দোঁহা

ছোটোগল্প ও একটি প্রোপাগান্ডা

 


সব্যসাচী মজুমদার

১.
ভূমিকায় লিখছেন গোপাল হালদার,

"মনে হয়েছে ঋত্বিকের শিল্প প্রয়াস বহুমুখী হলেও তার প্রধান ক্ষেত্র বোধহয় মানুষের প্রতি মমতায় প্রভূততম মানুষকে আপনার কাছে কাছে পাবার আগ্রহেই -চলচ্চিত্র।"

তারপরেই ছোটোগল্পগুলিকে একটা কাল ধারণকারী প্রয়াসে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। অবশ্য কোন শিল্পই না তার স্বকালকে ধারণ করে! স্বকালকে ধারণ না করতে পারলে তা শিল্প পদবাচ্য কিনা-এ বিষয়ে তর্কের অবকাশ থাকে। স্বকাল একটা সামগ্রিক সময়ের অংশ হতে চাওয়ার প্রবণতাতেই শিল্পে অংশ নেয়। তবে গোপাল বাবু কিন্তু নিশ্চিতভাবেই একটি নির্দিষ্ট সময়কে চিহ্নিত করে বলছেন, ঋত্বিক খণ্ডে খণ্ডে তাঁর ছোটোগল্পে ধরে রেখেছেন সেই গণনাট্যের কাল। সেই প্রথাবিরোধীতার কালকেই দেখতে পান গোপাল বাবু সতেরোটি ছোটোগল্পে।

এই অতিপ্রজ সময়ে মাত্র সতেরোটা ছোটোগল্প আর আটটা সিনেমার স্বল্পতার কথা চিন্তা করলে, বিস্মিত হতে হয়, কী অপরিসীম সময় চেতনার অধিকারী ছিলেন ঋত্বিক ঘটক! প্রতিটি ইঙ্গিতকে, ইশারাকে এবং সময়ের অন্তরালে গ্রন্হিত হতে থাকা আরেকটা সময়কে অনুভব করতে পেরেছিলেন বলেই বোধহয়, এখনও ঋত্বিক ঘটকের অনুসারী দল তৈরি হয়নি। ভারতীয় শিল্পের এক লোন উলফ।

 


দে'জ প্রকাশিত 'ঋত্বিক ঘটকের গল্প '-এর সম্পাদকের নাম জানা না গেলেও সুসম্পাদিত সতেরোটি গল্পই যে ছোটগল্পের স্বভাব বহন করছে না,বোঝাতেই,'ছোট' শব্দটিকে ব্যবহার না করে অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন নেপথ্য সম্পাদক।

২.
বস্তুত এ কথা ঋত্বিক ঘটক একাধিকবার স্বীকার করেছেন, শিল্প তাঁর কাছে একটা লড়াইয়ের অস্ত্র। এবং লড়াই জারি রাখার জন্য যে কোনও মাধ্যমকে বেছে নিতে তাঁর 'দ্বিধা'নেই। এই দ্বিধাহীনতা কী আমরা লক্ষ করি না, তাঁর জীবনের অধ্যায়গুলিতে! একই সঙ্গে 'প্রকাশন প্রসঙ্গে 'শীর্ষক উল্লেখটির প্রথম লাইনটাও খুব জরুরি হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই প্রস্তাবে,

"ঋত্বিককুমার ঘটক তাঁর যৌবন উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে একজন সিরিয়াস সংস্কৃতিক কর্মী রূপে গড়ে তোলার কাজে মগ্ন হন।"

এই কথাটির 'সংস্কৃতিক কর্মী রূপে' আর 'গড়ে তোলার কাজে মগ্ন হন'-এর ওপর পাঠককে লক্ষ রাখতে অনুরোধ করবো।নিজেকেই নিজের অস্ত্র করে তোলার একটা সুনির্দিষ্ট অভিপ্রায় ঋত্বিক কুমার ঘটকের আজীবনের প্রচেষ্টায় দেখা যায়। উদ্দেশ্যহীনতার কিংবা একাকীত্বের উদযাপন নয়; নির্দিষ্ট দিকে, একপ্রকার স্বৈরাচারীর মতোই, নিজের অবচেতনকে পরিচালনা করার আয়াস কিন্তু সচরাচর দৃষ্ট নয়। একই সঙ্গে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় না  'সংস্কৃতিক কর্মী' হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করার যৌথচেতনার আমূল। সেখানে সিনেমা একটা উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নয়তো ছোটগল্পেই এই নির্মাণও দেখা যাচ্ছে। সিনেমা অভিপ্রায় পূরণ করতে না পারলে হয়তো আমরা ছোটগল্পকার ঋত্বিক ঘটককে পেতাম।

সতেরোটি গল্প‌ যেমন মনস্তাত্ত্বিক ঘনিষ্ঠতাকে বহন করছে, একই সঙ্গে ধারণ করছে ছোটগল্প লেখক ঋত্বিকের প্রস্ততির অবয়বটিকে। যেমন প্রথম গল্প 'গাছটি' একটিমাত্র প্রত্যক্ষ উক্তি আর সর্বজ্ঞ লেখকের চেতনা-প্রবাহকে অন্তর্বর্তী করে নির্মীত হলো। স্টিম অফ কনশাসনেসের যে অনুরণণ ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাহিত হয়ে সতীনাথ ভাদুড়ী পর্যন্ত বহমান, তাকেই আক্ষরিকভাবে আলম্বন করে গল্পটি ধীর গতিতে এগোলো কেবল একটা বর্ণনা হিসেবে।

সাধারণত যখন গল্প যখন লেখকের ব্যক্তিগত বক্তব্য প্রকাশের ইচ্ছে ধারণ করতে চায়, স্বভাবতঃই চেতনার প্রবাহ ঘটানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। দ্বন্দ্ব কমে আসে, ঘটনা ম্লান হয়ে যায়, কথা নেভে; বদলে দুটো চারটে চরিত্রের স্হানগত দ্বন্দ্বে তৈরি হয় যে মনস্তাত্ত্বিক বলয়, তাকেই লেখক দর্শনের আভাসে প্রবেশ করিয়ে দেন তাঁর গল্পে। ঋত্বিক ঘটক প্রণীত 'অয়নান্ত' গল্পটিকে এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়,

"মাথায় চিন্তা আসিতেছে। এ উহার ঘাড়ে পড়িয়া, একটার সহিত অপরটার কোনো যোগ নাই নাই, অসংলগ্ন...যেন ছায়াছবিরা পর্দার ওপর উপর দিয়া দ্রুত ছুটিয়া চলিয়াছে...

কিন্তু বেশ লাগে এই মৃদু বাতাসটি...হঠাৎ সচকিত হইয়া উঠিলাম। কে যেন পৃষ্ঠে হাত রাখিল। পিছন ফিরিয়া দেখি, রঞ্জন ও কপিল। রঞ্জন উৎফুল্ল, মুখে খুশির আমেজ,কপিল চিন্তামগ্ন,ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া আছে।
কেহ কোনও কথাই কহিলাম না। দরকারও ছিল না। ঠিক এই সময়টাতে সব চাইতে বেমানান লাগিবে কথা। আমি শুধু একটু মৃদু হাসিলাম।"(পৃঃ ২৫/অভিধারা ১ম বর্ষ মহালয়া ৩য় সংখ্যা আশ্বিন ১৩৫৪ )
এই ভাষাটির ওপর অভিনিবেশ করলে দেখা যায়, বিস্ময়করভাবে এক্লিপ্স ও যুগ্ম ক্রিয়ার উপর্যুপরী ব্যবহার। ইচ্ছে করেই , ভঙ্গিমার চলনকে নির্ভর করেই গদ্যকে তার স্বতন্ত্র চেহারা নির্মাণের স্বাধীনতা দিলেন লেখক।

চারটি-একবেলা, অশান্ত,সভায় ও অন্যত্র, সিদ্ধান্ত পর্যায়ে ভাগ করে অভিনবত্ব দিলেন গঠনকৌশলে। একই সঙ্গে একাধিক কোটেশন ব্যবহার-রবীন্দ্রনাথ থেকে ফরাসি কবিতা হয়ে কীটস পর্যন্ত, মোটেই ক্লাসিক্যাল ছোটোগল্পের রীতিকে সমর্থন করে না। বরং অনেক বেশি বড়ো গল্পের স্বভাব পেয়ে বসে। কিন্তু 'সিদ্ধান্ত' আবার টেনে আনে ছোটোগল্পের দিকে।আখ্যানকে এক নবত্ব দেওয়ার প্রেরণাতেই বিচিত্র বিণ্যাস দেখা যায়, 'আকাশগঙ্গার স্রোত ধরে'-তে। যদিও এই গল্প থেকে পুরোপুরি চলিত ভাষা ব্যবহার শুরু করলেন গল্পকার।

 


 ৩.
চেতনাপ্রবাহরীতির পথকে ছেড়ে গল্পগুলো এরপর থেকেই অনেক বেশি প্রত্যক্ষ হয়ে উঠল। অস্হির জীবনের অসম্পূর্ণতাকে নিষ্ঠুর নির্লিপ্তি দিয়ে পরিত্যাগ করার পথ ছেড়ে কিংবা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করার সক্ষমতা তৈরি করে ঋত্বিক 'পরশপাথর', 'স্ফটিক পাত্র', 'চোখ', 'কমরেড', 'সড়ক' ইত্যাদি গল্পগুলোতে ব্যবহার করলেন অনেক প্রত্যক্ষ ভাষা, ঘটনা সংঘাত। মুহুর্মুহু দ্বন্দ্ব তৈরি হতে শুরু করলো, ছোটো ছোটো পরিশুদ্ধি তৈরি করে একটা সংক্ষিপ্ত আখ্যানের সমগ্রে ট্রাজেডির বিরাট প্রেক্ষিত তৈরি করার চেষ্টা সমানভাবে সক্রিয় থাকলেও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের স্বভাবকে পরিত্যাগ করলো না এই আখ্যানগুলি।

'সড়ক' গল্পটিকেই ধরা যাক না কেন? একটা রাস্তার আয়োজনে ধীরে ধীরে চরিত্রের ভিড় বাড়তে থাকে। উপস্হাপিত হয় ইসরাইল, এমদাদ, আমি সত্তা আর পদ্মানদী হারিয়ে বসা এক এয়োতি বৃদ্ধা।সকলেরই চালচিত্র নির্মাতা 'উদ্বাস্তু' শব্দটি এবং এই গল্পটির শুরু হচ্ছে এইভাবে,

"সহনশীল পিঠ পেতে রাজপথ পড়ে আছে চুপ করে।"

আর শেষ করতে করতে বলছে,

"বৃষ্টির মোটা মোটা ছাঁট মসৃণ রাজপথের ওপর পড়ে ছিটকে যাচ্ছে। তাদের‌ই সঙ্গী হয়ে আমি মাটিতে কান পাতলাম।

গুম গুম গুম গুম গুম গুম গুম গুম গুম গুম গুম...

একতালে এগোচ্ছে কত মানুষ।"(নতুন সাহিত্য প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা জ্যৈষ্ঠ্য ১৩৫৭)
বৃষ্টির শব্দ মিছিলের গভীর প্রত্যয়ে পরিণত হতে পারে তখনই, শিল্পী যখন কখনই একা নন। একটি জনবিন্যাসের অংশ হিসেবেই অংশ নিতে চান তাঁর অভিপ্রায়ে। দায় নিতে চান পারস্পরিকতার। সেই দায় থেকেই মনস্তাত্ত্বিক গল্পও হয়ে ওঠে উদ্বাস্তুর 'সব পাওয়ার মিছিল'।

ঋত্বিক ঘটক বোধহয় বলতে চেয়েছেন, এই স্বতঃউদ্বাস্তুর পৃথিবীতে যৌথ চেতনা ব্যাতীত নির্বাচিত হতে পারার আর কোনও গত্যন্তর নেই। তাই উদ্বাস্তুর অভিপ্রায়কে পরিণত করেন সামগ্রিক পথ পাড়ি দেওয়ার আকারে। আখ্যানে নির্মীত হয়, স্পষ্ট ম্যানিফেস্টো।


৪.
যেমন 'কমরেড' গল্পটি নির্মম শ্রেণিশত্রু খতমের একটা ফতোয়া হয়ে উঠলেও দ্বন্দ্ব এড়াতে পারেন না শিল্পী। হত্যা বর্ণনাকে সম্ভাব্য-অসম্ভাব্যের দোলাচলের কূহকে ঢেকে রাখতে বাধ্য হলেন। কেননা, বিজন ভট্টাচার্যের মতনই ঋত্বিক ঘটকও এক অর্থে সেই প্রত্ন-প্রতিমাতেই বিশ্বাস করেছেন, যার গর্ভঘরে রয়ে গেছে আদি মাতৃচেতনার ধ্রুবক এবং মৌল মাত্রিক পারস্পরিক চেতনা,

"তখন থেকে দেখছি ঝুঁকে পড়ে, জলে ভেসে যাচ্ছে আমার সারা মুখ।

তারপর কম্পিত মৃদুহাতে ওর গুচ্ছ গুচ্ছ চুল কপাল থেকে সরিয়ে দিতে থাকি সযত্নে।"(ফতোয়া প্রথম সংকলন বৈশাখ ১৩৫৭)

হত্যাকারী ও নিহতের এহেন সিনেম্যাটিক সহাবস্থান বিশেষ দেখা যায় না। বস্তুত, নিজেকেই নিহত দেখার তাৎপর্যে জীবনের মূল্যায়ণ করে দেয় আখ্যানবৃত্ত।

 


 ৫.
এ সংক্ষিপ্ত আলোচনার ইতি টানার পূর্বে, একথা তো বলতে দ্বিধা নেই, ঋত্বিক ঘটকের গল্পগুলো আসলে একটা তীব্র ম্যানিফেস্টো। মানুষ একসঙ্গে, ভালোভাবে, নিরাপদে বেঁচে থাকবে।এই সরলতম দিনের স্বপ্নে যে বহু মেধা বিক্ষত হয়েছে, তারই একটি সিংহ অংশ ঋত্বিক ঘটক। তাঁর এই সংকলনের সতেরোটি আখ্যান এই একবিংশ শতাব্দীতেও এসে সমানভাবে প্ররোচিত করে, প্ররোচনা দেয় ব্যূহ ভেদ করে 'লাল টুকটুকে দিন'-এর ভেতরে ঢুকে পড়ার,

"অভিমণ্যূর মতো মায়ের গর্ভ থেকে তারা চক্রব্যূহ ভেদমন্ত্রের কৌশল শিখেছে।এবার এরা মেরে ফাটিয়ে দিক। এদের ফাটানোর একটা ব্যাপার এসে গেছে। সামনের রক্তিম শিমুল গাছটা মোটামুটিভাবে সেই কথাই বলছে।"(মার, মধ্যাহ্ন ৪র্থ বর্ষ শ্রাবণ-আশ্বিন ১৩৭৬)





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন