অরিত্র দ্বিবেদী
গত ১৮ই ডিসেম্বর, দোঁহায় গোটা পৃথিবী দেখল, দ্বীপান্তরিত এক রাজার ফিরে আসা। দেখল তার দিগন্তকে ধাওয়া করা অশ্বমেধের ঘোড়া। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, সেই রাজার নাম লিয়োনেল মেসি।
কিন্তু, গত ৯ই ডিসেম্বর, একই জায়গায় দেখা গিয়েছিল অন্য একটা ছবি। আগামী রাজা বলে যাঁকে চিহ্নিত করা হয়েছিল বছর সাতেক আগে, যুদ্ধের ময়দানে তাঁর দুর্ভাগ্য। সেই ভাগ্য দ্বারা নির্বাসিত রাজকুমার নেইমার ডা সিলভা স্যান্টোস জুনিয়ার।
এই প্রজন্মের কাছে যেটা মেসি বনাম নেইমার, সেটাই গত প্রজন্মের কাছে তেভেজ বনাম রোনাল্ডিনহো বা আরও আরও আগে মারাদোনা বনাম জিকো। ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা। শিল্প আর কাঠিন্য। কোপা আমেরিকার কুলীন দেশ, যাঁরা পা দিয়ে ছবি আঁকতে জানেন। ফুটবল পীচে কখনো ফুটে ওঠেন এডভার্ড মুঞ্চ কখনো ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ তো কখনো ক্লদে মনেট।
ব্রাজিল, ফুটবলের ঋতুতে এখানে চিরবসন্ত। এখান থেকে প্রত্যেক প্রজন্মেই এমন এমন কিছু খেলোয়াড় উঠে এসেছেন, যাঁরা চমকে দিয়েছেন, বদলে দিয়েছেন সমস্ত ছক। কখনো একা প্রহরীর মতন একজন বা দুজন কখনো একঝাঁক। অপরদিকে আর্জেন্টিনাও সেই ক্ষমতায় বলীয়ান, ব্রাজিলের মত একঝাঁক না হলেও আর্জেন্টিনা জন্ম দিয়েছে এমন কিছু ফুটবলারের যাঁদের কাজ একটা প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাতে পারে, যাঁরা লিখে দিয়ে যান অমরচিত্র কথা।
বাঙালির বরাবরের সমবন্টন, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, সৌরভ-শচীন বা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। এবারে কাতারে যা ঘটল, তা রূপকথার চেয়ে কম কিছু নয়।
ব্রাজিল, এমন ফুটবল খেলছিল, যেমন ক্লাব ফুটবলে খেলা হয়ে থাকে। মডার্ন ফুটবলে, ডিফেন্সিভ ট্র্যানজিশনের সময়ে, মাঠটাকে যদি ভার্টিকালি ভাগ করা যায় চারটে লাইনে তাতে প্রতি লাইনে তিনজন করে খেলোয়াড় থাকেন, আর একেবারে সামনে একজন(যিনি স্ট্রাইকার)। আর অ্যাটাকের সময়ে ঠিক উল্টো, তবে সেটা হরাইজন্টালি। ব্রাজিল প্রতিটা ম্যাচ এভাবেই খেলেছে এবারে। নেইমারের মত চোটপ্রবণ একজন খেলোয়াড় খেলেছেন ফ্রি রোলে। এই নীতি এইজন্যই গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রেস করার সময় তাঁর ওপর চাপ যাতে একটু কম পড়ে। তাঁর জায়গাটা ভরাট করার জন্য ছিলেন লুকাস পাকেতা। এ ছাড়াও, ভার্টিকাল বল, এই কোণ থেকে ওই কোণ। ডামি খেলেছেন। দুরন্ত কিছু গোল দেখেছি সবাই। শেষ ম্যাচে, যে গোলটা হয়েছে, যাতে ভেঙ্গেছে ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্স, শুধু ওয়ান টাচে বক্সে পৌঁছলেন নেইমার, তারপর নিয়ার পোস্টে অসাধারণ একটা ফিনিশ। তবু শেষ রক্ষা হয়নি। নেইমার, যাঁকে বলা হত মেসির উত্তরসূরি, যিনি ওই সিংহাসনে বসবেন, মেসির রাজ্য পুনরুদ্ধারের মাঝেই, মুখ অন্ধকার করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সদলে নির্বাসিত হলেন তিনি। পিছনে পড়ে রইল, কিছু ছবি, কয়েক টুকরো ম্যাজিক আর উজ্জ্বল সেই সিংহাসনটা।
অপরদিকে আর্জেন্টিনা, কোচ স্কালোনি শুরুতেই বুঝেছিলেন, নান্দনিক নয়, বরং লড়াকু ফুটবল চাই জিততে গেলে। আর্জেন্টাইন কোচেদের এই বৈশিষ্ট্য আমরা আগেও দেখেছি, যেমন দিয়েগো সিমিওনে দীর্ঘদিন ধরে করে এসেছেন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে নিয়ে। তাই টিমে দি পল ছিলেন তাই ছিলেন আকুনহা। আর্জেন্টাইন টিম যেন পানিপথের যুদ্ধের আকবরী সৈন্য। হিমুকে পরাজিত করার জন্য, একদল পদাতিক বল্লমধারীর মাঝে লুকোনো একা তিরন্দাজ। তিনি লিয়োনেল মেসি। মেসির কোচ পেপ গুয়ার্দিওয়ালা একবার বলেছিলেন যে, "যদি মেসির গৌরব বুঝতে হয়, তবে তাকে দেখো অফ দ্য বল। যখন ওর পায়ে বল থাকেনা, দেখবে ওর মাথাটা এদিক ওদিক করে সবসময়, কখনো স্থির থাকে না। আমরা যেটা মাঠের বাইরে করি, ও সেটা মাঠে থাকতে থাকতেই করে, ম্যাচ রিডিং আর অপনেন্টকে স্ক্যানিং।" উনি পা ব্যবহারে নন, মস্তিষ্ক ব্যবহারে জিনিয়াস। তাই বোধহয় স্প্যানিশ ডিকশনারিতে মেসি শব্দের অর্থ লেখা আছে -"God's way to play Football"।
ফাইনালে সেটা পরিষ্কার বোঝা গেল। মেসি প্রথমার্ধে দুটো কাজ করেছেন শুধু, (ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশম্প বুঝেও কিছু করতে পারেননি) এক, ডি মারিয়াকে ভার্টিকাল বল, প্রায় ডায়াগোনালি খেলা, যাতে তাঁকে মার্ক করে রাখা অন্যতম সেরা সেন্টার ব্যাক জুলস কুন্ডেকে পুরোপুরি খেলা থেকে বের করে দেওয়া যায়, আর দুই, ক্রমাগত উপামেকানো আর ভারানেকে অফ দ্য বল এন্গেজ করে রাখা, যাতে আর্জেন্টিনার অন্য খেলোয়াড়রা সুবিধা পান। যেমন পেলেন ডি মারিয়া।
এখানেই শেষ নয়, গত দশ বছরে মেসি যে সমালোচনার মুখে বারংবার পড়েছেন আন্তর্জাতিক সাফল্য না পাওয়ার জন্য, সেই অসম যুদ্ধের মুখে যোগ্য জবাব গত ১৮ মাসে তিন তিনটে ট্রফি। মেসি যখন বিশ্বকাপ হাতে নিয়ে দাঁড়ালেন মঞ্চে, একা, মনে হচ্ছিল আকাশবাণী হচ্ছে, "A horse a horse! My kingdom for a Horse!" দীর্ঘ ৩৬ বছরের শাপমুক্তিতে ওপর থেকে বলে উঠছেন ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা।
আর রিও দি জেনেইরোতে কোনো অন্ধকার ঘরে বসে একবুক দুঃখ নিয়ে নেইমার লিখছেন, "hermano" ছবি দিচ্ছেন কাপ হাতে মেসির। "hermano" কথার বাংলা করলে দাঁড়ায়, "আমার মায়ের পেটের ভাই"। এইখানেই জয় ফুটবলের। ভালোবাসার। শিল্পের। নেইমার আর ব্রাজিলের হয়ে খেলবেন কিনা তা নিয়ে ধোঁয়াশা এখনো, আগামী ২৬ শে মার্চ থেকে শুরু হবে পরের বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব। মেসি খেলবেন বলেছেন। নেইমার, ঠিক করেননি, তিনি মানসিকভাবে বিধস্ত।
তবু থেকে যাবে ফুটবল, থেকে যাবে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার উন্মাদনা। স্কিল বনাম লড়াকু মানসিকতার যুদ্ধ। আর থেকে যাবে কমেন্টেটর ডেরেক রে 'র আবেগমথিত কন্ঠস্বর:
"মেসিজিশিয়ান!"
"ওহ নেইমার, ইটস ব্রাসিলিয়ান্ট!"
Tags:
প্রবন্ধ