দোঁহা

তোমাকে মিথ্যে বলেছি



রঞ্জনা ভট্টাচার্য্য

'ক্রমে শূন্যের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিল/তৃতীয় নয়নের মতো একখণ্ড আলো যার উপমা/কিন্তু উত্তেজনা কখনো সৃষ্টির কারণ হয় না/সন্দেহ কখনো আকার ধারণ করেনি/রহস্য চিরকাল অপ্রকাশিত থাকে, অতএব/ সদা ঘূর্ণায়মান এক নির্মল চক্রের কল্পনা করে/এবার অপেক্ষা, কখন কে, আসে!'(তোমাকে মিথ্যে বলেছি-কবি সুব্রত সরকার)

প্রথম পংক্তিটি একটা টানা টানেলের মধ্যে নিয়ে গেল, দেখা হলো 'মিথ্যা চেতনা'র (false consciousness) সাথে। যেখানে পুঁজিবাদী সমাজ প্রলেতারিয়েতদের বোঝায় আমি তোমাদেরই লোক। অসন্তোষ, সন্দেহ, রহস্য, উত্তেজনা একে একে লক্ষ্যহীন ভ্রমণের প্রলোভনে পরে  কল্পনার অপেক্ষায় থাকে। অপেক্ষায় থাকে একদিন সর্বহারা বুঝবে মালিকের স্নেহের অলাতচক্রের মধ্যে 'রক্তপরাগ /না, কপালের ফুটো দিয়ে সোজা গুলি ঢুকে গেছে ব্রেনে, /সেখানে গর্তের উপরে কলোনির দুটো কাক উড়ে আসে:/কা-কা-কমরেড!'

'কা-কা-কমরেড' কবি সুব্রত সরকারের হাতে তৈরি এক অনবদ্য শব্দ-বন্ধ। কৈশোরের রক্তঝরা দিনের কর্কশ যন্ত্রনা আর বিপ্লবের এনফোর্সড কামারেডেরি
'Allegories of Reading' বইতে মার্শাল প্রুস্তের উপন্যাস সম্পর্কে দ্য-ম্যান যা বলেছেন তা  এই কবিতার ক্ষেত্রে ও প্রযোজ্য-
'everything in this novel (poem)signifies something other than what it represents, it is always something else that is intended.'

নভেলের জায়গায় আমি কবিতা কথাটি ব্যবহার করেছি। বাহ্যত যা উপস্থাপন করা হচ্ছে, কবির প্রকৃত অভিপ্রায় তার থেকে আলাদা। এখানে প্রকৃতি  মালিক আর আমরা সবাই শ্রমিক শ্রেণী এই ধারণায় এক বিন্দু স্বপ্ন এসে তছনছ করে দেয় ভাবনার ভারসাম্য।
 
'যেমন হোমোসেপিয়ান একটি মেয়ে/পুরুষেরা শিকারে গেলে চুপি চুপি গুহার পিছনে/চলে যেত, হাতের মুঠোয় বীর্য/এইমাত্র সে জেনেছে এক শক্তি, কানে কানে/জমিকে গর্ভাধানের পরামর্শ দিয়ে যায়:/মা হও, মা হও, মা হও...'

কৃষি সভ্যতার সূচনা করেছিল হোমোসেপিয়ান মেয়েটি।
মা হওয়ার সাথে সাথে প্রকৃতি আর নারীর শক্তি সাম্য রচনা করার এক অভিনব অভিপ্রায় পরিলক্ষিত হয়।
 
'... ইউরি গ্যাগারিন/যখন মহাকাশ থেকে প্রথম এই গ্রহটির দিকে তাকালেন-/অগ্নি লতার ঝোপের আড়ালে অপূর্ব হিংসা:'
মন্যসে যদি তচ্ছক্যং ময়া  দ্রষ্টুমিতি  প্রভো, ততো মে ত্বং দর্শয়াত্মানমব্যয়ম।
ইউরি গ্যাগারিন প্রথম মানুষ যিনি  বিশ্বরূপ দর্শন করেন প্রথম মহাকাশচারী হিসেবে। অসম্ভব দক্ষতায় কবি অর্জুন আর গ্যাগারিনকে মিলিয়ে দিয়েছেন, কবিতা তার ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়নি একচুল ও।

নামহীন, রূপহীন, রিক্ততার মহাশূন্য নয়, অন্ধবিন্দুতে উদ্গত আলোকিত অন্তর্দৃষ্টি তার শান্তি ও সন্ত্রাস নিয়ে মানবিক প্রেক্ষিত থেকে পালিয়ে না যাবার প্রতিশ্রুতি কবিতার মধ্যে সুচারু ভাবে বয়ন করেছে।
অভ্যাসের পরম্পরা ছেড়ে কখনও খাঁচা, কখনও আকাশ কবির পরিসর হয়ে উঠেছে। কৌনিক ও  অরৈখিক সম্প্রসারণে কবিতার আত্মা কখনও রহস্যময়, কখনও বিস্ফোরক, কখনও শান্ত। জীবন ও পাঠকৃতিতে নিত্য বর্তমান ও সর্বত্র গামী যে নির্মাণ-ধ্বংস-পুনর্নিমাণ-পুনর্বিয়োগ তাই নতুন রণকৌশল নিয়ে কবি সুব্রত সরকারের কবিতায় ছড়িয়ে দিয়েছে  ইতিবাচক ইশারা।
কবিতায় শ্লেষ আর যন্ত্রনা প্যারেডের কাঠিন্যে আর সানাইয়ের বিলাপে বেজে উঠেছে,

'... স্মৃতি স্তম্ভ নয়, কমরেড/সংগঠন গড়ে তুলুন, লাইব্রেরি না লাশকাটা ঘর?/কম পাওয়ারের আলোয় চটি বই যেন চশমা পরা তরুণ-/কী বলতে চাইছে?...'

অথবা

'... বৃদ্ধ টলস্টয়/মছলন্দপুর স্টেশনে মূর্ছা গেছেন, বিধান ও অমলেন্দু/তাঁকে ধরাধরি করে শুইয়ে দিচ্ছে বেঞ্চিতে, ডিসট্যান্ট সিগন্যালের/ওপাশে পৃথিবী পুড়ে গেছে, মানুষ কি পারবে হৃৎস্পন্দনের নীচে যে ব্যথার  জায়গা রয়েছে, আবার সেখানে জীবন তরঙ্গ ফিরিয়ে নিয়ে যেতে?...'

কবি একাধারে 'গুপ্তচর ও বিচারক'। গুপ্তচরের মতো নিঃশব্দে পিছু ধাওয়া করেছেন ইতিহাসের, পুরাণ ও মিথের, বিচারকের মতো বলে উঠেছেন,

'১৪৯২সাল, বৃদ্ধ পোপ অষ্টম ইনোসেন্টের ধমনিতে/দুই তরুণের  রক্ত ঢুকিয়ে যৌবন ফিরিয়ে এনে দেবার স্বপ্ন দেখছেন /এক ডাক্তার, ...'

ধর্মীয় অন্ধত্ব দুই যুবকের প্রাণ কেড়ে নেয় যৌবন ফিরে পাবার অছিলায়, তবুও শুরু হয়েছিল রক্তদানের মাধ্যমে নতুন প্রাণ ফিরে পাবার বৈজ্ঞানিক সোপান।
এবং

'স্পার্টাকাস ভুল করেছিলে, যদি আবার ঐভাবে/মৃত্যু নিতে দৌড়ে দৌড়ে যাও, তাই সতত চেষ্টা করি/প্রমাণ করে দিতে-ভালোবাসা নক্ষত্রপারের কুয়াশা গম্বুজ/একে স্পর্শ করতে নেই, এর গন্ধ মানবশরীরে ক্ষতি ডেকে আনবে।'

অথবা

'... তাঁর নাম মায়া। তিনি/আমাদের সকল দোষ, অসত্য স্বভাব ও ভ্রমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসাবে পূজিত হয়েন।/সরস্বতী ইঁহার কন্যা।/বিবিধ প্রকার ভ্রমাত্মক  জ্ঞানের সৃষ্টি ও প্রচার করবার ভার /মায়ের কাছে পেয়েছেন। আসুন, সকলে/ এই মহাদেবীর চরণ বন্দনা করে বলি:স্পার্টাকাস/এমন আকৃতিহীন মেরুজ্যোতির পিছনে ছুটে নিজেকে ক্ষয় না করে/অন্তত পুলিশ বা ক্যাডারের যোগ্য হও!'

আশ্চর্য বিনির্মাণ, নাকি নির্মাণ, এ এক হীরকখণ্ড মানস যেখানে শিল্পের শ্লাঘা শ্লেষ হয়ে ফুটে উঠেছে। ক্ষমতাহীন এক বিদ্রোহী কবি  যখন বলেন, 'আসলে পরাজিত লোকেরা চশমা ছাড়া অনেক দূর অবধি দেখতে পায়... 'তখন তাঁর মধ্যে আমি সিসিফাসকে দেখি,

'If this myth (the myth of Sisyphus) is tragic, that is because it's hero is conscious...Sisyphus, proletarian of the gods, powerless and rebellious, knows the whole extent of his wretched condition:it is what he thinks of during his descent.' (Camus)

অদৃশ্য সিসিফাসের সাথে কবি অব্যক্ত ইন্দ্রনাথের (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ) দেখা করিয়ে দেন।

'তবু জানিস শ্রীকান্ত, আমি সেই অর্ধনগ্ন বনঝাউয়ের আঁধিয়ারে/জলের উপরে ওকে শুইয়ে দিলাম, তখনও ছেলেটার মুখে ওষুধের/গন্ধ রয়েছে, ফিরে আসছি, স্পষ্ট বললে, ভেইয়া...'

সিসিফাস গড়ানো পাথর উপরে তুলছেন, ইন্দ্রনাথের নৌকা ধীরে ধীরে বেয়ে চলেছে অমোঘ সমর্পণের সমুদ্র 'এই শান্তস্তব্ধ ক্ষণে/অনন্ত আকাশ হতে পশিতেছে মনে /জয়হীন চেষ্টার সঙ্গীত,/আশাহীন কর্মের উদ্যম-/হেরিতেছি শূন্যময় শান্ত পরিণাম!/যে পক্ষের পরাজয় /সে পক্ষ ত্যাজিতে মোরে করোনা আহ্বান!' (কর্ণ কুন্তী সংবাদ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

নিউটন আর আইনস্টাইন অঙ্ক কষে চলেছেন কবির কবিতায় সাম্যকণার খোঁজে, চীবর পরিহিত কপিলাবস্তুর রাজকুমার সাম্যবাদী বোধিকে আজও খুঁজে চলেছেন ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে।

এই সমস্ত মিথ্যারা বৃত্তের বাইরে গিয়ে এক ধ্রুবকের মতো স্থির দৃষ্টিতে পাঠকের দিকে তাকিয়ে থাকে। পাঠক চোখ নামিয়ে নেন অথবা বিস্ফারিত চোখে পুরো কবিতাকে এক চুমুকে পান করে নেয়। বদহজম হলে কবির কোনো দায় নেই।

কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদটি কবি সুব্রত সরকারের নিজের সৃষ্টি। একটি বাটির মধ্যে জল নিয়ে তার মধ্যে বিভিন্ন তেল রঙ মিশিয়ে জলের বাটির ঘুর্ণায়মান রঙকে কাগজে ঢেলে, শুকিয়ে, ল্যামিনেট করে তৈরি করেছেন কবি প্রচ্ছদ।


 কবি: সুব্রত সরকার
কাব্যগ্রন্থ: তোমাকে মিথ্যা বলেছি
বইটির প্রকাশক: স্বর্ণাক্ষর, হাওড়া
প্রকাশ কাল: ১৯৯২, জানুয়ারী



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন