা অন্য। সুতরাং কখনও কখনও আমার তোমাকে ডি-বাংক করতে হবে, সর্বদা তোমার পদানুসরণ করলে আমার চলবে না। চেনা গণ্ডী, চেনা ছক, কাটা লক্ষণরেখার বাইরেও যেতে হবে আমাকে। ছুঁতে হবে এক নতুন দিগন্তকে। নতুনকে চেনার, জানার, বোঝার বা শেখার এক অদ্ভূত গভীর তৃষ্ণা ছিল ঋতুর মধ্যে। তোমার কাছ থেকে আমি আমার উত্তরাধিকার পেয়ে এবার আমি আমার পথ চলছি-মহাভারতের এই পাঠ ঋতু ওঁর জীবনদর্শনে এবং কাজের মধ্যে বহুবার সম্পৃক্ত করেছে।
 

ওঁর সঙ্গে দীর্ঘকাল আমি কাজ করেছি। কিন্তু ছবিতে কাজ করার কথাটাই শুধু আমি এক্ষেত্রে উল্লেখ করব না। আমি বলব যে একটা দীর্ঘজীবন পথের মতো একটা বন্ধুত্বের জায়গায় দাঁড়িয়ে কীভাবে আমি আজকে দাঁড়িয়ে দেখছি ঋতুকে। আমি যখন ওঁর সঙ্গে কাজ করেছি, তা সে ‘বাড়িওয়ালি’-ই হোক ‘চোখের বালি' কিংবা 'শুভ মহরৎ' বা 'দহন', 'অন্তরমহল', 'রেইনকোট' এই প্রত্যেকটাক্ষেত্রেই...
মূলত, আমাদের দু'জনের ভিতরেই ভীষণভাবে যেই ব্যাপারটা কাজ করেছে তা হল ‘এ কি লাবণ্য পূর্ণ প্রাণ' গানটা এবং এই গানটা যখন আমাদের মধ্যে কাজ করেছে, তখন অনেকটা এরকমভাবে কাজ করেছে যে, ঋতুর কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠিক যেরকম একটা অধ্যায়, আমার সঙ্গে তখন রবীন্দ্রনাথের অনেক বেশি সংঘাত। তাই এই দুই বিপরীত ভাবনার জগতে দাঁড়িয়ে যখন একটা ভাষ্য তৈরি হচ্ছে ‘চোখের বালি' সিনেমায়, যেখানে 'এ কি লাবণ্য পূর্ণ প্রাণ গানটা আসছে, আমি কিন্তু সেটাকে প্রাচ্যের দৃষ্টি দিয়ে বিচার করছি না, আমার কাছে তখন ওটা একটা মাস...জন সিলভারস্টেরিয়ান বার্ক-এর মাস। আমি এটা নিয়ে ঋতুর সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। ও তখন খুব অসাধারণভাবে শব্দ দিয়ে একটা দৃশ্য আমায় বর্ণনা করেছিল। বেনারসে ভেসে থাকা বজরায় বিহারি এবং বিনোদিনীর চুম্বনের দৃশ্য চলছে। আরেকদিকে বেনারসের ঘাটজুড়ে তখন চলছে উৎসব। বেঁচে থাকার উৎসব। সঙ্গে মৃত্যুর উৎসব। বেনারস নিজেই তো নিজের মতো করে একটা গোটা পৃথিবী। শুধু তাই নয়, একটা মাল্টি-কালচারাল জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে ঋতু আমায় বলেছিল, ‘দেবু এই মাল্টি-কালচারাল জায়গাটা আমি আনতে চাই।' ওঁর এই শখপূরণ করতে গিয়ে সেখানে আমাকে ঠুমরি ব্যবহার করতে হয়েছিল। ভাসমান বজরায় একদিকে ঠুমরির আসর চলছে। বেনারসের ঘাট। সন্ধ্যা-পরবর্তী সময়ে একদিকে গঙ্গায় ভাসমান বজরা আর ঠুমরির আসর। আবার একদিকে আশালতা যে তখন অন্তঃসত্ত্বা, নিজের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছে একটা নূতন প্রাণ। ওই সরল মেয়েটির মধ্যে ওই যে বেঁচে থাকার একটা তাগিদ...আসলে, বিনোদিনী আর আশালতা দুই নারী চরিত্রকে ঋতু নিজের ভাবনা মতো সাজিয়ে তুলেছিল। বিনোদিনী যেই নারী নিজের ভাবনায় স্বয়ংসম্পূর্ণা, নিজের মতো করে যে এলিভেটেড জীবনে চলে যেতে পারে...সেখানে আশালতা তা পারে না। আশালতার কাছে তাঁর জীবনের সিংহদুয়ারটা বেশ ধীর গতিতে খুলেছিল। স্বামী পর-নারীতে আসক্ত হয়ে পড়ছে, নিজের ঘর-সংসার সব ছেড়ে যে নতুন এক দুনিয়ার খোঁজে মাসির হাত ধরে বেনারস পাড়ি দিচ্ছে...অনেকটা যেন তাঁর ভেতরে থাকা ‘নূতন প্রাণ'-এর অঙ্কুরোদগম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ভাবনাজগতেও নতুন জীবনদর্শনের বীজবপন ঘটছে। 'চোখের বালি'র এই প্লটটা তুলে ধরার সময় ঋতু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, 'দেবু এখানে কী করা যায়?'
 

আমার তখন মনে হয়েছিল, এটা তো বেঁচে থাকার একটা আখাঙ্ক্ষা। একটা নতুন শুরুয়াত্। যেখানে আমরা দেখতে পেয়েছি, বেনারসে ঠাঁই নেওয়া বিধবারা, যারা জীবনের সব রং থেকে বঞ্চিত, সেখানে আশালতার জন্য ভাজা মাছের গন্ধটাও তাদের কাছে একটা কামনা-বাসনা জাগিয়ে তুলছে। এই দৃশ্যে কেমন যেন একটা ফরবিডেননেস্, মানে একটা নিষিদ্ধ গন্ধ রয়েছে...যে বিধবারা মাছ খায় না। কিন্তু ওরা তখন এক নূতন প্রাণকে স্বাগত জানানোর জন্য অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটিকে মাছ খাওয়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। যেখানে নিজেরা বহু বছর ধরে সেই স্বাদ থেকে বঞ্চিত। তাই মাছের গন্ধটা কারও কাছে কটূ মনে হচ্ছে আবার কারও কাছে বা সেটা একটা আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক হিসেবে ধরা পড়ছে। মাছের স্বাদ লেহন করার জন্য তাদের মধ্যে আকাঙ্খা বাসা বেঁধেছে, তা যৌনকামনা থেকে কোনও অংশে কম নয়। আর এই কামনাটাকে প্রতিভাত করতে গিয়ে আমরা ব্যবহার করেছি ‘ও জীবন রে ছাড়িয়া মোরে ছাড়িয়া যাস না রে...' গানটা এবং এই এক্ষেত্রে একটা অর্কেস্ট্রা ব্যবহার করছি। কোথাও গিয়ে মনে হয়েছে 'হি ইজ গোয়িং বিয়ন্ড' ও মিউজিক কম্পোজিশনটাকে যেভাবে ভাবছে সেখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এবং কোথাও গিয়ে 'চোখের বালি' করার সময় নতুনভাবে আমরা বিনোদিনী চিনেছি। রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনীকে এক নতুনরূপে দেখতে পেয়েছি।

আমার মনে আছে, 'চোখের বালি'র মিউজিক স্কোর করার সময় একদিন আমরা একসঙ্গে ভিসুয়ালসগুলো দেখছি, আর সঙ্গে মিউজিক স্কোর করছি। ও আমায় সবসময়ই বলত, 'দেবু তুই তো প্রলিফিক্ স্কোর করিস। তুই লিখে ফেল। তাহলে এই ইমোশনটাকে ধরে রাখতে পারবি।' যাই হোক, ফিরি 'চোখের বালি' প্রসঙ্গে। যেখানে বিনোদিনী এক অন্যজগতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছে। যেখানে বিনোদিনী নিজের সব কামনা-বাসনাকে বিদায় জানাচ্ছে। যেন সে নিঃশব্দে স্বগতোক্তি করছে—হে ভালোবাসা, হে প্রেম, হে নৈশঃব্দ, হে আমার চুম্বন, হে আমার আকাঙ্খা...আমি এলাম...এই বেনারস ঘাট, জল, মৃত্যু, জীবনের আকাঙ্খা, চারপাশে ছড়ানো এ মায়ার জাগতিক সংসারের কাছ থেকে আমি বিদায় নিলাম। সেই সিকোয়েন্সে একটা সেলিব্রেশন দরকার তখন। ঠিক সেই সময়েই ঋতুর আর আমার, দু'জনেরই মনে হল রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে ধরছে আমাদের। বার্ক আর রবীন্দ্রনাথকে তখন আমরা একসঙ্গে দেখতে পাচ্ছি। একসঙ্গে আবিষ্কার করছি এই নতুন ভাবনাকে। আর ওঁর রবীন্দ্রভাবনায় এক নতুন দুয়ার উন্মোচন হচ্ছে তখন। সেটাকে অবলীলায় স্বাগত জানাচ্ছে ঋতু। বলতে গেলে এই ‘নূতন’-এর সঙ্গে ঘরও করছে তখন ও।
ওঁর সাঙ্গে যখন ‘চিত্রাঙ্গদা’য় কাজ করছি, সেখানে দাঁড়িয়ে ওঁর ব্যক্তিগত জীবন বা জীবনপ্রবাহে যে নতুন ধারা সেটাকেও প্রত্যক্ষ করেছি। আজকের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ এবং মহাভারতের মধ্যে যোগস্থাপন করার প্রথম কাঠামোটাই তৈরি করেছে ঋতুর ‘চিত্রাঙ্গদা’। ছবিতে ঋতুর অপারেশন নিয়ে একটা সাউন্ড-ভিসুয়ালসের ড্রামাটিক সিকোয়েন্স রয়েছে। সেটা করার সময় ওঁ আমায় বলেছিল, ‘দেবু তুই ভুলে যা এতদিন ধরে তোকে আমি যা যা বলেছি, বা তুই যা যা করেছিস। ওই অপারেশন থিয়েটারের একটা অদ্ভুত শট তৈরি করেছিলাম আমরা। যাতে অনেকরকম শব্দের প্রয়োগ হয়েছিল। একটা সাররিয়্যাল সাউন্ড ইমেজ যেন গোটা মঞ্চ জুড়ে ধেয়ে বেড়াচ্ছে। তার সঙ্গে অপারেশন থিয়েটারের সাউন্ডগুলো এবং অসম্ভব একটা কোরিওগ্রাফি...মনে আছে তাঁর আগে ওকে আমি মার্থা গ্রাহামের ১৯৩০-এর একটা প্রোডাকশন দেখিয়েছিলাম। সেটা ছিল 'মারেস্টেশন'। আমরা দু’জনেই জার্মানের পিনা বাওস-এর ভীষণ ভক্ত ছিলাম। সেখানে একটা অদ্ভূত সুন্দর এক ভাবনার জন্ম হয়েছিল—জীবনের বেঁচে থাকার যে একটা উদ্যোগ। এই যে একটা পারাপার, স্মৃতি-বিস্মৃতি—এসমস্ত কিছু মিলিয়ে।
 

'চিত্রাঙ্গদা’য় ঋতুর জীবনে যে প্রেম বা প্রেমহীনতা, না-পাওয়ার আকাঙ্খার এক ঘোর...সবমিলিয়ে একটা সাউন্ড স্ক্রিপ্ট তৈরি করা হল। আসলে ‘চিত্রাঙ্গদা’র আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল ঋতুর পৃথিবী দর্শন। শুরু হয়ে গিয়েছিল ওঁর ভাবনাজগতের বিশ্ব সফর। সেসময় ও নিজেকে জানছিল। চিনছিল এক নতুন ঋতুপর্ণ ঘোষকে। নিজের সঙ্গেই একটা বোঝাপড়া, আপস চলছিল। এবং ওঁর নিজের ভাবনার প্রতিফলনই ঘটেছিল চিত্রাঙ্গদার মধ্য দিয়ে। আমার কাছে ‘চিত্রাঙ্গদা' একটা রেবেল ওয়ার্ক বা ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এক রেভিউলেশনারি ছবির আস্ত এক দলিল। খুব কাছ থেকে তখন দেখেছিলাম দিন দিন, ওঁর চিন্তাভাবনাটা কী করে গ্রো করছে। ওঁর সামনে উন্মোচিত হচ্ছে নতুন নতুন ভাবনার দুয়ার। বেশ দীর্ঘ সময় ধরে দেখছিলাম ও একটার পর একটা দেওয়াল টপকাচ্ছে। এটা আমায় ভাবাতে বাধ্য করেছিল যে-ঋতুপর্ণ ইজ আ রিমার্কেবল পার্সন...মানুষ হিসেবে হোক বা একজন লেখক, একজন পরিচালক কিংবা একজন চিন্তাবিদ হিসেবে... সবেতেই ওঁ অনন্য। চিন্তাবিদ হিসেবে ঋতুপর্ণ সবার থেকে আলাদা এবং ওঁর ভাবনাগুলো কোথাও গিয়ে অনবদ্য।
‘রেইনকোট’-এর ‘পিয়া তোরা ক্যায়সা অভিমানই হোক বা ‘মথুরা নগরপতি’, এই দুটো গানই যে মানুষের মনে গেঁথে গিয়েছিল, তা আজ আর নতুন করে উল্লেখ করার কিছু নেই। তবে, আমরা কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গানগুলো নিয়ে কাজ করেছি। ওঁর ভাবনার পরিসরটা এতটাই বিস্তির্ণ ছিল যে, সেই বিস্তির্ণ জায়গা থেকে অনেক নতুন কিছু করার সূচনা করে দিয়ে গিয়েছে ঋতু নিজেই। ইতিহাসের একটা পাতা ওলটানোর মতোই ওঁর এই নতুন অধ্যায়ের সূচনাটাও অনেক বড় একটা ব্যাপার।
 

‘মেমোরিজ ইন মার্চ’-এ ‘সখী হাম...’ গানের দৃশ্যে রাধা-কৃষ্ণের সম্পর্কে প্রেম-বিরহ ব্যাপারটা এক নতুনভাবে প্রতিভাত হয়েছিল। ঋতু তখন আমায় বলেছিল। একটা নতুন গান তৈরি করতে।‘ মনে আছে, বাণ্টি (সঞ্জয় নাগ) বসে আছে সামনে, একটু দূরে ঋতুও সেখানে বসে। ভীষণ রেগে আমার ওপর। কেননা ওর কথা মতো তখনও আমি গানের খসড়া প্রস্তুত শুরু করিনি। খুব একটা আগে থেকে প্রিপেয়ার করে কোনও কিছু করা যদিও আমার ধাতে নেই। যাই হোক, আমি গান কম্পোজ করা শুরু করলাম। কিছুটা করেছি। ব্যাস, ওদিক থেকে ঋতু-বাণ এল। হঠাৎ, থার্ড পার্সনে কমেন্ট-‘বান্টি, ওকে বল, নোটেশনটা যেন করে রাখে।' কেননা, ওঁর একটা ধারণা ছিল আমি যদি ওই গানের নোটেশনটা স্ক্রিপ্ট করে রাখি, তাহলে নাকি একশো বছর পর হলেও গাইতে পারব। আসলে, আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা এমনই ভালো ছিল।

আমার কাছে ঋতু একটা বিদ্বান মানুষ, প্রগাঢ় পন্ডিত মানুষ, যার পান্ডিত্যের প্রতি ঔৎসুক্য ছিল। যে শিক্ষার সঙ্গে, জ্ঞানের সঙ্গে, বইয়ের সঙ্গে বা অক্ষরের সঙ্গে ঘর করতে ভালোবাসত...চারিধারের যে বইগুলো রয়েছে সেগুলো যে সব পড়ে ফেলতে হবে ঠিক তা নয়। অনেকটা... ‘এই বইগুলো যেন আমাকে ঘিরে রয়েছে, বইগুলো যেন অহোরাত্র পাহাড়া দিচ্ছে আমাকে, বইয়ের পাহাড়ায় আমি রয়েছি শব্দের পাহাড়ায় আমি রয়েছি, অক্ষরের পাহাড়ায় রয়েছি, আমার নিঃসঙ্গতায় তারা ভেসে ভেসে আসে আমার কাছে’ - বেশ এই গোছের একটা অনুভূতি বোধহয় ঋতুর মধ্যে ছিল। ঠিক যে কারণে ও পতিত মানুষদের আনুগত্য খুব ভালোবাসত। আর তাই নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির কাছে মহাভারত পড়তে যেত। আমরা দু'জনেই অবশ্য নৃসিংহ দার কাছে দীর্ঘদিন মহাভারত পড়েছি। আবার পাঠ নিতে ছুটে ছিল শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে।
 

ওঁর সবথেকে যেই বিষয়টা আমার ভালো লাগত, তা হল-ওঁর জানার ইচ্ছে। এবং কৌতূহলী মনের ওপর ভর করেই ও প্রতিনিয়ত জ্ঞানের সাগরে সফর করছে। ওঁর জানার চেষ্টা বা দিগন্ত ছোঁয়ার চেষ্টায় কখনও থেমে থাকতে দেখিনি ওঁকে । 
‘রেইনকোট’ ছবির সময় হঠাৎ একদিন আমায় ফোন করে বলল 'শোন, অজয় (দেবগণ) আসছে শহরে। ওর সঙ্গে আলোচনা করার আগেই তোকে কিছু কথা বলা জরুরি যে, ছবিতে ওর যে চরিত্র, সেখানে ওর চাকরির প্রয়োজনের থেকেও খুব বেশি দরকার ওর প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হওয়া বা জানা কেমন আছে সে এখন…যে ঘর বেঁধেছে অন্য শহরে। অন্য এক পুরুষের সঙ্গে...আর ঠিক এই সিকোয়েন্সটা আমি ভিসুয়ালি ট্রিট না করে গানের মধ্যে দিয়ে ট্রিট করতে চাই।'
ওঁর ভাবনাটা আমি বেশ ভালো ডি-কোড করতে পারতাম। যেমন- ঋতু যদি বলত কীর্তন, তাহলে সেটা কীভাবে চাইছে ও রাধা-কৃষ্ণ, তাদের সম্পর্ক এবং তাদের সম্পর্কের সমীকরণের সঙ্গে যোগ হবে একটা নিও-ক্লাসিক ভাবনা। যেই গানে ছোঁয়া থাকবে মৈথিলি, ব্রজবুলি ভাষার। দেখলাম একদিন খস্ খস্ করে ‘মথুরা নগরপতি' গানটা লিখে ফেলল। আমিও তৎক্ষণাৎ সুর ছকে ফেললাম। 
‘মথুরা নগরপতি' গানটা নিয়ে বেশ মজার একটা স্মৃতি আছে। গানটা পুরুষ ও মহিলা উভয় কণ্ঠেই তৈরি ইতিমধ্যে। হঠাৎ, ঋতু বলল, যে ও মহিলা কন্ঠের গানটা ছবিতে ব্যবহার করতে চায়। যদিও হরিহরনের গাওয়া গানটাই মানুষের মনে বেশি সফর করেছিল। আসলে ঋতু চাইছিল, একটা আনকোরা আওয়াজ। প্রতিদিনকার মিষ্টি, পেলব যে সৌন্দর্য তার একটা নতুন ডেফিনিশন খুঁজে পেয়েছিল ও। টোনালিটির কোয়ালিটি নিয়ে চর্চা করছে তখন ও। রুক্ষ গলা, যে গলায় কোনও মিষ্টতা নেই, যে আওয়াজ রোজকার মতো সুরেলা নয়-ওর তখন এধরনের গলা ভালো লাগছে। হরিহরনের জায়গায় এই গানটা গাওয়ার কথা ছিল রশিদ আলি খানের। তবে, ঋতু চায়নি। বলেছিল, ও যদি কখনও রাধা-কৃষ্ণ নিয়ে কোনও কাজ করে তখন রশিদকে দিয়ে গাওয়াবে।
 

আসলে, ঋতুর চোখ তখন ওয়ার্ল্ড ভিউয়ে বিভোর। মার্থা গ্রাহাম, পিনা বাওস, ভিন্নরকম ভিসুয়াল আর্ট তখন ওকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করছে। কিন্তু, অন্যদিকে তো তার জীবনীশক্তি কমে আসছে। ও জীবন-মৃত্যু নিয়ে তখন এক্সপেরিমেন্ট করছে। নিজের শরীর নিয়ে ভাঙ্গা-গড়ার খেলা খেলছে। 
ঋতুর আর আমার কাজের ধরনটা ছিল ঠিক এরকমই যখন-তখন মাথায় লেখা আসলে লিখে ফেলা বা সুর করে ফেলা। আমাদের মতো এরকম কম্বিনেশন ভীষণই রেয়ার। মাঝে-মধ্যে ভাবি, এরকম কোলাবোরেশন-টা বোধহয় এজন্মে আর কারও সঙ্গে হল না আমার। মিস করি সেই ব্যাপারগুলো।

'অন্দরমহল' ছবির একটা সিকোয়েন্সের কথা উল্লেখ করব। ছবির একটা দৃশ্য যেখানে ভিক্টোরিয়া আসছেন এবং মা দুর্গার পুজো হচ্ছে-পার্টিকুলারলি এই সিকোয়েন্সটাকে একটা ড্রামাটিক লুকস দেওয়ার জন্য একটা অর্কেস্ট্রা সাউন্ড অ্যারেঞ্জ করেছিলাম। তো একদিন ঋতুকে শোনালাম সেটা ।
-ও বলল, 'দেবু, মনে হচ্ছে আমি যেন একটা রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। চতুর্দিকে সশব্দে গাড়ি-ঘোড়া চলে যাচ্ছে। কী ভীষণ একটা পরিস্থিতি। মনটা আমার কিছুতেই স্থির হতে পারছে না। আমি আনমনা হতে চাই। তুই আমাকে রাস্তাটা পার করে দে। রাস্তার পারে দাঁড়িয়ে আমি ভিড়গুলো দেখতে চাই। সেখানে তো আমার ধাক্কা লাগবে না। আমি স্থির হতে পারব। ওখানে দাঁড়িয়ে আমি আনমোনা হয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে পারব।'
ওঁর কথা বুঝতে পেরে, আমি অর্কেস্টার কম্পেন্সিটিটা কমিয়ে দিয়ে সিম্পল করে দিলাম। কোথাও গিয়ে সেদিন মনে হয়েছিল, অর্কেস্টিক সাউন্ডের ভিসুয়াল ইমেজটা কেমন হতে পারে-তা যেন ঋতুই আমায় আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল।
 

‘বাড়িওয়ালি’তে বনলতার ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে একটা দৃশ্য তৈরি হয়েছিল। বনলতার ড্রিম সিকোয়েন্স। বিয়ের আসর, সবাই মন্ত্রোচ্চারণ করে ঘুরছে...একটা আনন্দানুভূতি, আরেকদিকে বরকে সাপে কেটেছে...ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন...যেন একটা বিষাদ ও আনন্দঘন পরিবেশের মিশেলে সৃষ্টি হয়েছে এক অপরূপ ড্রামার। সানাই, মন্ত্র, উল্লুর আওয়াজ সবমিলিয়ে একটা সাউন্ড মন্তাজ তৈরি করেছিলাম এই দৃশ্যের জন্য। বিয়ের অনুষঙ্গ এবং তার সঙ্গে একটা বিষাদ-এই ফ্লেভারটা তৈরি করার জন্য ঋতু আমায় বলেছিল, ‘দেবু, তুই এই দৃশ্যের জন্য বিষ কিছু একটা ঢাল। সানাইয়ের সুরটাই যেন ওখানে মিষ্টি ছুরির মতো কাজ করে।’
"ওলো মধুমাসে বিয়া...বাসর সাজাই মধুর কলস দিয়া...মধুমাসে মধুর মিলন...কলস কলস মধুর আয়োজন...যতই মধু দাও না কলস ভইরা...গরল লিখন খণ্ডাই কেমন কইরা...” -এই গানটা টুকরো টুকরোভাবে গোটা ছবি জুড়ে তাড়া করেছে বনলতার ক্রাইসিসকে। সুচিত্রাদি এটা শুনে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এটা মনসামঙ্গলের কোন কাণ্ডের লেখা ?
ঋতু বলেছিল, 'কোনও মনসামঙ্গল নয়, এটা দেবু ঋতুমঙ্গল'! -এরকমই মজার মানুষ ছিল ঋতু।

এই কাজগুলো বন্ধুত্বকে প্রগাঢ় করেছে। মজা করেই একসঙ্গে কাজটা করতাম আমরা। কোনও বিষয় নিয়ে চর্চা পড়াশোনাও করতাম দু’জনে। যেমন-ও কোনও বই কিনলে, আমার জন্যও সেই বইয়ের এক কপি কিনত।
 

কাজ নিয়ে যেমন সিরিয়াস ছিল, তেমনই ঋতুর মধ্যে একটা শিশুসুলভ ব্যাপারও ছিল। তার আগের অবস্থাটা ছিল খানিকটা এরকম। মাস কয়েক ঋতুর সঙ্গে কথা বন্ধ। অনেক ক’টা দিন-সপ্তাহ-মাস কেটে গিয়েছে। আমরা দু’জন দু’জনের কেউই কাউকে ফোন, মেসেজ কিছুই করিনি। হঠাৎ একদিন সকালে ফোনের রিংয়ের আওয়াজে ঘুম ভাঙে আমার। ধড়মড়িয়ে উঠে ফোন ধরে দেখি ওপারে ঋতু। 
বলল, ‘তুই তাড়াতাড়ি গিয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে আয়’।
আমি জিজ্ঞেস করলাম-কেন?
বলল-'এত প্রশ্ন না করে, যা আগে।'
যথারীতি আমি এসে ফোন করার কারণ জিজ্ঞেস করলাম। সঙ্গে সঙ্গে ঋতুর শিশুসুলভ উত্তর-‘আমাকে ‘শুভ জন্মদিন’ বল। বাসি মুখে কাউকে শুভেচ্ছা জানাতে নেই।’
 

কটা মজার ঘটনা বলি, একবার আমরা কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমি, ঋতু, বুম্বা সবাই গিয়েছি। আমি গিয়েছিলাম পঙ্কজ কাপুরের একটা হিন্দি ছবির জন্য। আর ঋতু এবং বুম্বা গিয়েছিল ‘দোসর’ ছবির জন্য। সেখানে আমরা সবাই একটা হোটেলেই ছিলাম। হোটেলের নাম ছিল খুব সম্ভবত ‘লা বোকা’। বিশ্বের তাবড় তাবড় ব্যক্তিরাও এসে ওই হোটেলে উঠতেন। কিন্তু, ওখানের একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে এদের এসির ব্যবস্থা নেই। সাউথার্ন ফ্রান্স। জুন মাসের গরম। আর এদিকে তো ঋতুর খুব গরম বাতিক। ব্যস্, ওমনি হোটেলে যাওয়া মাত্রই ‘গরম লাগছে-গরম লাগছে’ প্যানিক শুরু হয়ে গেল ওঁর। আমরা ভাবছি কী করা যায় কী করা যায়...হঠাৎ ওঁকে বললাম, 'ঋতু তুই জানিস এই ঘরটায় আন্তোনিওনি ছিলেন।' শোনার সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন ওর চোখটা জ্বলজ্বল করে উঠল। বলল, ‘সত্যি, আন্তোনিওনি, যে ঘরে ছিলেন আমিও সেই ঘরে আছি?' দেখলাম, ও তখন আস্তে আস্তে গরমটা মানিয়ে নিয়ে ওই ঘরেই থেকে গেল।

কোনও কোনও দিন একটা সামান্য কথোপকথনের মধ্যে দিয়েই শুরু হত আমাদের। কিন্তু সেগুলোই কখন যেন সময়ের মধ্য দিয়ে আমাদের ভাবনার মধ্য দিয়ে এক শিল্পসৃষ্টির রূপ নিয়ে পরিণত হতো এক বিশ্ববার্তায়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ, ব্যাসদেব, মেঘদূত, বার্ক, সলিল চৌধুরী সবকিছু আমাদের ভাবনার সঙ্গে কাজের সঙ্গে কেমন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন