দোঁহা

শতদল মিত্রের উপন্যাস



 আধেকজান

(পর্ব-২)

 ৩.

আর প্রথম দিন ভোটের ট্রেনিং-এ গিয়েই উদ্দালক গণতন্ত্রের মহসুর মজলিসে নিজেকে যথাযথ কায়েম করার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যায়। গণতন্ত্রের মহসুর মজলিস, কিংবা গণতান্ত্রিক হুল্লোড়—এমনটাই মনে হয় তার। চার-পাঁচ ঘণ্টা ধরে শুকনো জ্ঞান দিয়ে গেল শুধু তার চেয়েও কম বয়সী একজন, বোধহয় কোনো বিডিও হবে। মাঝে অবশ্য কিছু কথা ওড়ে।

-স্যার, যদি বোমা-বন্দুক নিয়ে অ্যাটাক করে গনতন্ত্রকামী গুণ্ডারা তখন সংবিধান কী বলছে?

-সংবিধান এ ব্যপারে অন্ধ। কী আর হবে? পবিত্র গণতন্ত্র রক্ষায় শহীদ হবেন। তবে একটা কথা, ভোটিং মেশিন যেন সুরক্ষিত থাকে সেটা নিশ্চিত করেই তবে শহীদ হবেন যেন!

‘স্যার’টিও রসিক বেশ। তবে হাজির মহিলারা এ কথায় তেমন রস খুঁজে পায় না, তারা ভয়ই পায় যেন, যেহেতু তাদের আলাদা-আলাদা স্বর মিলে এমনই আদল পায়, 

-ভয়ই পাচ্ছি...চারদিকে যা দেখি, শুনি!

-আরে, আপনাদের মহিলাদের কোনো ভয় নেই, আপনাদের ডিউটি পড়বে বাড়ির কাছেই। যেখানে কোনো ঝুট-ঝামেলা নেই, তেমনই বুথে।

-আর আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি নাকি!

একটা পুরুষকণ্ঠ এমন ফুট কাটলেও পাত্তা পায় না তা। মহিলাদের গণতান্ত্রিক একনিষ্ঠতায় ধামাচাপা পড়ে যায় এবং অনর্থক ভোটিং মেশিন, ভিভিপ্যাট, নির্বাচনী মহান কর্তব্য সম্পর্কে প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠতেই থাকে, যদিও কদাচিত্‍ই তার উত্তর পাওয়ার ফুরসত্‍ পায়। অতএব ট্রেনিং ঘন্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘস্থায়ী হতে থাকে। ফলে অবধারিত এ প্রশ্ন ছিটকে ওঠে,

-ইটিং ছাড়া মিটিং!

-স্যার, স্বামীজি বলে গেছেন খালি পেটে কোনো মহত্‍ কাজ হয় না।  

-একটু চা পেলেও...শুনেছি চা-টিফিনের জন্য পের হেড ১৭০ টাকা করে বরাদ্দ করেছে নির্বাচন কমিশন।

-ট্রেনিং নিতে এসেছেন, না খেতে এসেছেন? ও সব টাকা আপনাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে যাবে।

এ ধমকানিতে হল জুড়ে পায়রা ওড়ে, যাদের পাখার ঝাপটায় একটাই শব্দ পাক খায়—কাটমানি! কাটমানি!

অতএব এমত হুল্লোড়ের মধ্যে সেদিনের মতো মহত্‍ শিক্ষাদানপর্ব সমাপ্ত হয়। যেটুকু বুকলেট আর কাগজ জোটে উদ্দালক বোঝে এগুলোই একমাত্র কাজের। এছাড়া অ্যাপ তো আছেই।

দ্বিতীয় দিনের ট্রেনিং-এও সেই একই সরকারি মচ্ছব। গণজ্ঞানের বজ্রকঠিন মহিমা, আদতে যা নেহাত্‍ই কাগুজে নিয়মতান্ত্রিকতা। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই কাগুজে, তেমনটাই মনে হয় উদ্দালকের। যেন ভোট ততটা মুখ্য নয়, তার চেয়ে বেশি মহান ও জরুরী শুকনো কাগুজে সাক্ষ্য-প্রমাণ!

 প্রিসাইডিং অফিসার উদ্দালক তিন নম্বর ট্রেনিং-এর আদেশনামাতেই তার অন্য তিনজন সহকর্মীর নাম-ফোন নাম্বার পেয়ে যায়। যোগাযোগ করে সে সবার সঙ্গে। ফার্স্ট পোলিং সরফরাজ ও সেকেন্ড পোলিং অনন্য—দু-জনেই সরকারি স্কুলশিক্ষক আর তৃতীয়জন রমেশ, কোন এক সরকারি দপ্তরের গ্রুপ-ডি কর্মী। ট্রেনিং-এ গিয়ে তিনজনের সঙ্গেই চাক্ষুস আলাপ হয়, যে আলাপ উদ্দালককে আশ্বস্ত করে, যেহেতু তিনজনকেই খুব আলাপী ও হেল্পফুল বলেই মনে হয় তার। বিশেষ করে সরফরাজ, যে তার বিরাট চেহারার সঙ্গে মানানসই দরাজ দিলে উদ্দালকের হাত ঝাঁকিয়ে বলে—মুখার্জীবাবু ঘাবড়াবেন না। গত বার আমি প্রিসাইডিং  ছিলাম।

সরফরাজের প্রিসাইডিং নামক শব্দব্রহ্ম, নাকি তার দরাজ শরীর—কোনটা যে বেশি ভরসা যোগায়, হয়তো দুটোই, সেটা সে মুহূর্তে উদ্দালকের মনে তেমন ঘাই তোলার ফুরসত পায় না, যেহেতু সেক্ষণে তার বুক হাল্কা করে নিঃশব্দ একটা দীর্ঘতর শ্বাস বাইরের তাপিত বাতাসে মিশে যায় অব্যক্ত অমোঘ এ উচ্চারণেই বোধহয়—আঃ!   

উদ্দালক তাদের চা-সিগারেট খাওয়ায়। তারপর তাদের কাছের মেট্রো স্টেশনে লিফট দেয়। এখন অনেকটাই যেন ভারমুক্ত সে। গল্ফগার্ডেনে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ধূসর কাঁচঢাকা তার বাহনটির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অন্দরের আরাম আর একটু আঁধার-শীতল হলে সে আকাশে চকিত তাকায়, যেখানে কালোমেঘের উদ্দাম খেলা। আহা! প্রথম কালবৈশাখী এ মরশুমের। আজকে ঝড় মাখবে সে শরীরে তার। বৃষ্টি ডেকে নেবে দেহলিজ মনে। ভাবে উদ্দালক।

 

॥ ৪॥

আজ উদ্দালকের ভোটের ডিউটি। দক্ষিণ চব্বিশ পারগনায়। এটা নির্বাচনের পঞ্চম দফা। গণতান্ত্রিক শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে নির্বাচন কমিশন কড়া, তাই এবার পশ্চিমবঙ্গে আট দফার ভোট। যদিও তৃতীয় দফাতেই উত্তরবঙ্গে আধা সেনার গুলিতে শান্তি একটু চলকায়, চারজন ভোটার মারা যায়। নির্বাচন ক্ষমতার লড়াই, যুদ্ধ। যুদ্ধে প্রাণহানি অবশ্যম্ভাবী। ফলে যুদ্ধের কৌশলগত কারণে ঢেউ ওঠে, ওঠানো হয় এবং তাকে থিতিয়ে যেতে দেওয়া হয় রাজনৈতিক কারণেই, কারণ ততক্ষণে তড়িঘড়ি তদন্ত কমিশন নামক এক সংবিধানিক, ফলত ঈশ্বরীয়, আটন প্রতিষ্ঠা পায়, যার বাণী একান্তই দৈবহেতু দেবাংশী ব্যতীত সাধারণ মানবের অশ্রুতই থেকে যায়। আর মিডিয়া নামক মাতনও দু-দিন পর অন্য ইস্যুতে মন্ত্র সাজায়  টি॰আর॰পি॰ দেবতার মন মজাতে। এ ছাড়া সব চেয়ে বড় সত্যি এটাই যে ভারতবর্ষীয় দেবধন্য ভূখণ্ডে ভোটাররা ভোটারই শুধু, সংখ্যামাত্র—এক অনন্য সংখ্যাতেই তাদের ইহদেহ আধারিত। আবার এও সত্য যে সংখ্যা চিহ্ন হলেও তা ব্রহ্মস্বরূপ, তা আকার হয়েও নিরাকার। অতএব সংখ্যার আকারহীনতাই দৈবনির্দিষ্ট, যা পুণ্যেরও, আমাদের এ মহান গণতান্ত্রিক পীঠে। ডি॰সি॰আর॰সি॰ ডায়মণ্ড হারবারে যেতে যেতে এমনই দর্শনে আচ্ছন্ন হয় উদ্দালক। গাড়ির হঠাত্‍ ঝাঁকুনিতে যে দর্শন বাস্তব আঁকলে সে দেখে এ সাতসকালেই রাস্তার পিচকালো শরীরে মরীচিকা মায়া! উদ্দালক আজ ড্রাইভার নিয়েছে।

 
সাড়ে না-টা নাগাদ উদ্দালক ডি.সি.আর.সি. পৌঁছে দেখে যে তার টিমের অন্য তিনজন আগেই পৌঁছে গেছে। ওরা সবাই ট্রেন ধরে এসেছে। এক কলেজের মাঠে বিশাল প্যাণ্ডেল। গাড়িতে, বাসে, মানুষে জমজমাট। যেন মেলা। এমনই মনে হয় উদ্দালকের।  মাইকে অহরহ ঘোষণা—পোলিংপার্টি অমুক, পোলিংপার্টি...।  যেন বা মেলায় নিরুদ্দিষ্টের ঘোষণাই তা।

দিশেহারা উদ্দালকরা এ জানলা, সে জানলায় ধর্ণা দিয়ে, নিজেদের অনিরুদ্দিষ্টতা যথাবিহিত জাহির করেই ই.ভি.এম., ভি.ভি. প্যাট মেশিন এবং গণতন্ত্র যে নেহাত্‍ই কাগুজে তা প্রমাণ দিতেই যেন প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় গুচ্ছের কাগজে তাদের কায়েমী সত্ত্ব দখল করে যখন স্বস্তির শ্বাস ফেলার ফুরসত পায় তখন চৈত্রের গনগনে সূর্য মাঝ গগনে। যদিও তার দলের কেউ সে মুহূর্তে ঈশ্বরকে খুঁজতে আকাশে তাকিয়ে ঈশ্বরীয় প্রাকৃতিকতায় বিমুগ্ধ হয়েছিল কিনা উদ্দালক জানে না, কেননা তার অভিজাত নাগরিক মনন এই অপর ভারতসমুদ্রে প্রথমবার তলিয়ে তখনো পায়ের নিচে মাটি খুঁজে যাচ্ছিল যেন। ঘড়ি দেখে সে। বারোটা বেজে গেছে। প্রখর তাপে ঘামে চান করতে থাকে সে। ত্রিপলের ছাউনির ছায়া কোনো রকম স্বস্তির শীতলতা বিছাতে অক্ষমই যেন। অনভ্যস্ত উদ্দালক একটা বাঁশে পিঠের ভর দিয়ে ধীরে ধীরে বসে পড়ে মাটিতে।  ব্যাগ থেকে বোতল বার করে জল খায়। ফোন করে বাড়িতে, যে আলাপে চিন্তামুক্তির আশ্বাস ছিল। সিগারেট ধরায় অলস হালছাড়া নির্লিপ্ততায়।

সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় অল্প হলেও ঢেউ ওঠে, রমেশের এ প্রশ্নে—চা খাবেন দাদা? যা প্রশ্ন যদিও, তবুও তাতে তীরের সবুজ প্রশ্রয় ছিল যেন, কেননা সত্যিই তার প্রাণ সে মুহূর্তে চা চাইছিল। তবু সংশয়,

-এত সব জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়া কি...

তার কথা পড়তে দেয় না যেন থার্ড পোলিং রমেশ।

-যাব কেন? চা এখানে আসবে।

এবং সত্যিই কিছুক্ষণের মধ্যেই চা সমেত চাওয়ালাকে হাজির করে রমেশ। সত্যিই যেন মেলা-মেলা ভাব, ভাবে উদ্দালক, যেহেতু তার ভাবনায় এ দেখাটুকু ছবি অংকে যে  চাওয়ালার বালতিতে চায়ের সঙ্গে বিস্কুট শুধু নয়, সিগারেট-গুটখাও রয়েছে এবং  লোকটি একা নয়।

সিগারেট ধরায় উদ্দালক। ধোঁয়া ছাড়ে ধীরে, যে ভঙ্গিমায় আপাত স্বস্তির অলসতা। আপাত, কেননা এ তো সবে যুদ্ধ শুরুর আগে মূলঘাঁটির ময়দানে নেহাত্‍ই সেনা সমাবেশ! এর পরেই তো আসল যুদ্ধক্ষেত্রের পানে পদাতিক তাদের এগিয়ে যাওয়া ঢাল-তলোয়ারহীন। ভরসা বলতে কিছু কাগুজে সাংবিধানিক রক্ষাকবজ। হ্যাঁ, কাগুজেই তা, অন্তত ট্রেনিং ও আজকের এ ক-ঘন্টার সরকারি চিহ্ণায়িত প্রবল প্রতাপী অব্যবস্থার অভিজ্ঞতা, উদ্দালককে এমনই ভাবায়। যেন বা তারা অদৃশ্য সরকারি হাতের তুর্কিনাচা তালপাতার সেপাই শুধু। এ অসহায়তায় একটা দীর্ঘশ্বাস তার বুক ছেড়ে বেরিয়ে যায় সেপাই কথাটিকে তার মনের সামনে খাড়া দাঁড় করিয়ে। প্রিসাইডিং সে তড়িঘড়ি তার পোলিং পার্টির দু-জন পুলিশ সঙ্গী সহ অন্যান্যদের ফোনে ধরার চেষ্টা চালায়। বড় বড় সরকারি জ্ঞাপনে প্রতিটা পোলিং পার্টির নাম্বারের পাশে তাদের বাসের নাম্বার এবং পুলিশ, ভিডিওগ্রাফার, আশা কর্মীর নাম ও ফোন নাম্বার দেগে দেওয়া আছে।

উদ্দালক সবাইকে পায় ফোনে। সবাই জানায় যে এক ঘন্টার মধ্যে তারা বাসে পৌঁছে যাবে। তবুও সে আশ্বস্ত হতে গিয়েও হতে পারে না, কেননা একজন কর্মী ফোনে অধরা থেকে তাকে নিরাশ করে তোলে। তিন তিনবার ফোনে একই ফাটা রেকর্ড বাজে—সুইচড অফ! এমন কী সেকেন্ড পোলিং সরফরাজের ফোনেও একই প্রত্যুত্তর ধ্বনিত হলে প্রিসাইডিং উদ্দালকের শরীর বেয়ে টেনশনে-গরমে দরদর করে ঘাম গড়ায়। রাগ, কিংবা হতাশাই হয়তো বা তার জিহ্বাকে অবদমিত মুদ্রাদোষ ফিরিয়ে দেয় যেন—ফাক ইট!

যদিও সে শব্দ এতটাই রাগচাপা যে তা বাইরের হট্টগোলে হারিয়েই যায়, ততক্ষণে মালপত্র অন্য দু-জনের জিম্মায় রেখে উদ্দালক ও সরফরাজ এ জানলা, সে কাউন্টারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবশেষে তারা সবিশেষ অবগত হয় যে পুলিশটির চলভাষের সূচিত সংখ্যাটি বিগত কালের হেতু কার্যকরী নয়। তিনি বর্তমানে নতুন সংখ্যায় সূচিত, যা তিনি যথাসময়ে ও যথাস্থানে জানিয়েও ছিলেন। কিন্তু—

-হেঁ! হেঁ! বুজতেই পারছেন তো সরকারি কাজ, এত চাপ...তার পরে পাঁচ ঘাটের জল একঘাটে...

অমায়িক সরকারি বাবুটি শান্তিরক্ষকের নতুন ফোন নাম্বারটি দিয়ে তাদের মানসিক অশান্তি দূর করে। কিন্তু ধন্য উদ্দালক বুঝতে পারে না বিনিময়ে তারও হেঁ-হেঁ করা উচিত কিনা!

অতএব সরকারি উচিত-অনুচিতের দ্বিধা তত্ক্ষণাত্‍ ঝেড়ে ফেলে সে নতুন নাম্বারে ফোন করে এবং  তার ধড়ে প্রাণ ফিরিয়ে অপর প্রান্ত জানায় যে সেও এক ঘন্টার মধ্যে বাসে পৌঁছে যাবে। যদিও প্রত্যেকেরই এক ঘন্টার মধ্যে বাসে পৌছনোর তত্ত্বটা তার বোধে চারিত হতে গিয়েও বেপথু হয়, কেননা অবস্থার প্রেক্ষিতে আশাকর্মীটি তার মনে তেমন আশা জাগাতে পারে না যতক্ষণ না সে তাকে সশরীরে দেখতে পাচ্ছে। যদিও নিয়ম অনুযায়ী আশাকর্মী বুথ-স্থানীয় এবং কাল সকালে ভোট শুরুর আগেই হাজির হওয়ার কথা তার, যা সে তার প্রিসাইডিং অফিসারকে ফোনে জানিয়ে আশ্বস্তও করেছে, তবুও একটা খচখচানি উদ্দালকের অবচেতনে আঁচড় কাটতেই থাকে, যে  দাগ তার আনমনেই একসময় শব্দব্রহ্মে আশ্রয় খোঁজে যেন। 

-কাল আবার আশাবোনটি সময়ে এলে হয়!

একে গনগনে খরতাপে সেই সকাল থেকে গণতান্ত্রিক লাট খাওয়া, তার ওপর মহান শান্তিরক্ষকের কারণে এমন অহেতুক অশান্তি, ফলে আশাহেতু নতুন আশঙ্কার সম্ভবনায় সরফরাজের মতো অভিজ্ঞ, ঠান্ডা মাথার লোকও সে মুহূর্তে ফেটে পড়ে সশব্দে।   

-এবারে এই এক ঢ্যামনামি হয়েছে! আশাকর্মীরা মহান ভোটারদের সুরক্ষায় মাস্ক-স্যানিটাইজার দিয়ে দাওয়াত দেবে! ভোটাররা ভোট দিয়ে ধন্য করবে আমাদেরকে। এদিকে এখানে করোনাবিধির কোনও পরোয়া নেই... কোথায় দু-গজি সামাজিক দূরত্ব? আবার বুথে গিয়ে দেখবেন একটা নোনা, দেওয়ালচটা স্কুলঘরে গাদাগাদি করে চোদ্দ-পনেরো জন রাত্রে গড়াগড়ি দিচ্ছি। আমরা ভোটকর্মী বলে যেন করোনা নির্বাচন কমিশনের ভয়ে আমাদের ছোঁবে না!

সরফরাজ আপাতত একটু থামে, কেননা তারা ততক্ষণে তখন তাদের বাকি দুই সঙ্গীর কাছে পৌঁছে গেছে এবং সেখানে একজন চাওয়ালাও সে মুহূর্তে উপস্থিত। সরফরাজ তার তেতো মেজাজে মৌতাত আনতে চেয়েই আর কাউকে জিজ্ঞাসা না করেই হুকুম দেয়,

-এই, চারটে চা দাও তো।

উদ্দালক প্রিসাইডিং অফিসার, তাই সে-ই চায়ের দাম মেটায়। চায়ে চুমুক দিলে সরফরাজের মুখ থেকে –আঃ, এই শব্দটি বার হয়, যার ধরতাইয়ে সে আবারও তার কথার খেই ধরে।

-দেখবেন দাদা ভোট করে আমরা সবাই করোনা নিয়ে ফিরব। আমার চেনাজানা অনেকেই করোনা ভোট করতে গিয়ে। তাদের বাড়ির লোকেরা পর্যন্ত এফেক্টেড। বাড়িতে বাচ্চা আছে, বয়স্ক মা-বাবা...। সরফরাজ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে। 

-সত্যিই ভয়েরই ব্যাপার। উদ্দালক ধোঁয়ার সঙ্গে তার অভিমত আলতো ভাসিয়ে দেয়।

-আবার কী গ্যাড়াকল বলুন দেখি... করোনা রোগীও ভোট দেবে! রমেশও নিজের উদ্বেগ জহির করে।-আমি বাবা পিপিই কিট পড়ে করোনা রোগীর ভোট নিতে পারব না দাদা। আগেই বলে দিচ্ছি। মামদোবাজি পেয়েছে নাকি সরকার! আমি মরলে সরকার দেখবে?

এ বিপদটা এতক্ষণ কারও মাথায় আসেনি অন্যান্য দুশ্চিন্তায়। ফলে তারা চারজনই ক্ষণেক থমকায় যেন। কম কথা বলা অনন্যই শেষে নীরবতা ভাঙে, বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পেরেই যেন।

-অথচ সরকার সবসময় করোনা হলে নিজেকে আইসোলেট করতে, আর এখানে স্পেশাল অ্যাম্বুলেন্সে করোনা রোগীকে আবাহন করে ডেকে আনা হচ্ছে...তাহলে ক্যানসার রোগীরা, বা অন্যান্য মারণাপন্ন রোগীরা কী ক্ষতি করল!

-আরে সরকারকে বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে হবে না আমাদের গণতন্ত্র কত মহান, পবিত্র! সরফরাজ তখনও অশান্তই। 

-গণতন্ত্র, না গ্যাড়াতন্ত্র! রমেশ হুস-হুস করে সিগারেটে শেষটান দিয়ে ধোঁয়ার সঙ্গে গলগলিয়ে তার যাবতীয় রাগ উগরে দেয় যেন।

ইতিমধ্যে ঘড়ির কাঁটা একটা পেরিয়ে যাওয়ায় উদ্দালকবাহিনী তাদের বহনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। 

[ক্রমশ]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন