প্রকৃতি ও মেশিনের ধক্
এত শীত! এত তীব্র শীত!
মেশিনও ঘুমিয়ে আছে কাত হয়ে ধানের জমিতে
রাত্রে এসে পেডাল ঘোরায় কেউ! গেরস্থ বা চোর!
তূর্ণগতি কুয়াশায় ভড়কে গেছে লাজুক মেশিন।
বিশ্বাস না হলে তাকে দেখে এসো
যে কোনো গঞ্জের পাশে লেংটা মাঠে, খালপাড়ে, গ্রামে
দাঁতকপাটি লেগে তার দফারফা আজ নিয়ে টানা পাঁচ দিন!
পড়ে আছে লবেজান
ক্রোধে অন্ধ সহিসের হিমশীতল চাবুকের ঘায়ে
শীতের দৈত্যের হাতে গদা আর মুষল-প্রহারে!
জরদ্গব বৃদ্ধ যেন। নিরুত্তেজ!
মেশিন জাগে না আর এই তীব্র শীতে।
ঘুমিয়েছে চিরতরে। কিংবা তার প্রত্যঙ্গ অসাড়।
এসময় দ্যাখো দ্যাখো,
ঘুংড়িকাশি দিয়ে জাগছে পরমা ও প্রকৃতি-মেশিন
জ্বালানি, পেট্রোল, তেল, টনিক-ফনিক তার কিছুই লাগে না
মম প্রিয় বন্ধুগণ
[আশির দশকের কবি-বন্ধুদের জন্য]
মম প্রিয় বন্ধুগণ তপ্ত লাল শলাকা শানায়। আর
রক্তজবা কানে গুঁজে শব্দ করে ভয়ানক হাসে
মাঝেমাঝে বক্ষো’পরে বসে তারা মোর পানে উঁচায় খঞ্জর।
তাদের চেহারাগুলি ঘোর লাগা
লাল আর বিভীষিকাময়
আমাকে তারাই ফের পিঠে নিয়ে চলে বহুদূর।
আমারে তারাই ফের তৃপ্ত করে লেহ্য-পেয়ে, সুরায় আরকে!
দিন ক্রমে নত হয়! সূর্যের গ্রীবা ঢলে পড়ে
যখন সবাই ঘুমে বদ্দিরাজ গাছে এক চোর
মগডালে রুপালি, বর্তুল
সাদা-নীল পরচুলা, উঁচু টুপি, লাল মোজা, কালো মোকাসিন
বিনোদক বাঁশি নিয়ে রাতেই নীরবে তারা আসে;
সময় হলেই তারা অবলীলাভরে
বুকে উঠে দ্রুত হাতে চালায় খঞ্জর!
----(সূর্মাটানা চোখজোড়া প্রপীড়িত অন্ধ খোড়লে!)
রুপালি নদীর জলে ভিস্তি ভরে দল বেঁধে কারা আসে
কারা যায় হেঁটে
মোগলটুলিতে আর আরমানিটোলায়?
--- বৈকালিক পথে-পথে বাজখাঁই হাঁক দিয়ে যায়!
আর আমি, হয়তো চোখের ভ্রম, দেখি:
খাম্বিরা তামাকে তৃপ্ত পুরান ঢাকার সব
রাংতা-মোড়া জানালার কাচ ভেঙে পড়ে
দুই.
এ সময় তুষারঝড়ের গ্রীবা নড়ে যদি সমূহ বিপদ
সুবিস্তীর্ণ স্তেপজুড়ে ঠাণ্ডা হিম করাতের দাঁত
তারপর শান্ত সব। গর্জনেরা নীরব হঠাৎ!
চতুর্দিকে অসীম বরফ আর ধ্বংসরেখা!
পাহাড়ের উচ্চাবচ চূড়া
যেন কোনো বিমর্দিত স্তনের কাফেলা
ঝড় শেষ হওয়া মানে
আকাশে রুপালি তাঁবু ফুলে উঠবে এখন আবার
ধারালো নখের নিচে ঈগলেরা লুকায় শিকার
আর তারা বিপুল ডানার তলে
ছানাদের আগলে রাখে
সুকোমল লোমের আদরে
অপর্যাপ্ত খাদ্যকণা, যবদানা, ঠাণ্ডা মাংস পথে-পথে এখন সম্বল;
মিতব্যয়ী, সচেতন তারা জানে রসদ সামান্য! ----আর
সামনে আরো
লড়াই লড়াই শুধু
লড়াই! লড়াই!!
ঠান্ডা রুটি ধেনো মদ যবদানা তারা তাই ভাগ করে খায়
নিজে খায়, পশুকে খাওয়ায় আর
পালান নামিয়ে রেখে ঘোড়াগুলো ছেড়ে দেয় ঘাসে
ত্রস্তে তারা জড়ো হয়
চমরি গাইয়ের ত্বকে তৈরি এক দড়াটানা তাঁবুর ভিতরে;
মধ্যরাত। বাইরে হু-হু হাওয়ার ঝাপট
তাদের ক্লান্ত হাতে অভ্যাসের তাস জমে ওঠে!
তাঁবুর ভেতরে তারা খুমিশ ঢালছে পেয়ালায়!
তিন.
ক্রূর, বক্র, ভীতিপ্রদ অতিকায় তাদের নাসিকা
গুম্ফ নেড়ে নেড়ে তারা ত্রাহিরবে দুনিয়া কাঁপায়!
তাদের করাল ঠোঁটে রক্ত-চর্বি, ছিন্নমাংস চুনিগাঢ় লাল!
বক্র-শ্যেন-ঘোরলাগা রক্তজবা তাদের নয়ান!
তাদের দু-চোখ থেকে ক্ষণে ক্ষণে ঝরে শুধু
শত শত মৃত্যু আর শব
তারাই আমার সখা
সদাহাস্য তাহাদের কপালে তিলক;
যুদ্ধ আর খুনে-লাল তরবারি দিয়ে তারা ক্রমাগত আমাকে শাসায়!
আস্তিনের ভাঁজ খুলে বের করে খড়্গ-চাকু, জংধরা বাঁকা তলোয়ার
কল্লাবালু দিয়ে তারা, সঙ্গোপনে, ছুরি-কাঁচি ধার দিয়ে চলে
আর আমি ঈশ্বরের প্রিয়তম ভেড়া যেন
প্রতিদিন দিবালোকে বলি হয়ে যাই
কপালের ফেরে হায়, এ-যেনবা শেষ নিশিভোজ
সকলের মধ্যে আমি নীলমণি-যিশু!
নিজের কল্বে আমি কান পেতে রই আর শুনি:
‘পাপাল বুল’-কে ঘিরে টানা দীর্ঘ চারশো বছর
কোটি কোটি মার্জারের অবিরাম মরণ-চিৎকার!
চার.
অভ্রভেদী লাফ দিয়ে ভয়ে আমি অবিরাম দ্রুত উড়ে-উড়ে
শত-শত ক্রুশ আর সূচ্যগ্র শলাকা থেকে নিজেকে বাঁচাই
ক্রমাগত ভিক্ষা করি লক্ষ নিমেষ আর একটি নিমেষ!
আর আমি দুই চোখ মুদে
প্রেমপূর্ণ রিরংসায় মম প্রিয় বন্ধুদের দেখে যেতে চাই:
মধ্যরাত। তাঁবুর ভেতরে তারা
খুমিশ ঢালছে পেয়ালায়!