দোঁহা

আজন্ম ধানের গন্ধে




অরিত্র দ্বিবেদী

কৈফিয়ত: 
"A book read by a thousand different people is a thousand different books"

আন্দ্রেই তারকভ্স্কির এই বিখ্যাত উক্তিই আমার একমাত্র কৈফিয়ত বলা যায়। একটা কবিতার বই সম্বন্ধে আলোচনা করার যোগ্যতা বা ক্ষমতা তো অনেক বড় কথা, দুঃসাহস টুকুও এই অমোঘ উক্তির পিছনেই লুকিয়ে আছে। অভিজ্ঞ পাঠক আমাকে নিজগুণে মার্জনা করবেন এই আশা রাখি।

নাম: এমন সুন্দর নামকরণের পিছনে অনেকগুলো কারণ থেকে থাকতে পারে। আমি যেগুলো খুঁজে পেয়েছি তা হল এই --
১) সহজ সরল ভাষায়, একেবারে মাটির কাছের, জীবনের কাছের কবিতা 

২) ক্ষুধা, পরম এবং আসল সত্য। তাই কবিতা (যা মস্তিষ্কের আর অবচেতনের বিচরণভূমি তা হেরে যাচ্ছে খিদের কাছে, মাথা হারছে পেটের কাছে)। তাই লেখাতেও ফুটে উঠেছে ভাতের গন্ধ, ধানের গন্ধ। 

অক্ষর থেকে বাক্য, থেকে লাইন, স্তবক, কবিতাগুলো বেড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে...'আজন্ম ধানের গন্ধে'।

প্রচ্ছদ: 
সালোকসংশ্লেষের ক্ষমতা আমরা পাইনি। গাছেরা পেয়েছে। ওদের সে ক্ষমতা আছে, লিখে নেওয়ার বা লিখিয়ে নেওয়ার(এইটাই বলা ভালো)

 অধিকার:
"তুমি আমার 'ধানের' দায়িত্ব নিলে..."।
 
মানুষ শুধুই হাত তুলে থাকে ধান গাছের ভেতর থেকে। মানুষের গর্ভ কেবল মানুষ ধারণেই সক্ষম। শ্রীজাত বাবুর একটা লাইনে যেটা খুঁজে পাই আমরা: 
"শরীর থেকে শরীর গড়ায়..."

পেট আর মাথার যে অনন্তকালীন যুদ্ধ, তাতে জয় পাওয়ার আশায়, সূর্যের দিকে, পরম পিতার দিকে, হাত তুলে থাকে মানুষ। "আশা"।

কখনো ধানের আশা করে, কখনো বা দুমোঠো ছড়িয়ে দেয় আকাশের দিকে।

বলা বাহুল্য এতক্ষণ অবধি প্রচ্ছদ সম্বন্ধে যা বলার বা বোঝার চেষ্টা করছি সেটা কবিতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই। যেমন শেষে যে কথা হচ্ছিল, মানুষ হাত তুলে থাকে। কখনো আশায়। কখনো বা ছড়ায়। 
এইসবকিছুর সাক্ষী থাকে একজনই সে রোদ। কবি কীভাবে তা বোঝাচ্ছেন? এইভাবে-

"আজও রোদ তবু শূন্যের দুটো চোখ
একা দেখে আর হেরে যায় মনে মনে।"

এবার আসা যাক একটা ব্যক্তিগত কথায়। ছন্দ কবিতা আমার বরাবরের প্রিয়। বিশেষত মাত্রাবৃত্ত। এখন অক্ষরবৃত্তেই কবিরা বেশি সচল বা গদ্যছন্দে বা কারোর কারোর মতে "ছন্নছাড়া" অবস্থায়। কিন্তু ছন্নছাড়া লেখা যখন তখন ছান্দিক হয়ে যেতে পারে, যদি কবি ছন্দ না জানেন তো বা অক্ষরবৃত্ত বা গদ্যছন্দে লিখে যে শিকলটা ভাঙার চেষ্টা হচ্ছে, তা অন্যরকম দেখতে আর একটা শিকলই নয় তো অলক্ষ্যে? 
 
এই বইটা এক্ষেত্রে অনন্য। এই কারণে যে, এতে সমস্ত ছন্দ আছে, এমন কি গদ্যছন্দও। আরও সূক্ষভাবে দেখলে আরও অনেক কিছু মিলবে আমি নিশ্চিত। তবু আমার কাঁচা চোখে কিছু কিছু মিলেছে। যেমন, প্রথম কবিতা "ওষুধ উপত্যকা"য় এরকম অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা আছে।

যেমন, কাঁচা চোখের জন্য একটা নিয়ম আছে, কোনো তিন অক্ষরের যুক্তাক্ষরযুক্ত কোনো শব্দের পাশে তিন অক্ষরের কোনো যুক্তাক্ষরহীন শব্দ দেখলেই জানবেন তা অক্ষরবৃত্ত। 

এই কবিতাটা মাত্রাবৃত্তে লেখা, অথচ সেই তিন অক্ষরের যুক্তাক্ষরযুক্ত কোনো শব্দের পাশে তিন অক্ষরের কোনো যুক্তাক্ষর হীন শব্দ। যেমন ধরুন: "করলে বিস্তার", "বিবিধ নির্জনে" ইত্যাদি। 
  
 এছাড়াও কিছু কিছু জায়গায় গদ্যছন্দ যেন স্বাভাবিক গদ্যছন্দ নয়, তা ধীরে ধীরে স্বরলিপির দিকে এগিয়ে গেছে। সঙ্গীত সম্পর্কে আমার অজ্ঞতা আমি প্রকাশ করতে গররাজি। যদি সঙ্গীত বোদ্ধা কেউ দেখেন তিনি লক্ষ্য করলেই বুঝবেন একথা।
    
এবার আসি আত্মায়। কবিতাগুচ্ছের আত্মায়। এ এক বিরাট কাজ। কোথা থেকে শুরু করব বা কোথায় শেষ তা আমার বুদ্ধির বাইরে। এই বইটা এক কথায় আমার কাছে একটা বড়ো নদী, যেটা অনেক অনেক শাখা নদী দিয়ে তৈরী। সব শাখা নদী যে আমার দৃষ্টির গোচরে বা আমার সিক্ত করে গেছে তা নয়, তদুপরি আমি সব শাখা নদীর খোঁজ পাঠকদের দিতে চাইনা। তাঁরা নিজেরাই খুঁজে নেওয়ার আনন্দে আমার চেয়ে আরও ভালো করে খুঁজে নেবেন বলে আমার বিশ্বাস। তাহলে, আমি যা করতে পারি তা হল, কিছু কিছু শাখা নদীর কিছু বাঁকের, কোনো তীরের ফসলের খোঁজ দিই আর ওপর ওপর আমার মনে সেই বড় নদীটার একটা আভাস দিয়ে রাখি।
      
কবিতার এই বইয়ে বারংবার একটা দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে। আমাদের ভেতরে চলতে থাকা একটা শেষ না হওয়া যুদ্ধের খোঁজ সবসময় পাওয়া গেছে। যেমন-

যাঁরা একটু শ্বাস নিতে চান কোনো সম্পর্কে তাঁদের জন্য, "প্রায়শ তুমি অভাব চাও রণে" আর তাই, "স্বভাব হারা মৃতের মত প্রিয়/ আমি তো বাঁচি বিবিধ নির্জনে"।
একই কবিতায় প্রেমের প্রতি আস্থা হারিয়ে তিনি বলছেন, "বাজো গো প্রেম, বিভুঁই হয়ে বাজো"। 
মনে পড়ছে ছেলেবেলার অনাবিল, নিঃশর্ত দিন, "গর্ভ কাঁদে ছেলেবেলার সুরে"।
অথবা, দ্বন্দ্বটা আসলে যেন 'দুঃখ'। সদ্যভ্রূণের মৃত্যুতে যার জন্ম, সেই দুঃখ মশাল হয়ে জ্বলে পিতার মুখাগ্নির পর...। আর একটা যুদ্ধ। উল্টো দিকের সৈন্যদলের নাম প্রকৃতি।

প্রকৃতি যে আদপেও প্রেমাস্পদ নয়, এই বইয়ে সেই চিন্তা বারবার বিভিন্ন রূপকে ফুটে উঠেছে(প্রথম কবিতায় অবশ্য প্রেমও প্রেমাস্পদ নয়)। আসলে মানুষ আর প্রকৃতি দুই আলাদা আলাদা স্বত্ত্বা এবং পরস্পর একটা অসমাপ্ত সংঘর্ষে লিপ্ত। কোনো পক্ষই  অপরকে করুণা করে না। তাই বোধহয় প্রতিটা কবরের ওপরে একটা করে গাছ পোঁতা থাকে।

 ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করতে করতে, "জাদুর চেয়ে মায়ের ছায়া বড়ো" কবি দেখছেন বাংলা কবিতার সেই দুর্নিবার টান। প্রেমের আর বিচ্ছেদের। রাগের আর অনুরাগের। বর্তমানে, হাজার বছর আগের এক দৃশ্য:

"খাচ্ছে ভাষা অধীর ঢেণ্ঢন"।

প্রতিশোধ, এইটাই বুঝি মানুষের আদিমতম এবং সবচেয়ে শুদ্ধ অনুভূতি। 

"Revenge is the purest form of human emotion"

সেখানেও প্রবৃত্তি আর প্রকৃতিকে আলাদা করে এবং কিছুটা পরস্পর বিরোধী করেই কবি লিখছেন, 

"প্রতিশোধের আগেও কিছুটা ঘাস ঢাকা জমি থাকে"।

নিজের ভেতরের অন্ধকারতম অনুভূতিও প্রতিফলিত হচ্ছে প্রকৃতিতে।

আচমকা ঘরে বসে যদি অনুভব করেন, আপনি বিশ্ব নাগরিক। অথচ, তখনই শীতের রাতের চেপে বন্ধ না হওয়া জানলাটার ঠাণ্ডা নিঃশ্বাস আপনাকে আছড়ে ফেলে আপনার চৌহুদ্দির মধ্যে, আপনারই অগোচরে, কিম্বা উল্টোটা। তখন আপনার ভেতরে দুটো দুর্নিবার বিপরীতমুখী টান জন্ম নেবে। যে কারণে আপনি এখন স্থবির, এখন স্থির। কারণ দুটো দলই সমান ভাবে কিন্তু বিপরীতে টানছে আপনাকে। কবির কলমে এই অবস্থা বহুবার ফুটে উঠেছে, কখনো মোড়কে কখনো হঠাৎ করে এসে পড়া দুর্ঘটনার মত। যেমন-

'কোজাগর' কবিতার প্রথম লাইন আর শেষ স্তবকের প্রথম লাইন,
"ধানে ধানে নামে কোজাগর/.../ধানে ধানে কালপ্যাঁচা নামে"। 

 আপনি জেনে ফেলবেন, এই বিরাট ব্রহ্মাণ্ড আর তার বাইরেরও যা কিছু সবই আপনার চিন্তার অতলে, আপনার মনই সমস্ত'র আধার। হারিয়ে ফেলবেন নিজেকে

"মাঝে মাঝে মনে হয় কে যেন হারিয়ে গিয়েছে আমার"

এই বিরাট সমুদ্রে আমিত্বের ডিঙিটা খোয়া যাবে। আর ফুটে উঠবে ত্যাগের বৃত্ত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে(কোনোটাই একই কবিতার অংশ নয়, তবু একে অপরের পরিপূরক। একে অন্যের অংশিদার। যেমন মানুষ)।

"আমার মায়ের পা বিসর্জনের মত"
 
বা   

"যদিও বসন্তের জন্য আমি মুখ বাড়িয়ে দেখিনি
 কতটা ধান হলে মৃত্যু বাঁধা থাকে।"

যেটা পরের প্রজন্ম বয়ে চলে, বিরাসতে পাওয়া ক্ষেতের মতন, খিদের মতন, রোদের মতন।

কবি যে শুধু অবচেতনেই তাঁর সপ্তঘোড়ার রথ ছুটিয়ে ক্ষান্ত হয়েছেন তা নয়। আমাদের মতন যাঁরা ঐ লোকেই নিজেদের বাড়িঘর বানিয়ে রেখেছেন তাঁদের এসে ধাক্কা দিয়ে যায়,

"গ্রহের মানুষটিকে দেশবন্ধু করলাম"

"তোমার অস্ত্রাগার বেশ্যাবাড়ির মাটিতে ভরানো"।

 কবির খালি পায়ে হেঁটে চলা, তাঁর ক্ষত পা, আমাদের মনের সাদাতে রোদের মতন রক্তে, পদ্মছাপ এঁকে দিতে দিতে যায়। আমরা-
"যেখানে যেতে পারিনি কখনো"

একটা সময় ফুটে উঠেছে এই বইয়ে। অস্থির একটা সময়। সেই সময়কে ধরতে গেলে সমস্ত মানুষকেই ধরতে হয়, সমস্ত কবিতা সেই কাজটাই করেছে, ছোটো থেকে বয়স্ক, যুবক থেকে বৃদ্ধ সবার দ্বন্দ্ব, সক্কলের সময় জায়গা করে নিয়েছে এই একান্নবর্তি পরিবারে।    
  
যে অগুনতি চিন্তার শাখা নদী মিশে মিশে বড়ো নদী হল অবশেষে, দেখলাম সে সময় আর অনুভূতির স্তর ছাড়িয়ে আমার পরিবেশে এসে মিশেছে। পড়া শেষ হবার পরও আমার আশেপাশের বাতাসে ভর করে করে সে ঘুরে বেড়াবে আমি জানি।

এই নদীর মোহনার নাম তাই "আয়ু" হওয়া অবশ্যম্ভাবী। দুটি আপাত আলাদা অংশে বিভক্ত কবিতার শেষ লাইনে খুদকুঁড়ো আর রক্তাক্ত হাত কবি বাড়িয়ে দিচ্ছেন মোহনা থেকে, প্রতিটি পাঠকের অবচেতনে। তাঁদের ক্ষেতে ক্ষেতে ফুটে ওঠা ধানের শিষে, যেখানে পড়ন্ত রোদ সাক্ষী, যেখানে মাথা আর পেটের বিবাদ থামিয়ে, চিরাচরিত জীবন, মৃত্যু, অবচেতন ধান হয়ে ফুটে উঠছে। তিনি বলছেন-
"আয়ুর বদলে তুমি আমাকে চেয়েছ?"
 


বই:  আজন্ম ধানের গন্ধে 
কবি: সব্যসাচী মজুমদার 
প্রচ্ছদ:  শুভ্রনীল ঘোষ
প্রকাশক:  ছোঁয়া
মূল্য : ১০০ টাকা
                          

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন