দোঁহা

টেরাকোটার মন্দিরফলকে কালী

 


অরুন্ধতী দাস

কালীমূর্তির কল্পনায় অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে শব, শিব এবং শিবার সমন্বয়। অথচ, এই মূর্তির উৎসের ইতিহাস একটু খুঁজে দেখলেই বোঝা যাবে, কালীর সঙ্গে শিবের এই সমাহার, এ একেবারেই বাঙালির নিজস্ব কল্পনা। বৃহদ্ধর্মপুরাণের কাহিনি বলে, পিতৃগৃহে গমনোদ্যতা দেবীকে বাধা দেওয়ায়, শিবের ওপরে প্রচণ্ড রাগে দেবীর তৃতীয় নয়ন থেকে আবির্ভূতা হন কালী। তাঁর ভয়ংকর রূপে দিশাহারা শিব পালানোর চেষ্টা করেন। পলায়নপর শিবকে ভূতলে, বিশেষত পদতলে শায়িত করে ফেলার কোনো উদ্যোগ কিন্তু এই কালীর নেই। মার্কণ্ডেয়পুরাণ, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ কোথাওই কিন্তু শিবোপরি আবির্ভূতা কালীর কথা পাওয়া যায়নি। অথচ, বৃহৎতন্ত্রসারে দেবী কালিকার রূপবর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হল—"শবরূপমহাদেবহৃদয়োপরি সংস্থিতাং। শিবাভির্ঘোরিরাবাবিশ্চতুর্দ্দিক্ষু সমন্বিতাং। মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাং। "অর্থাৎ এই কালী শিবের বুকের ওপরে দাঁড়িয়ে, আবার মহাকালের সঙ্গে বিপরীত বিহারে রত। কিন্তু বিপরীত বিহাররত দেবীর মূর্তি বাংলায় একেবারেই চোখে পড়ে না। এমনিতেই রক্ষণশীল বাঙালির স্পর্শকাতরতার কারণে বাংলার টেরাকোটা মন্দিরগুলিতে রমণরত মূর্তি, যুগনদ্ধ মূর্তি বা সঙ্গমভঙ্গির বিভিন্নতা প্রায় দেখাই যায় না, যা ভারতের অন্যান্য মন্দিরগাত্রে বিষয়বৈচিত্র‍্য এবং আঙ্গিকগত বহুরূপতার দিক দিয়ে যথেষ্ট নজর কাড়ে। তবে প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত তাঁর 'প্রত্নভাস্কর্যে দেবদেবী' বইতে এ প্রসঙ্গে লিখছেন, "নবদ্বীপে শবশিবা নামে এক ধরনের মূর্তি রাস উৎসবের সময়ে নির্মিত হয়। সেগুলিতে মহাকাল এবং কালীর বিপরীত বিহারের ইঙ্গিত লক্ষ করা যায়। নবদ্বীপেই পোড়ামাতলা নামে খ্যাত মন্দিরে শিবের বুকের ওপর বসে থাকা কালীর মূর্তি পুজো করা হয়।" শিবের বুকের ওপরে রীতিমতো এক পা তুলে, অন্য পা ঝুলিয়ে বসে-থাকা এই কালীমূর্তির দেখা অবশ্য মেলে বর্ধমানের কালিকাপুরের মন্দিরে, যদিও অজ্ঞতাপ্রসূত যত্নের বিড়ম্বনায় মূর্তির ওপরে এত হোয়াইটওয়াশ এবং রঙ একেবারে চুনকামের আদলে লেপে দেওয়া হয়েছে যে, মূর্তিটির সূক্ষ্মতা আর বজায় নেই, খাঁজগুলি প্রায় সবই বুজে এসেছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, এই বিশেষ ইঙ্গিতটিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সযত্নে এড়িয়ে গেলেও বাংলার টেরাকোটা মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির ফলকে কালীমূর্তির প্রাধান্য কিন্তু চোখে পড়ার মতো।

কালিকাপুরের মন্দিরের গায়ে শিবোপরি আসীন কালীমূর্তি


বিষয়টি মন্দিরবিশেষজ্ঞদের চমৎকৃত করেছে বারবার। কারণ, বাংলায় বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত তিন প্রকার মন্দিরই দেখতে পাওয়া গেলেও, মূলত পীঠস্থান মন্দিরগুলি ব্যতিরেকে, আলাদা করে শুধু শাক্ত মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রবণতা বাংলায় তুলনামূলক কম। তা সত্ত্বেও, টেরাকোটা ফলকে কালীমূর্তি যে অপ্রতুল নয়, তার মূল কারণ, বাংলায় মন্দির অলংকরণের ক্ষেত্রে মন্দিরের ইষ্টদেবতা নির্বাচনের কোনো পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল না। বরং টেরাকোটা মন্দির দেখার সাধারণ অভ্যাসটুকু থাকলেই যে-কোনো অবিশেষজ্ঞ দর্শকও খেয়াল করতে পারবেন যে, কিছু ব্যতিক্রম বা বিশিষ্টতার কথা বাদ দিলে, নির্দিষ্ট কয়েকটি মোটিফই বেশিরভাগ মন্দিরে ঘুরেফিরে এসেছে বারবার। দশাবতার, রামের রাজসভা, রাম-রাবণের যুদ্ধ, মহাভারতের টুকরো কাহিনি, কৃষ্ণলীলা, মৃত্যুলতা, অশ্বসিংহ বা 'Yali' এবং অবশ্যই দশমহাবিদ্যা ও কালিকামূর্তি। সপ্তদশ শতকের মন্দিরের তুলনায় কিন্তু অষ্টাদশ বা ঊনবিংশ শতকের মন্দিরগাত্রে কালিকামূর্তি সমন্বিত ফলক বসানোর চল বেশি দেখা যায়।

এই প্রসঙ্গে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য, কারণ লোকশ্রুতি অনুযায়ী ঘরে ঘরে গার্হস্থ্য পূজার অঙ্গ হিসেবে কালীপূজার প্রচলন তিনি করেছিলেন রাজাদেশ বলবৎ করার চিরন্তন ঢঙে— প্রজারা কালোপূজা না করলে রাজদণ্ড ভোগ করতে হবে, এই ঘোষণার ফলে দীপান্বিতা কালীপুজোতে নদিয়ায় দশহাজার কালীমূর্তি পুজো হয়েছিল, এ কথা শোনা যায়।

কালীপূজার জনপ্রিয়তার আর-একটি সূত্র অবশ্যই বাংলায় তন্ত্রসাধনার প্রভূত চর্চা। নীহার ঘোষ তাঁর 'Temple Art of Late Medieval Bengal' গ্রন্থে লিখছেন: "During medieval period Bengal emerged as a principle centre of the tantric cult of Sakta worship. J. N. Banerjee in his Dacca History of Bengal, Vol-1 (chapter 13th) has dealt with various historical evidences in the form of numerous sculptures excavated from various architectural sites, supporting such views. The spirit and mystic spells of 'Sakti' is also manifested in the annexation of the images of the goddess to the supreme divinities like Vasudeva Krishna and Siva for the purpose of worship. The post medieval phase of the image worship in Bengal witnessed efflorescence of the cult of Kali, the icons and canonical prescription of which in the present form were conceived by the Tantric saints of Bengal."

কথিত আছে, বাংলায় কালীপূজার প্রচলন হয়েছিল কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের হাত ধরেই। চৈতন্যের প্রায় সমকালীন এই শাক্তসাধকের কল্পিত ‘ত্রিভঙ্গ কৃষ্ণবর্ণা’ কালীমূর্তির ধরনটিই আধুনিক কালীমূর্তির ক্ষেত্রে গৃহীত হয়েছে। ঠিক এই মূর্তির আদলই পাওয়া যায় মেদিনীপুরের কেশপুরে লক্ষ্মী বরাহ মন্দিরে এবং দাঁতনের দামোদরপুরে মহাপাত্র পরিবারের টেরাকোটা দেউলটিতে।

বীরভূম এবং বর্ধমানের মন্দিরেও দশমহাবিদ্যা এবং সেই সূত্রে কালীমূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। শ্রীবাটির পঞ্চরত্ন মন্দির, মানকড়ের রেখদেউল, বর্ধমানের আউশগ্রাম এবং বনকাটির বেশ কয়েকটি মন্দিরেই হয় মূল তোরণের ওপরে কেন্দ্রীয় প্যানেলে কিংবা পার্শ্ববর্তী অলংকরণে কালীর মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। পুরুলিয়ার চেলিয়ামা এবং বাঁকুড়ার শ্যামরায় মন্দিরেও মেলে টেরাকোটায় কালীমূর্তি ফলক। তবে, কালীমূর্তির বৈচিত্র্যে অবশ্যই আলাদা করে নজর কাড়ে বীরভূমের টেরাকোটা মন্দিরগুলি, যেগুলি বেশিরভাগই তৈরি হয়েছে আঠেরো এবং উনিশ শতকে। ঘুড়িষার রঘুনাথ মন্দিরে পাওয়া কালীমূর্তিটির সঙ্গে আশ্চর্য অবয়বগত সাদৃশ্য রয়েছে পুরুলিয়ার চেলিয়ামার মন্দিরের মূর্তিটির, দুটি ক্ষেত্রেই কালীর মাথায় ভারী মুকুট; কালীর গোটা অবয়বটি সামনের দিকে ফেরানো হলেও মুখের ক্ষেত্রে ডানদিকের প্রোফাইল ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একপেশে মুখ গড়ার মূল কারণ অবশ্য লুকিয়ে আছে মুখ থেকে বেরিয়ে-আসা জিভের কারিকুরিতে। কারণ, দুটি ক্ষেত্রেই বেরিয়ে আসা দীর্ঘাকৃতি জিভ লেহন করছে বাঁ-হাতে ধরে রাখা নরমুণ্ডটিকে। বাঁ-পা ভাঁজ করে এবং ডান পা টানটান করে ধ্বংসলীলার পথে এগিয়ে যাওয়ার মুদ্রাটিও দুটি মূর্তির ক্ষেত্রেই এক। উপরন্তু দুটি মূর্তিতেই কালীর মুখভঙ্গিতে দৈবী ভাবের আভাস প্রায় নেই, বরং বীভৎস পৈশাচিক করাল মুখব্যাদান ভয়াবহ করে তুলেছে তাঁকে

ঘুড়িষার মন্দিরে কালীমূর্তি

পুরুলিয়ার চেলিয়ামা মন্দিরগাত্রে কালী     

 

ঘুড়িষারই অন্য আর-একটি লক্ষ্মী জনার্দন মন্দিরে পাওয়া কালীমূর্তিটিতে কিন্তু এই বীভৎসতা নেই। আঠেরো এবং উনিশ শতকের টেরাকোটা মন্দিরগুলির অলংকরণের ধাঁচ মেনেই এখানেও অবয়বের মধ্যে বর্তুল পেলবতা অনেক বেশি লাবণ্য এনে দিয়েছে। এমনকি এই একই মন্দিরে পাওয়া ছিন্নমস্তা মূর্তিটিও তুলনায় একেবারেই ভয়াবহ নয়।

ঘুড়িষার লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দিরগাত্রের কালীমূর্তি

ঘুড়িষার লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দিরগাত্রের ছিন্নমস্তামূর্তি

ইলামবাজারের বামুনপাড়ার একটি টেরাকোটা মন্দিরগাত্রে আবার সিংহবাহনা কালীমূর্তির দেখা মেলে, কালীর পদতলে শিব এখানে অনুপস্থিত, ইলামবাজারের হাটতলার মন্দিরের কালীমূর্তিতেও যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই মন্দিরটির প্রায় সমস্ত টেরাকোটা ফলকই ছোট্ট চৌখুপি কুঠুরির মধ্যে বসানো। ফলে, স্থান সংকুলানের সমস্যা মেটাতে ফলকে ফুটিয়ে তোলা বেশিরভাগ অবয়ব কোনাকুনি চৌখুপির কর্ণ বরাবর একটু বাঁকিয়ে বসানো হয়েছে, যাতে সামান্য হলেও বেশি জায়গা পাওয়া যায়। টেরাকোটা ফলকগুলিতে ত্রিমাত্রিক একটা আদল আনার জন্য বহুক্ষেত্রে মূর্তিগুলির মাথা সামান্য বেরিয়ে এসেছে চৌখুপি থেকে, একটু উঁকি মারার কায়দায়। একেবারে একই রকম রীতি অবলম্বনে তৈরি বেশ কিছু ফলক দেখা যায় হুগলির গুপ্তিপাড়ার প্রতাপেশ্বর মন্দিরেও।

ইলামবাজার বামুনপাড়ার মন্দিরে সিংহবাহনা কালীমূর্তি  


ইলামবাজার হাটতলা মন্দিরের শিবহীন কালী

হুগলির আর-একটি বিখ্যাত টেরাকোটার মন্দির, আঁটপুরের মন্দিরেও অপূর্ব একটি পোড়ামাটির কালীফলক দেখা যায়। কালীমূর্তির মাথার চারপাশে প্রভাছটা তৈড়ি হয়েছে পদ্মপাপড়ির সৌষম্যের আদলে, গলার নরমুণ্ডমালা এবং কোমরের নীচ থেকে ছড়িয়ে থাকা কেশরাশির অতি সুবিন্যস্ত পারিপাট্য আর সৌন্দর্যও লক্ষ করার মতো।


হুগলির আঁটপুরের রাধাগোবিন্দ মন্দিরের কালীমূর্তি

আর-একটি বিশেষ ধরনের কালীমূর্তির দেখা পাওয়া যায় পূর্ব মেদিনীপুরের আলঙ্গিরী এবং বর্ধমানের মৌখীরার আটচালা মন্দিরে। অবশ্য এ ঠিক কালী নয়, বরং কালীরূপী কৃষ্ণের মূর্তি।


মেদিনীপুরের আলঙ্গিরী মন্দিরের কৃষ্ণকালী

 
বর্ধমানের মৌখীরার মন্দিরে কৃষ্ণকালী

কৃষ্ণরাধার গোপন সাক্ষাতের খবর পেয়ে আয়ান ঘোষ সেখানে উপস্থিত হলে, মায়াপটু কৃষ্ণ কালীভক্ত আয়ান ঘোষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে এই রূপ গ্রহণ করেন। বস্তুত এই কাহিনি এবং এই প্রতিরূপ বাংলায় শাক্ত বৈষ্ণব সমাহারের এক আশ্চর্য নিদর্শন। একে ঠিক সমন্বয় বলা যায়, নাকি শাক্তপূজারও ওপরে কৃষ্ণপূজার আধিপত্য স্থাপনার উদাহরণ এই কালীরূপী কৃষ্ণের অবয়ব তা আজ আর বলা মুশকিল। তবে বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের গায়ে বাঙালির নিজস্ব গল্প বলার ঢঙে বারবার যে মর্তপৃথিবীর উপস্থাপনা উঠে এসেছে, তাতে একটি কথাই বারবার মনে পড়ে—

দেবতারে মোরা আত্মীয় জানি, আকাশে প্রদীপ জ্বালি,
আমাদেরি এই কুটিরে দেখেছি মানুষের ঠাকুরালি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন