অন্ধ হাসি
কুয়াশার সমুদ্রে তুমি যাবে?
শীত ভেঙে, গীত ভেঙে আমি যাবো।
পথে যেতে যেতে ভেঙে দেবো বসন্তেরও ছয়টা রাজহাঁস,
তাদের দিঘল গ্রীবা—শিবরঞ্জন যাতনার রোদন।
ময়দানবের সভা দীর্ণ করে যেই বাঁকা জল চলে গেছে চক্রবর্তী কিরীটের বিভায়, সেই জলে সন্তরণ ভেঙে কুয়াশার সমুদ্রে যাবো। শিশুপালের কবন্ধ দেহে পদচ্ছাপ রেখে পার হবো বারোটা সকাল।
আকাশ ঘষে, মাটি ঘষে রং করে নেবো চুম্বনের আগে সকরুণ ওষ্ঠাধর। ঢেউয়ের পাখায়, অথৈ লাবণ্যে উথল শৃঙ্গারের আগে আগে শরীরে ঘষে নেবো বাতাসের শিস। তারপর পরস্পরের নাভীমূলে জিভ বপন করে বন্ধ করে দেবো পৃথিবীর শ্বাস।
এইভাবে আমরা যতক্ষণ মরে রইবো অমরাবতীর পাড়ে,
ততক্ষণ জেনো পৃথিবীও মৃত।
আমাদের প্রাণের পরেই পৃথিবীর প্রাণ—
ফুল, পাখি, নদী, জল, মীন আর শিশুদের অমল কোলাহল এই জেনে তুমি চোখের ভিতর রেখেছো অন্ধ হাসি।
অন্ধ হাসি—আমি ভালোবাসি।
দশ মহাবিদ্যা
রক্ত চিরে আরো রক্তের ভিতর ঢুকে যাও প্রিয় দুর্নিবার, সমুদ্রের তৃষ্ণায় লম্বিত হও, প্রলম্বিত হও পৃথিবীর সকল অরণ্য প্রান্তর আর জলাশয় ঘিরে, ঘূর্ণি হও মৃন্ময় রাত্রির অথির গুহায়।
পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও, জ্বলছে নাকছাবি নক্ষত্রের আত্মজ। চির অগ্নিভুক চিরামরাময় অবরোহণ ভেঙে হিরণ্যগর্ভের উত্থানে মহাশূন্যকে করে দাও লীন, মণিকুন্তলা ও মৃন।
পূর্ণতার প্রান্তে ধীর, অধীর প্রাণের তারে তিনটা ছুরিতে কেটে নাও দীপকের ঝড়, কিছুটা মালকোষ, কিছুটা ছায়ানট। জন্মান্ধ রাত্রির চোখ পড়ে থাক নিষ্পলক, খণ্ডিত পড়ে থাক বাসনার দণ্ডিত সপ্তক। আমাকে ধরো, এই কবন্ধ খঞ্জরে জুড়ে দাও দশানন সুন্দর।
রতি ও ঈশ্বরী মিলে ভুবনের ডাকনাম ধরে ডেকে নাও এই নির্ঝর, কুসুমের পাড় চিরে সে তো চির নির্ঘুম একা অর্ধনারীশ্বর। প্রিয়তম মকরের ধ্যানে উড়ে চলা তার যান গমকে ওঠে দ্রুত লয়ে। চোখের সংহারে তুমি কেটে দিলে ধান, অধীর উত্থানে কাঁপে আরক্তনীল প্রাণ।
চুম্বন ও প্রলোভনের রূপ ধরে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাও। আশ্লেষে আমাকে ডুবিয়ে ফেলো নিঃসীম, তোমার রক্তের অন্তহীন অন্ধকারে। কোথাও ঝরনার খাঁজে গুঁজে দিয়ে প্রাণ প্রার্থনার স্বরলিপি আমি সূর্যের শরীর।
বিবসন বন, নিজেকে ছিঁড়ে, নিজেকে জুড়ে দাও বারংবার। এই আত্মবিনাশে, এই আত্মসৃজনে পেরিয়ে যাও দুইটি পথের দূরত্ব—পথেরা আছে একটা টকটকে লাল ফলের ভিতর। পথেরা তোমার দিগন্তব্যাপী চুল, পেঁচিয়ে রাখে আমার সকল উত্থান, সমুদয় পতন। ফলত আমার শরীর রক্তজবার ফুল।
ধূম্রবতী নিষাদ, জাগো—এমন শ্বাসকষ্টের রাতে। ফুসফুসের ভিতর ঢুকে দীর্ঘশ্বাসকে বানিয়ে দাও অভ‚ত প্রেম, রং ও রেখার অমিয় উৎসার। ওষ্ঠাধরে ধরে ফেলো তোমার কামসন্ধ্যার ছয়টি প্রকার।
সারসী ঘোর প্রিয় সোমরস, জাগো ঈর্ষা ও জিঘাংসার বিপরীতে উত্থিত হোক গান। গানের ভিতর রক্তাক্ত শৃঙ্গার। আর মাইল মাইল পড়ে থাক অঙ্গার। আসো, চঞ্চু দিয়ে চিরে দাও এই অমর যকৃত ও হিরণ্ময় পরমায়ু।
আমাকে সমস্ত নিয়ে নাও, ভেঙে পুর্নবার বানিয়ে দাও তোমার অভীপ্সার মাপে। আর রক্ত চিরে ঢুকে যাও রক্তের ভিতর চিরদিন, চিরদিন। রক্তের উপপাদ্যে বুনে দাও সুতীব্র রতি ও দংশনের বৃক্ষ।
কমলাকামিনী হে, ডানাভাঙা রাত্রির ক্ষরণ, আমাকে নাও। পুনর্বার করতলে ধরে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলো, অতঃপর ছুড়ে ছড়িয়ে দাও আরো আরো পৃথিবীরে পেটে ও শকটে, এই লাল, এই জরাসন্ধ অনুধ্যান।