![]() |
প্রচ্ছদ. মরজানে সতরপির 'পার্সেপোলিস' |
পিয়া সরকার
"ওই কূপে ঝাঁপ দিলে মৃত্যু নিশ্চিত
এ কথা জেনেও আমি উঁকি দিই, রামধনু দেখি…"
বড় অদ্ভুত সময়ে বসে এই লেখাটি লিখছি। আমি যে দেশের মানুষ, সে দেশের মহাকাব্যে যাঞ্জসেনী তাঁর অপমানের প্রতিক্রিয়ায় আজানুলম্বিত কেশদাম বাঁধতে অস্বীকার করেন। বিদিশার নিশার মতো মনোলোভা না হয়ে, দেবনন্দিত কেশরাজির অধিকারিণী, বিরুদ্ধ ক্ষত্রিয় রাজাদের জীবনান্ত ডেকে আনেন–সর্বঘোষিরা কৃষ্ণা নিনীষুঃ ক্ষত্রিয়ান ক্ষয়ম্। সুদূর মধ্যপ্রাচ্যে বাইশ বছরের মাহসা আমিনির বন্দীদশায় মৃত্যুতে, শত শত যাঞ্জসেনীরা ইরানের রাজপথে নেমে এসেছেন। সামান্য কটি চুলের গোছা, যা হিজাবের বাইরে বেরিয়ে এসেছিল ব'লে মাহসা আমিনি, ইরানের নীতি পুলিশ—'কমিত'-এর হাতে তাঁর প্রাণ হারিয়েছেন, সেই চুলই হয়ে উঠেছে নারীবিদ্বেষী রাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে উড়তে থাকা নিশান। একই সময়কালে, হয়ত বা সমাপতনই হবে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যুগান্তকারী এক রায়ে, গর্ভপাত সম্বন্ধীয় আইনে বৈবাহিক ধর্ষণকে ধর্ষণ বলে গন্য করতে হবে বলে জানিয়েছেন। গর্ভাশয়ের উপর নারীর অধিকারের স্বীকৃতিস্বরূপ এই রায় চূড়ান্ত নারীক্ষমতায়নের পথে আমাদের এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দুর্ভাগ্য এটাই, যা নারীর স্বাভাবিক অধিকার হওয়া উচিত, তা সামাজিক মৌলবাদের প্রকোপে পড়ে দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল। তবে, কাগজে কলমে যে রায় এসেছে, তা এবার মেয়েদের সামাজিক বলয়ে প্রয়োগ করে দেখাতে হবে—স্বীকৃতি থেকে স্বাধিকার প্রাপ্তির সেই পথটি লম্বা এবং দুরূহ। ঠিক এখানেই, ইরানের মেয়েদের আন্দোলন দেশ-কালের গণ্ডি পেরিয়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
ইরান আমাদের দেখিয়েছে যে 'অনুমোদিত' অধিকার থেকে 'স্বাধিকার'-এর পথে হাঁটতে, রাষ্ট্র এবং সমাজের বিপ্রতীপে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে, এবং ইচ্ছা বা অনিচ্ছার দ্বিধা দূর হওয়ার অনেক আগেই এক ঝাঁক গুলির সামনে বুক পেতে দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি রাখছে মেয়েরা। প্রতিটি মেয়ে যে আজ বা ভবিষ্যতে নিজস্ব অধিকার অর্জনে পথে নেমেছে তাকে বিরোধের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পুরুষতন্ত্রের বাইরে গিয়ে ইরানের মেয়েরা নিজেদের হাতে তৈরি পালটা একটি তন্ত্র গড়ে তোলার সাহস দেখাচ্ছে। স্পর্ধিত, চমৎকৃত এবং শিহরিত হচ্ছি এই দেখে যে ইরানের প্রায় আশিটি শহরে, ১৯৭৯-এ গঠিত ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরানের চাপিয়ে দেওয়া বাধ্যতামূলক হিজাবের নিয়মকে নাকচ করতে দলে দলে মেয়েরা পথে নেমেছে। মাহসা কি তবে বিস্ফোরণের ঠিক আগের মুহূর্তে অগ্নিসংযোগের কাজটি করেছেন? নাহলে, কোথা থেকেই বা এলো এই বিপুল আত্মবল, যার পোষাকি নামটি হল 'সিস্টারহুড'? এর উত্তর পেতে গেলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে।
ঘোষিতভাবে উপনিবেশ না হলেও, গত দুই শতাব্দী ধরে, ইরান দেশ হিসেবে বিদেশী ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাবমুক্ত ছিল না। ১৯০৫-১১ এই সময়কাল জুড়ে ইরানে সাংবিধানিক পরিকাঠামো বদলে ফেলার দাবিতে যে বিপ্লব হয়েছে, দুনীর্তিগস্ত খাজার (Qazar) রাজবংশের (১৭৯৬–১৯২৫) শাসন থেকে ইরানকে মুক্ত করে, ব্রিটিশ এবং রাশিয়ার প্রভাব ও অনধিকারপ্রবেশমুক্ত একটি আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলাই তার মূল লক্ষ্য ছিল। এই সময়ে ইরানে কিছু স্বতন্ত্র নারীবাদী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, যারা ইরানের রাষ্ট্রনীতিতে বিদেশীদের নাকগলানোর সরাসরি বিরোধিতা করে। কিন্তু প্রায় ওই সময় অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকেই, ঔপনিবেশিক শক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে, এই দুই পরস্পরবিরোধী মতামতের পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে একটি জায়গায় মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই দুই দলই লিঙ্গসচেতনতার ধারণাকে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, প্রগতি, জাতীয়তাবাদ, আধুনিকীকরণ এবং সামাজিক নবজাগরণের সঙ্গে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দেয় যে, জাতীয় ইস্যুগুলির থেকে লিঙ্গভিত্তিক স্বাধীনতার প্রশ্নগুলিকে আলাদা করে চিহ্নিত করার কোনো উপায় থাকে না। বৃহত্তর স্বার্থে, নারীপ্রগতি ও উন্নয়নের প্রশ্নগুলিকে পিছনের সারিতে মুখ লুকোতে হয়, যার ফলাফল পরবর্তী প্রজন্মকে ভুগতে হচ্ছে।
রেজা শাহ পহলভির রাজত্বকালে (১৯২৫-৪১) আমরা ইরানকে রাষ্ট্র হিসেবে বেশি, দেশ হিসেবে কম গড়ে উঠতে দেখি। অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ এবং বিপুল সৈন্যবল, আধুনিক রাষ্ট্রের এই তিন বহুল ব্যবহৃত যন্ত্রের প্রয়োগ, ইরানের ক্ষেত্রেও যথেচ্ছভাবে হয়েছে। বর্তমান ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরানের শ্বাসরোধকারী মৌলবাদকে বুঝতে গেলে, তার রাজনৈতিক পূর্বসূরীদের ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। ইরানের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদলও অবদমন বা বাধ্যতামূলক শর্ত আরোপের গ্লানি থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারেনি। পহলভির শাসনকালের আগে পর্দাপ্রথার বিলুপ্তি, একমাত্র এলিট শ্রেনীর মহিলাদের দাবি ছিল। ১৯৩৬ এ পহলভি বাধ্যতামূলকভাবে পর্দাপ্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। তাঁর আদেশে, ইরানি পুলিশ, হিজাব পরিহিত মহিলাদের সঙ্গে উগ্র এবং হিংসাত্মক ব্যবহার করে। বহু জনসমাবেশে জোরজবরদস্তি হিজাব খুলে ফেলতে বাধ্য করা হয়। বস্তুতঃ, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে গোঁড়া ধর্মীয় অনুশাসনে আবদ্ধ ইরানকে দেখলে বোঝা যায় যে হিজাব পরিধান বা বর্জন এই দুই বিকল্পই মহিলাদের উপর বিভিন্ন সময়কালে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। 'স্বেচ্ছা' শব্দটির মাহাত্ম্য স্ব-ইচ্ছায় অনুধাবন না করলে সেটি মুক্তি হতে পারে না, বরং কোল্যাটেরাল ড্যামেজ হিসেবে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি–এটা যুগে যুগে রাজনীতিবিদরা ভুলে গেছেন। পহলভিও তাঁর শাসনকালে সাংবিধানিক পরিমার্জনের ছুতোয় এমন একটি রাষ্ট্র গড়ে তুললেন—যেখানে মেয়েরা অতিকাঙ্ক্ষিত ভোটদানের অধিকার তো পেল, কিন্তু তাঁদের শরীর এবং যৌনচেতনাকে 'রক্ষা' করার গুরুদায়িত্ব ছেলেরা তুলে নিলেন। ঐক্যবদ্ধ এবং অখণ্ড রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার পিছনে এ এক সামান্য আত্মবলিদান!
এর পর এল ১৯৫১ সাল; ব্রিটেন ও আমেরিকার সঙ্গে ইরানের হানিমুন পর্বের অন্তিমলগ্ন। ইরানের তেল শিল্পকে জাতীয়করণ করার খেসারত দিলেন জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী মোহম্মদ মোসাডেক। ক্যু-ডেটার মাধ্যমে তাঁকে তাঁর গদি থেকে উৎপাটিত করা হলো। এই ঘটনার দশ বছর আগেই অবশ্য, প্রেসিডেন্ট রেজা শাহ পহলভিকে গদিচ্যুত করে তাঁর আসনে বসানো হয়েছে মহম্মদ রেজা শাহকে। মোহাম্মদ শাহের শাসনকালে (১৯৪১–৭৯) চরম দুর্নীতি, স্বৈরাচার, বিরোধীপক্ষের কণ্ঠরোধ আর মৃত্যুদণ্ড দেখেছে ইরান। আবার এই শাহের রাজত্বকালেই স্বাধীন নারীবাদী আন্দোলনের একটা ধারা গড়ে ওঠে, যা শাসকের রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত ছিল না। যদিও ইরানের প্রধান নারীবাদী সংগঠন, উইমেনস অর্গানাইজেশন অফ ইরান, শাহের ভ্রান্ত রাষ্ট্রনীতির বাইরে বেরিয়ে এসে বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেনি। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত যে আন্দোলন গড়ে উঠছিল, তা গণ-আন্দোলনের চেহারা নিল ১৯৭৯ সালে। মহম্মদ শাহকে গদিচ্যুত করার পরপরই ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরানের উত্থান এবং মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত দেখা যায়। আপাতভাবে ইসলামি মৌলবাদের আগ্রাসন মনে হলেও, এর শিকড়, পুঁজিবাদের হাতে অর্থনৈতিকভাবে নিপীড়িত দেশটির অনেক গভীরে প্রোথিত। দুর্ভাগ্যবশতঃ ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর, সেই পুঁজিবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে, ইসলামিক রাষ্ট্রগুরুরা ইরানের সমাজকে মৌলবাদের শিকল পরানো ছাড়া আর কোনো সমীচিন সমাধান খুঁজে পাননি। ('Hijab became the anti-imperialistic face of Iran'–Moqadem,1985)
এই প্রসঙ্গে, আয়াতোল্লা খোমেইনি, ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে, এক মহিলা জমায়েতের উদ্দেশ্যে যে ভাষণটি দেন তার থেকে কিছু অংশ সরাসরি তুলে দেওয়ার প্রলোভন সামলাতে পারছি না—"The repressive regime of the Shah wanted to transform our warrior women into pleasure-seekers, but God determined otherwise. They wanted to treat woman as a mere object, a possession, but Islam grants woman a say in all affairs just as it grants man a say.”
খোমেইনি, উপনিবেশ-বিরোধী নতুন ইরানে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে জনমত তৈরি করতে পেরেছিলেন, তার আলোকে নারীর অস্তিত্ব এবং গুরুত্বকে নতুন ভাবে বিশ্লেষণ করলেন। প্লেজার-সিকার অর্থাৎ আনন্দ-সন্ধানী নারী সমাজের কলঙ্ক স্বরূপ, অতএব খোমেইনি ইরানি মহিলাদের লিঙ্গসাম্যের অধিকারের নামে যে শরবতটি পান করতে বাধ্য করলেন, তাতে দেখা গেল ইরানি মহিলাদের অস্তিত্ব পরিবারতন্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল। ধার্মিক অনুশাসনের নামে, মহিলাদের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হল। সর্বক্ষণ হিজাব পরা ছাড়াও একা বিদেশভ্রমণের উপরেও নিষেধ আরোপিত হল। পরিবারের অনুমতি ছাড়া পাসপোর্ট ইস্যু করা বন্ধ হয়ে গেল। একাধিক ভিডিও প্রকাশ্যে আসল যাতে দেখা গেল বলপূর্বক মহিলাদের হিজাব পরতে বাধ্য করা হয়েছে। পুরুষের ক্ষেত্রে বহগামিতা সিদ্ধ হলেও, নারী কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র বাদে 'তালাক' দেওয়ার অধিকার হারালো। স্বামী তালাক দিলেও, সম্পত্তি এবং সন্তান এই দুইয়ের উপর নারীর কোনো অধিকার থাকল না। পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় মেয়েরা অর্ধেক অংশের ভাগীদার হবে, এমন নিয়ম হল। এমনকি, পরিবারের পুরুষ অভিভাবকের সই ছাড়া মেয়েদের শরীরে অস্ত্রোপচার নিষিদ্ধ হল। একসময় ইরানের ইউনিভার্সিটিগুলিতে মেয়ে পড়ুয়ার সংখ্যার ছিল পুরুষের থেকে বেশি, ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরানে বহু বিষয়ে পড়ার সুযোগ থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করা হল।
এই সব বিধিনিষেধের প্রতিবাদে, সমগ্র দেশ জুড়ে এখনকার মতো সার্বিকভাবে না হলেও, গোটা তেহরান জুড়ে সেবারও মেয়েরা পথে নেমেছিলেন। উপনিবেশোত্তর ইরানে সত্যিকারের অধিকারের পাওয়ার লক্ষ্যেএই প্রথমবার মেয়েরা একত্রিত হলেন। দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করে সেই প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে খামেইনি সরকার দমন করলেও, এই সম্মুখ সমরের প্রত্যক্ষ পরিণামে তৈরি হয়েছিল ও.এম.এস.সি–ওয়ান মিলিয়ন সিগনেচার ক্যাম্পেন টু এন্ড ডিসক্রিমিনেটরি 'ল। দশ লাখ সই সংগ্রহ করে পার্লামেন্ট থেকে নারীর সমানাধিকার ছিনিয়ে আনাই এই ক্যাম্পেনের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে উঠল। নারীবাদের মুখ হিসেবে উঠে এল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নাম। ১৯৯০ সালে তারজিক স্কোয়ারে, বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরোধিতা করে নিজের গায়ে আগুন দিলেন হোমা দারাবি। ২০০৩ সালে নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল প্রাইজ পেলেন মানবধিকার কর্মী, এবং আইনজ্ঞ শিরিন এবাদি। শিরিনকে তাঁর কাজকর্মের জন্য বহু আগেই দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল ইরান সরকার। ২০১০ সালে দেশ ছাড়লেন নারী-অধিকার কর্মী মাহাবৌবেহ আব্বাসঘোলিজাদে। দেশে ফিরলে আড়াই বছরের কারাবাস এবং তিরিশটি বেত্রাঘাতের খাঁড়া ঝুলছিল তাঁর ঘাড়ে। ইউ.কে এবং ইউ.এস.এ বসবাসকারী ইরানি মহিলারা দেশের বাইরে থেকেই ও.এম.এস.সি ক্যাম্পেন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ইতিমধ্যে একাধিক সরকারের বদল ঘটেছে ইরানে; ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ এই নয় বছরে খাতামির রাজত্বকালে, মহিলারা কিছুটা স্বস্তি পেলেও, সদ্যপ্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আহমেদিনিজাদ বা ফিলহালের ইব্রাহিম রাইসি সরকারের আমলে মেয়েদের পরিস্থিতি জটিলতর হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়াবহ আর্থসামাজিক পরিস্থিতি; পাশ্চাত্য দেশগুলি দীর্ঘদিন ধরে ইরানের উপর যে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, পরমাণু চুক্তি নিয়ে আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে যে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে, ইরানি সমাজের সর্বস্তরে সরকারের ব্যর্থ অর্থনীতির প্রতি যে বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে, ডলারের তুলনায় ইরানি রিয়ালের মূল্য যেভাবে প্রতিমাসে কমছে (গত মাসেই আট শতাংশ পতন) সেগুলি নিয়ে সচেতনভাবে ভাবলে মেয়েদের সাম্প্রতিক দলগত বিক্ষোভে শুধুই নারীবাদ কাজ করছে বলে মনে হয় না। অন্তত গণআন্দোলনের এই ব্যপ্তি এবং তাতে লিঙ্গ নির্বিশেষে সমাজের নানা স্তরের মানুষের যোগদান এ কথাই প্রমাণ করে, দীর্ঘদিনের বঞ্চনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আই.সি.ইউতে চলে যাওয়া একটি রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের ক্ষোভ ও হতাশা। জার-জেন্দেগি-আজাদির স্লোগানের পাশে অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছে নো টু ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরানের মত স্পর্ধিত ভাষা।
ইরানের সরকার স্বাভাবিকভাবেই এই বিক্ষোভ দমনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যাহত করে, প্রতিবাদীদের উপর দৈহিক বলপ্রয়োগ করে, কোনো কোনো পরিস্থিতিতে হত্যা করে প্রতিবাদের কণ্ঠগুলিকে চেপে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইরানের বিদেশমন্ত্রী তাঁর বয়ানে জানিয়েছেন যে মূলতঃ পাশ্চাত্য দেশগুলির আস্কানিতে ইরানের বিক্ষোভ লাগামছাড়া হয়ে উঠছে। সঙ্গে এটাও জানিয়েছেন যে কোনো পরিস্থিতিতেই বিক্ষোভকারীরা ইব্রাহিম রাইসি সরকারকে গদিচ্যুত করতে পারবে না। শাসকের একগুঁয়েমির বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাঁদের প্রতিবাদ, বিক্ষোভের ফলাফল দেখার জন্য অধীর অপেক্ষায় আছেন ইরানের সাধারণ মানুষ। অপেক্ষায় আছি আমরাও। 'আগুনের-কপাট-খোলা সব কটি চুল্লি' একসঙ্গে জেগে উঠলে, সবকটি আঙুলের মুখ শাসকের দিকে ঘুরে গেলে, ভোর আসতে কী আর বেশি দেরি হয়!
কৃতজ্ঞতা:
অ্যাক্সিস অফ হোপ–ক্যাথরিন-জেড-সামে
মল্লিকা সেনগুপ্ত, অমিতাভ দাশগুপ্ত
অশোক মুখোপাধ্যায়