রক্তিম ভট্টাচার্য
চার বছরের বাচ্চার পটি-পরিষ্কার এমন কোনো নতুন বিষয় নয়, জানেন নিশ্চয়ই। ব্যাপারটার মধ্যে আপাত কোনো জটিলতার সন্ধানও সন্তানের বাবা-মা কিংবা অন্য কোনো অগ্রজ পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেননি। প্রচুর উপায় যেমন আছে, তেমনই আছে স্তরভেদ। এই যেমন অধিক উপার্জনকারীদের জন্য আছে ন্যাপি, খোলো আর ফ্যালো। আরেকটু কমাদের জন্য পটি-টুল। ধরো আর ফেলে ধুয়ে নাও। সবথেকে কমাদের জন্য হয় ছেঁড়া কাপড়, নয় কাগজ। নোংরা পরিষ্কারের যা নেশা মানুষের, তেমন আর কিছুতে নেই-এ আপনাদের অজানা নয়।
মুশকিল হল, কাগজের দাম চিরকালই বেশি। তাই কাগজ দিয়ে আপাতত বুন্টুর হাগা পরিষ্কার করতে পারছে না ঘনশ্যাম। ন্যাতা বলতে একটা মায়ের বিয়ের শাড়ি-ছেঁড়া, আর কাগজ বলতে গান্ধীজীর মুখ। এর বাইরে আর কিছুই নেই। মায়ের শাড়ি পটিতে ব্যবহার করতে সে আর রাজি নয়। গোটা শাড়িটাই ছিঁড়তে ছিঁড়তে অবশিষ্ট আর একফালি। এটুকু চলে গেলে মায়ের স্মৃতি শুধু হাড়জিরজিরে পাঁজরের এককোণেই পড়ে থাকবে। অগত্যা, কাগজ। কিন্তু গান্ধীজীর মুখে কি আর পটি লাগানো যায়! তাই আপাতত ঘনশ্যাম বেরিয়েছে কাগজের সন্ধানে। দেখা যাক, কোথায় কোথায় যায় সে। আপনারাও আসুন আমার সঙ্গে। ওকে বিরক্ত না করে অনুসরণ করব চুপিচুপি।
ঘনশ্যাম প্রথমে গেল একটা চায়ের দোকানে। দুপুরবেলা দোকানি শাটার এঁটে পগারপার। ডাস্টবিন থেকে উঁকি মারছে সিগারেটের খালি প্যাকেট, বাপুজি কেকের খোসা। ঘনশ্যাম এদিকওদিক তাকিয়ে তুলে নিল দুটোই। এটা দিয়ে আপাতত চলে যাবে। কিন্তু, রাতে যদি আবার হাগে? বারবার কে কাগজ খুঁজতে বেরোবে? এর থেকে বড় কিছু দরকার।
যদিও ঘনশ্যামের মাথায় এত বুদ্ধি নেই, কিন্তু আমি-আপনি যখন ভেবে ফেলেছি, ঘনশ্যামকে তো ভাবতে হবেই। হাজার হোক, সে তো আমাদেরই লোক, তাই না? তাই ঘনশ্যাম ওসব ছাইপাঁশ ছেড়ে চলল অন্য উপায়ের সন্ধানে।
এবারে একটা ফর্দ-র কাগজ। বাতিল। মানে, পেড। বড় করে স্ট্যাম্প মারা, গোল্লা আকৃতির ভেতরে লেখা পি এ আই ডি। ঘনশ্যাম এটুকু বুঝতে পারল, যে এটা আর কাজে লাগবে না। কাগজটা তুলে নিল। উপরে লেখাগুলো দু'বার পড়ল। চাল তিরিশ কিলো, মুগডাল ছ'কেজি, আটা দেড় কেজি, চিনি পাঁচ কেজি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছি, ঘনশ্যামের এসব দেখে চোখ কপাল ছাড়িয়ে আরো উপরে উঠে যাবার কথা। এই তালিকাটা বোধহয় ওর সারা জীবনের খাদ্য-তালিকা। মহামূল্যবান তাহলে! ঘনশ্যাম আবার রেখে দিল কাগজটা। কী জানি, হয়ত কেউ ভুলে ফেলে গেছে!
ঘনশ্যাম যাচ্ছে আবার, আমরাও ওর পেছনে পেছনে যাচ্ছি। আপনারাও আসছেন তো? দেখুন দেখুন, ঘনশ্যামের বুদ্ধির দৌড়টা একবার দেখুন। কী তুলেছে ওটা? হায় রে! গতকালের ঝড়ে বহুতল থেকে উড়ে আসা একটা প্ল্যাকার্ড। তাতে সাঁটা ছিল পোস্টার। অর্ধনগ্ন নারী, তাকে জড়িয়ে রেখেছে নিম্নবসন-পরিহিত পুরুষ। মেয়েটি খুবই অস্বস্তি বোধ করছে। হয়ত চাইছে, পুরুষটি তাকে ছেড়ে দিক। অথবা চাইছে, বাকি পোশাকটুকুও খুলে ফেলতে। ঘনশ্যাম বোধহয় সে-ব্যাপারটাই খানিক ভাবল। নাকি মেয়েটির মুখে নিজের স্বর্গত বৌয়ের মুখটা একবার বসানোর চেষ্টা...না না ধুর, সে কী করে হবে? রাধা ছিল খেঁদিপেঁচি, একেবারে কালো কালো হাত-পা, তোবড়ানো বুক, চ্যাপটা পেট। পারত না কিছুই, তবে বুন্টুর মতো ডাগর একটা বাচ্চা পেটে ধরতে অসুবিধা হয়নি। যদিও ঘনশ্যামের একটা দুঃখ ছিল, কারণ বাচ্চাটা তার নয়। তবে রাগ হয়নি একটুও। সে নিজে রাধাকে সক্ষমভাবে আদর করতে পারেনি, পেরেছে নিতাইদার মেজ-ছেলে। তাতে কী? বুন্টুর মতো একটা ছেলে তো সে পেয়েছে। এখানে আপনাদের একটু জ্ঞান দেওয়ার জন্য বলি, নামে কি আসে যায়? শেকসপীয়রের কথা। তেমনই, কে আদর করল তাতে কি আসে যায়? বাচ্চা তো পেল ঘনশ্যাম। অবশ্য রাধা পরে মরমে না গরমে মরে গিয়েছিল, সেটা যদিও এমন কোনো কাজের কথা নয়। অন্তত, আমাদের এই অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে।
এ বাবা, এত বকতে বকতে ঘনশ্যামকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। সে ব্যাটা গেল কই? এজন্যই বলে, অনুসরণকারীদের কখনও এক মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হতে নেই। কে বলে তা অবশ্য জানি না, কিন্তু যে-ই বলে, ঠিকই বলে। এখন হল তো? এবার ওকে পাব কোথায়? কী দিয়ে পটি পরিষ্কার হবে এখন? ওদিকে বুন্টুও তো এতক্ষণ গুয়েপোঁদে বসে আছে। বাচ্চা ছেলে, ঘনশ্যামের একটা আক্কেল-বুদ্ধি নেই। ছেড়ে চলে এল কাগজ খুঁজতে। যেন ভূতে পেয়েছে, কাগজ ছাড়া পটি পরিষ্কার করা যাবে না। শালা, আবার পটি বলে! ওই নিতাইয়ের মেজছেলের কাছে শেখা। ধন্যি সে বাপধন, বুন্টুর বাপকে পটি শিখিয়েওছে, বুন্টুর মাকে পটিয়েওছে। কিন্তু, এখন বসে বসে বেকার পানবাজি করার সময় নয়। আচ্ছা, এমন হয়নি তো, ঘনশ্যাম ঘরে ফিরে গেছে কাগজ খুঁজে পেয়ে? বা হঠাৎ ওর বুন্টুর কথা মনে পড়েছে? দুত্তোর ছাই, চলুন তো। আমরা বরং ওর ঘরেই ফিরে যাই। বাচ্চাটাকে অন্তত পাহারা দিই, যদি অবশ্য ইতোমধ্যেই কিছু বিপদ না ঘটে থাকে! হে মাধব! ঘনশ্যামের বাচ্চা, গেলি কই?
ওই তো, ঘনশ্যাম আসছে বলতে বলতেই। ও হ্যাঁ, এতক্ষণ আমরা বুন্টুর কাছে ছিলাম। বেচারা পটি বোঝে না, ঘুম বোঝে। ঘুমিয়ে পড়েছে। গুয়ের গন্ধে মাছিরা ভ্যান ভ্যান করছে। আমি তো তাড়াচ্ছিলাম দুয়েকটা, আপনারা কী করছিলেন? যাই হোক, এইবার ঘনশ্যাম একটা কাজের কাজ করেছে। অন্তত মাসখানেকের জন্য কোনো চিন্তা নেই। গু পরিষ্কারের পাকা ব্যবস্থা।
ঘনশ্যাম ছিঁড়তে লাগল সদ্য কুড়িয়ে পাওয়া একটা পুরনো রবীন্দ্র রচনাবলীর অষ্টম খণ্ডের পাতা। পাশে রয়েছে কয়েকটা খবরের কাগজ, এগুলোও কুড়িয়ে উদ্ধার করেছে। আসলে ঘনশ্যাম যদি একটু চালাক হতো, ও দেখতে পেত, বইয়ের প্রথম পাতায় কোনো এক উপরতলার রাধাকে ঘনশ্যাম এ-বই দিয়েছিল। সে নাম জ্বলজ্বল করছে ভেতরে। কিন্তু হা হতোস্মি, উপর মাঝারি বা নীচ, কোনো একটা তলার নিতাইদার মেজছেলে সে বই ফেলে দিয়েছে আস্তাকুঁড়ে। ভগবানের মূর্তি আছে, হইহই করে সে মূর্তি পুজোও হয়। কিন্তু যে লোকের অস্তিত্ব মূর্তিতেও নেই, সে লোকের লেখা পড়ে কোনো লাভ আছে কি? অগত্যা, তার ঠাঁই আপাতত নীচের তলার ঘনশ্যামের কাছে। ঘনশ্যাম এখনও অবধি আড়াইশো পাতা ছিঁড়ে ফেলেছে। হঠাৎ এত কাগজ দেখে কীভাবে সে ব্যবহার করবে কাগজগুলোকে, বুঝে উঠতে পারছে না। হতভম্ব হয়ে গেছে। কাগজ ছিঁড়ছে, কাগজ ওড়াচ্ছে। ক্যাচ লুফে আবার ওড়াচ্ছে। ওদিকে বুন্টুর হেগোপোঁদে মাছি ক্রমশ বাড়ছে। মাটিতে পড়ে থাকা থকথকে খয়েরি দলাটা অপেক্ষা করছে তার বিসর্জনের।
আপনাদের ঘেন্না লাগছে নিশ্চয়ই? স্বাভাবিক। যান তো, শিগগির পালান এ ঘর থেকে। এখানে কোনো সভ্যতা নেই, কোনো সংস্কৃতি নেই। শুধু নোংরা, ন্যাংটো একটা বাচ্চা শুয়ে আছে, আর তার বাপ আছে। এদের দেখে কোনো লাভ আছে কি? আপনারা যান, নাক-চোখ-মুখ চাপা দিন, আর বরং ঘনশ্যামকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একটু নিজের মতো থাকতে দিন।
ঘনশ্যাম কিছুক্ষণ পর কাগজ ওড়ানো বন্ধ করে বুন্টুকে কোলে তুলে নিয়ে চলল পুকুরে ধোয়াতে। রবীন্দ্রনাথ আর সংবাদপত্রের মহামতিরা মাছির ওড়াউড়ি দেখতে লাগলেন। যদিও, তাদের নাক-চোখ-মুখ চাপা দেওয়ার কোনো উপায় নেই।
