দোঁহা

তেতে ওঠার কেচ্ছা


  

সব্যসাচী মজুমদার


(১)

সতীশ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাড় হিম করা ঘটনা দুটো পরপর ঘটে গেল। সেদিন শুভ দোকান সামলাচ্ছিল। কয়েকটা বাড়তি খাসির দরকার। একটা বিয়ের আর্জেন্ট অর্ডার। আসলে মূল অর্ডার যে ধরেছে সব সাপ্লাই দিতে পারছে না।সতীশকে ধরেছে। তাছাড়া মহাজনকে কিছু টাকাও দিতে হতো। ভ্যানে রাম আর সাইকেলে সতীশ। গিয়ে লাভ হলো। মোট একশো কেজির অর্ডার বেছে নিতে পারলো। পাঁচটা খাসি ভ্যানে বেঁধে টানছিলো রাম। সকাল দশটা। পেছনে সতীশ আস্তে আস্তে প্যাডেল করছে। রাস্তায় জ্যাম। বাস, টোটো, লরির সঙ্গে ছেলেপুলের স্কুলে যাওয়ার রাশ। একটু আগেই ট্রেন ঢুকেছে।কাজেই অফিসের ভিড়ও আছে।
 দোকানের কাছে এসে গিয়েছিল। জ্যামে আটকে সতীশ দেখতে পেল উল্টো দিক থেকে রেলে কাটা ভ্যান যাচ্ছে। এখন কাঠের ডালা দিয়ে বাক্সের মতো করা হয়েছে রেলে কাটা বডি মর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ভ্যানও আটকে। ভ্যানেই ভর দিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে টলছে শিবুর ছেলে পানু ডোম। আগে থেকেই ক্যাওড়া করছে। চিৎকার করে মাঝে মাঝেই খিস্তি করছে লোকজনকে। পানু সবসময় খেয়েই থাকে। আজ বোধহয় সকালেই চড়েছে বেশি।

জ্যামের জন্য বিরক্ত সতীশ মন ফেরায়। গিয়ে খাসিগুলোর ব্যবস্হা করতে হবে।দুটো লোক তো দেবে বলেছিল। ওদিকে বিক্রি বাটাই বা কী হচ্ছে!

এমন সময় পানুর চিৎকারে চমকে উঠে সতীশ দেখে, কয়েকটা স্কুলের বাচ্চাকে খেউড়ে উঠে পানু বলছে,
-এই খান্নি শুয়োরের বাচ্চারা, এই খান্নি শুয়োরের বাচ্চারা, দেকপি দেকপি?
বলতে বলতেই কাঠের ডালা খুলে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলো একটা ছেলে আর একটা মেয়ের কাটা মুণ্ডু। চুল ধরে টেনে তুলেছে শূন্যে। দুলছে হলুদ মাথা দুটো। কাটা অংশ থেকে কীসব লাল রঙের ল্যাৎপ্যাৎ করছে। মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল সাতাশ বছরের পুরনো কষাই সতীশ চক্কোত্তির। বাজারের একমাত্র দশ ক্লাস পাস বাওন কষাই। বাচ্চাদের কেউ কেউ চিৎকার করে পালিয়েছিল। দু জন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। ভাগ্যিস রাস্তায় ভারি গাড়ি ছিল না। তাও একজনের পায়ের ওপর দিয়ে ভ্যান চলে গিয়ে থামলো। গোটা রাস্তা তখন থতোমতো।

 তখনই ঘটল পরের ঘটনাটা। দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যানটাকে রেখে তীর বেগে দুটো তিনটে ভ্যান টোটো টপকে রাস্তা পেরিয়েই তার দিকে মন দেওয়ার সুযোগ না পাওয়া পানু আর লোকজনকে হতবাক করে ছেলের মুণ্ডুটাকে ছোঁ মেরে নিয়ে পালালো রাম।


(২)

শিরশির করে উঠলো ডান ঘাড়ের ভেতরে। পরক্ষণেই কাঁটা দিয়ে উঠল নির্লোম হাতে। মুখটা লালায় ভরে গেছে। বুঝতে পারছে কষ বেয়ে নেমে আসবে এখুনি। এই সময়ে নেশা লাগে। চোখ বুজে আসে। আধবোজা চোখে তাকিয়ে থাকতে কী আরাম, রাম শরীর দিয়ে বোঝায়। বোঝানোর মতো শরীরটাই আছে তার।পাকানো। ডুমো ডুমো ঘা। পুঁজ গাঢ় হয়ে জমে আছে। সারা গায়ে মোটা মোটা শিরা। তামাটে মুখে গাল তোবড়ানো।গুটখা মাখা ফাঁকা দাঁতের কয়েকটি নীচের ঠোঁটের ওপর ইতস্তত ছড়িয়ে। পঁয়তাল্লিশ পাড় হয়েছে। তাই দুই একটা নেই। পেছনে ঘাড় পর্যন্ত শনের মতো চুলে বিগত যৌবন কালো আর ধুলো মিশে।চওড়া কপালে লম্বা লাল টিকা।

রাম সেনাপতি। মাংসের দোকানের পাহারাদার। মেছো বাঙালি ভয়াবহ রকমের মাংসাশী হয়ে ওঠার পর থেকে রোববারের বিক্রিটা ছড়িয়ে গেছে সপ্তাহ জুড়ে। ফলে এখন মাংসের দোকানগুলোতে এই মফস্বলেও বাড়তি লোক লাগছে। একটা মজারই চাকরি পেয়েছে রাম। দিনের শেষে ছাঁট-চর্বি-ক্ষুর কিছু না কিছু জুটে যায়।
না হলে, এর আগে কোনও নির্দিষ্ট কাজ ছিল না রামের। মা ছিল হাসপাতালের সুইপার। টুকরোটাকরা কাজ জুটে যেত হাসপাতালেই। রক্ত বেচেছে, মেটে পাচার করেছে। কিন্তু এখন এসব সুবিধা ওর মতো ছোটো কলজের মানুষের জন্য আর নেই। এখানেও বৃহৎ পুঁজির আমদানি হওয়ায় বাধ্য হয়ে কাগজ কুড়িয়েছিলো।হিরো টানে বলে খুব ভারি কাজ করা উচিত নয় সে জানে। তাই লাট খেতে খেতে এই কাজটা পেয়ে একটা সুবিধাও হয়েছে। আবার নিজের একটা নতুন দিক আবিস্কার করতে পেরেছে।

এই রামের আরেকটা দিক নিয়েই এই গল্পের সূত্রপাত।
--কিরে, তোর আজকে ধুনকি হলো না যে!
--উসসসসসসসসস
--উরে শালা, খাড়া হই গিয়েস নাকি!
মফস্বলের বাজারে খাসির দোকানের হেল্পার রাম একটা সেনসেশন হয়ে গেছে।ওর মালিক সতীশ যখন খাসি কাটে, মাংস পিস করে, রামের ভেতরে একটা অদ্ভুত বিবর্তন দেখা যায়। ওর হাত পা অবশ হয়ে আসতে থাকে। কোটরে ঢোকা চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। গোঙাতে থাকে রাম। শিউরে শিউরে ওঠে। কষ বেয়ে লালা গড়ায়।খাসিটা যখন জবাই হয়, প্রথম লক্ষণ দেখা দেয়। ধীরে বাড়ে। মেটে কাটার সময় বিশেষ করে। পুরো খাসিটা যখন বিক্রি হয়ে যায়, আবার স্বাভাবিক রাম।
মালিক ছাড়িয়েই দিত যদি না ঘটনাটা পরদিনই চাউর হয়ে গিয়ে ভিড় জমে যায়।পাশের দোকানের নরহরি বলেছিল,
--এরে তাড়াস নে। তোর বিক্রি বাড়বে। তাছাড়া তোর কাজ্ তো করা দেচ্চে।
--ফাউ লোকেও তো...
--তোর দুকান। ধমকায় সরায় দিবি।দেকপি টেংরি কিনতেও আসচে। ভিডিওর বাজার। নজর করপি কোন শালা ছবি নিচ্চে। ঘাপাৎ করে টাকা চাইবি। মালটাকে রেখে দে।
ঈষৎ দোনামোনা করে বলেছিল সতীশ
--দেকি ক দিন।
নরহরির কথা সত্যি হয়ে গেল। ফোনের ডিডিও করতে আদ দামড়া থেকে নিব্বা নিব্বি, ছাপড়ি ছাপ সবাই এসে হাজির। বিলক্ষণ ব্যবসা বেড়েছে সতীশের।অন্যদেরও। সামনে একটা চায়ের দোকানও গজিয়েছে। শহরের মাঝখানে বাস স্ট্যান্ডের পাশের পুরনো বাজার।ফলে রোজই খোরাক দেখতে নতুন নতুন মানুষের আমদানি হয়েই চলেছে।

রাতে বাজারটা ফাঁকা থাকে। রাস্তার দিকের দুটো চারটে আনাজ, মুরগি আর মুদিখানার দোকান খোলা কেবল। পেছনের মূল অংশ নির্জন হয়ে যায় পাঁচটাতেই। কমিটির কর্তা-ব্যক্তি আর কয়েকজন সিনিয়র ব্যবসায়ী আলাদা আলাদা গোলে নিজেদের মতো করে মদ -টিফিন খায়। সতীশদের গোলে দেশিই চলে। রমেশের ভাই ছোলার ওপরে লেগে থাকা পেঁয়াজ কুচিটা মুখে দিয়ে বলে,
--য়ানো তো সতীশ দা, রামু আগে আসপাতালে ছেলো তো। শিবুদের অনেক কাণ্ড-বাণ্ড দেকিচে। তন্ত-মন্ত করতে গিয়ে উলটি বাণ লেগি গিয়েস দেকো। ওই জন্যি আসপাতালে লাথ খেয়েস।
--আরে নাহ্। থাম তো ব্যাডা।
অর্জুন ধমকে বলেছিল,
--তুই দেকিচিস ও জকন মালের বডিতে হাত দ্যায়, পেলাসটিকে পোরে, চোক দুটো জলজল কত্তি থাকে। নাল পরে?
-দেয়িচি তো!
--মালটা আসপাতালে খুন কত্তো। মানুষের বডির মাল পাচার হয় তো! ওরে মাল খাওয়ায় শুনিচি একদিন। নিজিই নাকি কয়েকবার মেটে পাচার করিচিল।
--এর মদ্যি খুন আসচে কন তে!
--আরে অনেক সমা ডিমান্ড থাকলিউ বডি নেই। তকন রাস্তার হুব্বা টুব্বা ধরি পুচিয়ে ঝাড়ি দিত হইতো। একন খাসি কাটা দেকি ছিতি উতলোয়। তাই ওরাম করে।
--অ্যাঁ বাঁ, সবি সাউতের বই! এই বালের অজ্জুন এহেনে জ্ঞান মাড়িয়ে বাড়ি গিই সাউতির বই দেকতি দেকতি হাফ খাবে ফের।তাপর কে যে ঘোড়া খেলে তা সে বৌমাই কতি পারবেনে।

খিল্লিতে খিল্লিতে আসর হালকা হয়ে গেলেও সতীশের মনে কিন্তু খটকা থেকে যায়। খুনিটুনি নয়তো আবার! না, এমনিতে শান্ত। সন্ধেয় নিজের মতো নিজে পুরিয়া খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। অবশ্য আরও একটা ভয় ওকে ঘিরে আছে। শুনেছিল ওরই এক ভদ্রলোক কাস্টমারের কাছ থেকে। 

সেদিন জামাই ষষ্ঠীর আগের রোববার। বেশ সকাল থেকেই লাইন। আটটার মধ্যে দুটো খাসি শেষ। তৃতীয়টার জন্য অপেক্ষা করছিল লোকটা। সামনের চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাচ্ছিল সলক্ষণ রামের দিকে। একটা চাপা উত্তেজনা ছিল লোকটার।

পরে মাংস নিতে নিতে বলেছিল,
--জানো তো, তুমি বলেছিলে না, তোমার এই কর্মচারী মর্গে কাজ করত!                 
--হ্যাঁ বাবু
--জানো তো, নেটে সার্চ করলে পাবে, পৃথিবীতে একদল মানুষ আছে যারা আর কিছুতেই সুখ পায় না।
--হ্যাঁ বাবু, রামের তো ওই হিরো ছাড়া আর বাতিক দেকি না।
--আরে রাকো তোমার হিরো।ওটা নোড়া চাপা দিয়ে রাখার মতো। তালা কেস।
‌‌--কীরাম বাবু!
গলাটা ঈষৎ নামিয়ে বলেছিল লোকট
--এরা কেবল মড়া দেখলেই উত্তেজিত হয়...মানে, বুঝলে না...ইয়ে মানে, মড়া দেখলেই তবে যৌন উত্তেজনা জাগে। এরা মৃতদেহের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়।
--এ তো ভয়কন ব্যাপার বাবু।
--তুমি বলেছিলে না, ও মর্গে কাজ করত! ওখানেই বোধহয় এসব শিখেছে। এখন আর পারে না। বয়স হয়ে গিয়েছে। স্বভাব তো যায় না। তাই মরা ছাগল দেখলে ওভাবে রিঅ্যাক্ট করে বলে মন হয়।

শিউরে উঠেছিল সতীশ। পরে নেটে ভিডিও দেখেছিল। এখন অর্জুন আবার বলায় সেই ভয়টাও গাঢ় হচ্ছে। লোকটা আবার তন্ত্র মন্ত্র জানে না তো! এরা আবার ডাকিনী যোগিনী বশ করে তাদের সঙ্গে শোয় বলেও শুনেছে। ভয় করে সতীশের। পারতপক্ষে ধমকটমক দেয় না।
মরার সঙ্গে করার ব্যাপারটা কিন্তু মফসসলে বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। সেদিন দুই বৌদি ভিডিও করতে করতে একজন আরেকজনকে বলেছিল,
--না, না,ভয়ের কিছু নেই। মরা দেকলেই নাকি ওঠে!
আরেকজন গা মুচড়ে হেসে উঠেছিল। বুকের ভার আছে মাইরি। এই ভিডিও করার ব্যাপারটা ছেলেই দেখে। এই সব বৌদিদের সঙ্গে ভালোই পিরীত। টের পায় সতীশ। এখন চাকরির পরীক্ষার পড়া পড়তে বনগাঁ-হাবড়া করছে। করুক।লকডাউন না থাকলে এতোদিন আরেকটা কাউন্টার খুলে ফেলতো। আরেকটু সামলিয়ে উঠে পাশেই একটা কাউন্টার খুলে শুভকে বসিয়ে দেবে। তারপরেই বিয়ে। এখানে এখন অনেক নতুন হোটেল খুলছে। ব্যবসার গতি ভালোই।


(৩)

মা চলে যাওয়ার পর টিনের ঘর দুটো আরও পুরনো হয়েছে। নোংরাও। জানলা-টানলা খোলার সময় হয় না বলে একটা ভ্যাপসা গন্ধ সারাক্ষণ জুড়ে আছে। পায়া ভাঙা খাটটা ইঁটের ঠেকনায় এখনও উঁচু থাকলেও তোষক ফেটে তুলো নেমেছে মাটির এবড়ো খেবড়ো মেঝেয়। চাদর গোটানো রয়েছে পায়ের দিকে। ঝুল আর মশারি একাকার মিশে আছে। রামের এই ঘর,এই মলীন হয়ে যাওয়া একদমই মন খারাপ করে দেয় না আর। আসলে এখন রাম সারাক্ষণ আনন্দে থাকে খুব।

ছোটো বেলা থেকেই অনেকের ওপর খুব রাগ রামের। পাশের বাড়ির চম্পা ইঁদুর পুষতো যেন।হাসপাতালের দালাল ঘ্যানা গজ দিয়ে মুছে দিতো পাছার ফুটোয় লেগে থাকা রক্ত,বীর্য। তারপর র ডেটল ঢেলে খ্যাক খ্যাক করে হাসতো। হাসপাতালের সুপার, ডোম, সুইপার, চায়ের দোকানের ন্যাবলা...তালিকা খুবই দীর্ঘ।

আঘাত করতে পারেনি রাম। কাউকেই। মনে সাহস আনতে হুলোর পরামর্শে পুরিয়া ধরেছিল। তাতেও কাউকে মারতে পারার মতো সাহস করে উঠতে পারেনি।যখন মেটে পাচার করতো, একটা রিলিফ তৈরি হয়েছিল। এক একদিন সকালে উঠে ভেবে নিত এটা চম্পার
 মেটে, এটা শিবু ডোমের, এটা খান্নির ছল ডাক্তারের। যেদিন ডাক্তারের মেটে শিবশক্তি হোটেলের ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এসেছিল, আনন্দে ডবল চার্জ করে মাকে বদির টক করার নির্দেশ দেয়।

শুয়োরের চর্বির টক আর গরম ভাতে একাকার হয়ে গিয়েছিল রামের সন্ধেটা।

এখন এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাম বুঝতে পারছে একটা নিদারুণ অস্ত্র পেয়েছে সে। মানুষের বদলে গলগলে রক্ত তুলে মরতে বসা গলাকাটা খাসির থরথর করা মাংসের নিস্তেজ হওয়া অনুভব করে সে।যখন ছুরি ঢুকে যায় তুলতুলে তন্তু ভেদ করে,নিজেই যেন ছুরিটা। শরীর জুড়ে টের পায় মাংসের শিউরানি। উত্তেজিত স্নায়ুকোষগুলোতে ছড়িয়ে যেতে থাকে ক্রমপরম্পরায় নিস্তেজ হতে থাকা মাংস কম্পনের প্রতিটা বিট। ঝিম ঝিম করে। যন্ত্রের মতো কাজ করে বটে, কিন্তু শরীর দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে মাংসের মরে আসা।
এই নেশাটায় আজকাল রাগ ঝাল মিটে ঘুম পায়। এক পুরিয়াতেই অবসন্নতা সম্পন্ন হয়ে যায় রামের।

জানে তাকে নিয়ে অনেক গুজগুজ ফুসফুস চলে। কানে আসে। কিছু কিছু বোঝেও রাম। মনে মনে তর্ক করলেও মুখে কেবল বলতে পারে,
--বফফফফফস্ কতা টিক না। আ আ আ আ 

ছোটো থেকেই কথা বলতে গেলে চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যেত। তারপর হাওয়া বেরুনোর মতো শব্দে বেরিয়ে আসতো কয়েকটি দুর্বোধ্য আওয়াজ। হাসপাতালের ডাক্তার বলেছিল,
--তোর ছেলে গোঙা। এখানে হবে না।ভেলোর নিয়ে যা। তবে ঠিকই আছে।গরিব মানুষ। যত কম বলবি ততো মঙ্গল।

কাউকে বোঝাতে পারে না রাম এই নিজের ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাওয়া,ব্যর্থতম একজীবনের বিপরীতে ব্যবহার করে এই মাংস মরার ঘটনাটা। ওর রাগ মেটে, ঝাল মেটে। ক্ষিদে ঘুম হয়।
আঘাত করার সুখ পায় রাম। যম গণ দেওয়ার সুখ। এনজয় করে নেশার মতো।রাম বুঝে গেছে, মরতে মরতে পাল্টা মারতে পারার বড়ো স্বাদ। কী চরম, তীক্ষ্ম রিরংসা ওকে বিদ্ধ করে আনন্দ দেয়। ঝাল খাওয়ার মতো আনন্দ। চোখ-জীভ দিয়ে লালা পড়ে।

মরতে মরতে পাল্টা মারের খুব সুখ।


(৪)

পুলিশ চলে গেছে। এনকোয়ারি শেষ। লক্ষ্মী ঘুমিয়ে পড়েছে। মিউট করে লাল রঙের বাংলা খবরের চ্যানেল দেখছে সতীশ।রাত দুটো। এখনও ঘুম আসছে না। আজকে বাড়িতে বসেই বেশি খেয়েছে।তাও আসছে না ঘুম। ধাক্কাটা খুবই জোরদার।

মুণ্ডুটা নিয়ে যেদিকে দৌড়েছিল রাম, ওর বাড়ির দিক। বুঝেছিল সতীশ। ফোনে ছেলেকে ডেকে ভ্যানটা ধরিয়ে জনতার সঙ্গে ওকেও যেতে হয়েছিল। যেতে যেতেই বুঝতে পারে ওর অনুমান নির্ভুল। রাম বাড়িতেই গেছে। দরজায় ধাক্কা দেওয়ার পরও দরজা না খোলায় অবশ্য সবাই পুলিশ আসার জন্যে অপেক্ষা করছিল।কেননা রামকে উপস্থিত প্রায় সবাইই চেনে।তাই অতি উত্তেজিত না হয়ে অপেক্ষা করছিল পুলিশের। মিনিট দশেকের মধ্যেই পুলিশ দরজা ভেঙে ঢুকে দেখে কাটা মাথাটা কোলের ওপর নিয়ে লাল, ঠিকরে বেরুনো চোখে তাকিয়ে আছে রাম। সমস্ত পরিচিত লক্ষণ ফুটে উঠেছে। হলুদ মাথাটা ভিজে গেছে রামের অশ্রু-লালা-ঘামে। মুণ্ডুর দিকে ঝুঁকে আছে রাম নিস্পন্দ...

 (৫)

আই সি নিজে এসেছিলেন। মাথাটাকে আলাদা করে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। সিমেন লেগে থাকলে কেস হবে অন্য রকম। ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌তিনিও নেক্রোফিলিয়াকের গুজব শুনেছেন। সঙ্গে এতবড়ো একটা ঘটনা। অবশ্য মাতাল ডোমেদের এরকম বিচিত্র কাণ্ড তিনি বিলক্ষণ জানেন।ওকে ইতিমধ্যেই স্যাক করা হয়েছে। তিনিও হেফাজতে নিতে দেরি করেননি।

আড়াইটে পেরিয়ে গেল। এখনও ঘুম আসছে না। মরা দেখলে তেতে উঠতো লোকটা। মাথাটা ভার ভার।চোখ বুজে আসছে কিন্তু টিভির ছবি থেকে ফেরানোর যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না সতীশ।

কোথাও একটা ট্রেন এক্সিডেন্ট হয়েছে।সার দিয়ে সাদা কাপড়ে মোড়ানো মড়া শোয়ানো আছে। নীচ দিয়ে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন কথা। এবার স্ক্রিন অর্ধেক হয়ে মড়ার ছবি চৌকো, ছোটো হয়ে পাশেই আরেকটা চৌকো ছবি চলে এলো। একটা জ্যান্ত মানুষের মুখ। কে যেন এই চেনা মুখ! খুব চেনা। নাহ্ কিছুতেই মনে পড়ছে না। লোকটা চশমা খুললো। চোখ চিকচিক করছে।কাঁদছে নাকী! না তো। আঙুল তুলে কাউকে শাসাচ্ছে আবার।সতীশকেই?হতে পারে। চেনা মানুষ তো!

মড়া শোয়ানো দেখে তেতে গেছে মানুষটা।ক্যামেরা ওকে দেখাচ্ছে...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন