দোঁহা

প্রেম সম্পর্কিত একটি উড়োজাহাজ আলোচনা

 


 শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়

পরবাসী হয়েছেন, তবু শেকড় ছেঁড়েনি। চোখ বন্ধ করলে কালবৈশাখী ঝড়ে লাউমাচার পাশের ছোট্ট একটা ফুলের দুলে ওঠা কিংবা সিন্নির বাটি হাতে হাসিমুখে বাড়ি ফেরতা আদুল গায়ের ছেলেটিকে দেখতে পান অলোকপ্রসাদ। আনন্দময়ীর আট চালায় ঢুকলেই সেজোকাকামণি কেমন করে 'নরেণ মাষ্টার' হয়ে উঠতেন। সরু ঝকঝকে বেতকে কথা বলতে দেখতো বিশ্বজিৎ, সমীরেরা। অবসরে বোসপুকুরের বাড়িতে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে সাদা দেওয়ালের গায়ে জাঙ্গিপাড়ার খণ্ড চিত্রগুলিকে একে একে জুড়ে নেন অলোকপ্রসাদ।
এখানে কোনো বড়ো মাঠ নেই কাছাকাছি। হাঁপ ধরে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে খড়পোড়া মাঠ। খেয়াল খুশিতে কলম চালিয়ে একটা এরোড্রাম এঁকে নেন তিনি। একটু বাদেই ওখানে নেমে আসবে জাদু-বাস্তব একটি উড়োজাহাজ। যে মার্টিন লাইট রেলওয়ে ধরে বাবা ফিরে আসতেন কলকাতার বৃষ্টিতে ভিজে, সেই দিকেই ফিরে যাবে এই উড়োজাহাজ। আর অলোকপ্রসাদ নোটপ্যাডে বন্দী করবেন তুরীয় প্রেমের স্মৃতির সনেটগুলি।

বাবা শৈলেন্দ্রপ্রসাদের পাশাপাশি ভেসে ওঠে মায়ের মুখ। কল্যাণী দেবী। মা মানে আদিগন্ত দেওয়াল ঘেরা ঘর। সেই ঘরের কথা প্রসঙ্গে লিখছেন, "সেখানে মা, আমি—তোমার ভ্রূণ—তোমারই খাদক। খাদ্য তুমি। তুমি পূর্ণ করতে থাকো আমাকে। আমার পূর্ণতার জন্যে তুমি দায়ী। আর, তোমার ক্ষয়ে যাওয়ার জন্যে দায়ী আমি, তোমার সন্তান। তুমি আজও অলৌকিক ছায়া মেলে দাও, আশ্রয়ের। অথচ সে শান্তি, সে ঘর থেকে দূরে, কী নিষ্ঠুর জগৎ অক্টোপাসের মতো টানছে। যেন মুক্তি নেই আমার। ঘর নেই। ছায়া নেই।"

ঘর, যা সতত বদলায়। ঘর কখনো ওনার কাছে হয়ে উঠেছে নিজের দেহ রাখার জায়গা, কখনো মোহনের গানের আখড়া, কখনো ভালোমা-র কাপড়ের গন্ধ। যে বন্ধুরা ওঁর জন্য জেগে থাকতো, তারা আসতে চাইতো ঘরে। অলোকপ্রসাদ দেখেছেন কলকাতা নামেই তিলোত্তমা, ভালোবাসাবাসির তেমন জায়গা বুকে ধরে রাখেনি। নির্জনতা পিয়াসী সেই প্রেমিক-প্রেমিকাদের কখনো বারণ করেননি আসতে। ড্যাম্পের গন্ধওয়ালা ঘরে বন্ধুদের ভালোবাসাবাসির ওডিকোলন মিশে যাওয়াই তাঁর নির্জন অর্জন ছিল বোধহয়। মিশন ফেরত অলোকপ্রসাদ বারবার চেয়েছেন মিশনের একশো একুশ বিঘের চৌহদ্দী পেরিয়ে আরো বিপুলতার কাছে পৌঁছতে। কোনো ঘর, কোনো চৌহদ্দী তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। গেয়ে উঠেছেন, "আনন্দময় ভুবন আমার বাইরে খেলা করে"।

এসবের মাঝে কখনো কখনো ফেলে আসা কর্পোরেট ছোবলানো জীবনের কথা মনে পড়ে। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার টানা-পোড়েনের মাঝে মাথার মুকুটটি খুলে রেখে ঢুকতে হয় আপিসে। মুকুট হাতে পুরাতন ভৃত্যের মতো তৃতীয় পুরুষ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রামদীন। ইচ্ছা-বিরুদ্ধ পরিসরের মধ্যে থেকেও স্বপ্রণোদিত ওমকার ধ্বনিটি টিমটিমে পিদিমের মতো জ্বলে থাকে মনের এক কোণে। আলো করে আপিসের উল্টোদিকের গীর্জার যীশু মূর্তি পাদদেশ। অলোকপ্রসাদ ভাবেন ছেড়ে দিলেই হয়, যেখানে মন লাগেনা সেখানে থাকা অসম্ভব। সম্ভব-অসম্ভবের আলোছায়ায় দিন গুজরান হয়। একদিন আপিস হয়ে ওঠে আপোষ। সেদিন মুকুট হাতে রামদীনকে দেখা যায় না আর। সেই মুকুট লিটিল ম্যাগের স্বপ্নে ভর করে সাংবাদিকতার আঙিনায় কড়া নাড়ে।

দেওয়ালের আঙিনায় বায়োস্কোপের ছবি বদলে বদলে যায়। একমুঠো শিউলি ফুল ঝরে পড়ে মাটিতে। শিউলি বড়ো অদ্ভুত ফুল। তাকে কেউ পাড়ে না। সে নিজেই ঝরে পড়ে মা দুগ্গার আলতা পায়ে। ষষ্ঠী পুকুর পাড়ের গাছটি হাত নেড়ে ডাকে। একমাথা শিউলি নিয়ে। সে ডাক অমেয়, অপরাজেয়। প্রতিটি ফুলে একেক কণা শারদ-স্মৃতি। বাবার কিনে আনা একরঙা খদ্দরের জামার রঙের সাথে মিশে যায় আনন্দময়ীতলার একান্নবর্তী সম্প্রীতির নানা রঙ। যাত্রাগান, সিঁদুরখেলার পরে মায়ের মুখের সাথে মিলে যায় প্রতিমার মুখ। অভিমানী শিউলি যেন। কেবল দশমীর গলাব্যথা, বিষণ্ণতার সাথে দশেরার বিজয়োৎসবকে একাঙ্গী করতে পারেননা অলোকপ্রসাদ।

অনেক দূরের বাইক জার্নিতে হঠাৎ ভিউফাইন্ডারে চোখ পড়ে গেলে, ভেতরটা কেমন জানি করে ওঠে। অতল জলে ভাসার কালে যে বলিষ্ঠ হাতটি টেনে তোলে তাকে অলোকপ্রসাদ 'স্যর' বলেন । জীবনের প্রথম শিক্ষক কাকামণিকে কোনোদিন স্যর ডাকতে পারেননি তিনি। সেই আক্ষেপ গ্রন্থিত হয়েছে পাতায় পাতায়। পরবর্তীর পেরেস্ত্রৈকা, স্যর, সেই আক্ষেপ পুষিয়ে দিয়েছেন। যে সাহিত্যচর্চার বীজ আজন্ম লালিত পালিত হয়েছে বুকের গহীনে তাকে খুঁজে পেয়েছেন সেই মানুষটি। সার, জল দিয়ে মহীরুহ করে তুলেছেন। যে সিঁড়িতে পাদস্পর্শ হয়েছে একবার তাকে ভোলা যায় না। সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক শেখাতে শেখাতে স্যর নিজেই কবে শিউলির গন্ধ মাখা সিঁড়ি হয়ে গেছেন অলোকপ্রসাদ বুঝতে পারেননি। সেই স্যর যাওয়ার আগে জানিয়ে গেছিলেন তিনি তাঁর লেখা পড়েছেন। ভালো লেগেছে। এইতো প্রাপ্তি!

জীবন যাপন থেকে জীবন পালনের এক সাবলীল স্বরবিন্যাস এই গদ্য সংকলনের সাড়ে তিন হাত জুড়ে রয়েছে। এর মূল সুর বোধহয় 'আত্মানং বিদ্ধি'। সুর আর স্বরের যে পার্থক্য অলোকপ্রসাদ অনেক আগেই ফিজিক্সের বইয়ে ছেড়ে রেখে এসেছেন এখানেও তার অন্যথা হয়নি। প্রেম, উড়োজাহাজ এবং তাঁর সুরের মধ্যমাত্রয়, সমবিন্দু স্বরে বিলীন হয়ে গেছে।

 

বই: প্রেম অথবা উড়ো জাহাজ সম্পর্কিত
লেখক : অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশনা : সিমিকা পাবলিকেশন



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন