দোঁহা

কাপুরুষ (?)



 অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প

ফুটব্রিজের উপর থেকে গার্গী নীচের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লোকাল ট্রেনটাকে দেখছিল। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। সংক্রান্তি কেটেছে এই মাত্র কয়েকদিন। সন্ধ্যে নামলেই ধোঁয়াশার দাপট শুরু হয়। উপর থেকে হ্যালোজেনের আলো আর সেই ঘিরে আসা ধোঁয়াটে অন্ধকারের ভিতর ট্রেনটাকে কেমন যেন রহস্যময় পুরনো এ্যাডভেঞ্চারের মতো মনে হচ্ছিল। অনেক মাসের ব্যবধানে গার্গী শহরে ফিরেছে। সন্ধ্যে হলেই তাই পুরনো পাড়াতে সে এদিক সেদিক হাঁটতে বেরিয়ে যায়। ফেলে যাওয়া শহরের রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ-বর্ণ-স্পর্শকে ঝুলি ভরে সংগ্রহ করে নিতে থাকে। এইটুকুই তো সম্বল তাদের। সম্বৎসরের আয়োজন, অথবা সঞ্চয় বেঁচে থাকার। আরব সাগরের লোনা জলহাওয়ার পরশ, অথবা দিনে-রাত্তিরে ডেডলাইন সামলিয়ে ফাইনাল এডিটোরিয়ালের প্রুফ দেখে দেওয়া, থার্ড পেজের নীচের কলামে এক্সটেণ্ডেড নিউজ আইটেমের শেষ কপি জমা দেওয়ার তোড়জোড়। এরই মধ্যে গার্গী নিজের শোবার ঘরের বড় কাচের আয়নাতে, নিজের আগাগোড়া সুঠাম অবয়বটাকে চোখ ফিরিয়ে দেখলে পরেও বুঝতে পারে কানের উপরকার চুলগুলো সাদা হয়ে আসতে শুরু করেছে। বয়স হচ্ছে তার।

ট্রেনটাও হর্ন বাজিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। কাজ-ফেরতা লোকজন হুড়োহুড়ি করে ঠেলে উঠতে চাইছে। ধোঁয়াশার পরশ ছিঁড়ে ঠেলে বেরিয়ে ট্রেনটা চলে গেল। ক্যানিং লোকাল ছিল বোধহয়। ভিড়টাও তাই সেই রকমই হয়েছিল। ক্যানিং বলতেই গার্গীর মনে পড়ে তালডি, চম্পাহাটি, ঘুটিয়ারি শরিফ। ওদের বাড়িতে যারা কাজ করতে আসত, তাদের বেশিরভাগেরই বাড়ি ছিল ওই লাইন বরাবর। গার্গীর মনে আছে সেসব। নামগুলোর সঙ্গে তাই ছোটবেলা থেকেই তার পরিচিতি গড়ে উঠেছে। ওর স্টেশনের নাম যাদবপুর। মাঘ দ্বিতীয়ার রাত। গার্গীর মনে হল একবার ফুটব্রিজ দিয়ে নেমে স্টেশনের দিক থেকে ঘুরে আসবে। আশৈশব এই রেল-প্ল্যাটফর্মকে জড়িয়েই তার ভালোমন্দ স্মৃতিদের আসা-যাওয়া। প্রথম কলেজ-জীবন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। যাদবপুর স্টেশন মানেই তাই মোড়কে মোড়ানো নস্টালজিয়ার পরত। পেটাই পরোটা, চায়ের গ্লাস, বাপুজী অথবা স্লাইস কেক। ঘুঘনির বাটি নিয়ে সময় কাটানো। সস্তা জামাকাপড়ের দোকান। সাউথ ডিভিশনের লোকালে যারাই বা যাতায়াত করেছে, এমন একেকটা স্টেশনের মেজাজ তাদের পক্ষে বুঝে নিতে অসুবিধে হবে না। গার্গী ফুটব্রিজ বেয়ে নীচে নেমে এলো।

অস্থায়ী চায়ের দোকানগুলো এ্যালুমিনিয়াম অথবা টিনের পাতে মোড়ানো ঠেলাগাড়ির মতো। উপরে আবার কানা তোলা রেলিংয়ের মতো থাকে। কাচের বয়ামে সাজানো কেক, বিস্কুট, ক্রিম রোল ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য। তেমনই একটা চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা নিল গার্গী। কোরোনার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে কাচের গ্লাসের ব্যবহার কমে এসেছে অনেক। কাগজের চায়ের কাপ। ছোট ছোট অক্ষরে প্রতীক দিয়ে লেখা রয়েছে ‘রিসাইক্লেবল’ অর্থাৎ কিনা এই কাপগুলো নতুন করে আবারও কাগজের কাপ বা অন্য কিছু বানানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা চলে। ৭০এমএল মাপের কাপ। হাত বাঁচিয়ে সে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। তখনই পিঠের উপরে আলতো করে টোকা মারল কেউ।

-“গার্গী না?”
-“আরে সুশোভন তুই!” হাতের কাপটা একটু চলকে গিয়েছিল। সেটাকে সামলাতে সামলাতেই গার্গী বলে ওঠে, “কতদিন পর, কেমন আছিস তুই? কি খবর বল?”

সুশোভন চেহারাতে বিশেষ পালটায়নি বলেই তার মনে হলো। কেবল একটু ভারিক্কি ভাব এসেছে। বয়সের ছাপ ওজনেই স্পষ্ট হয় এখন।সুশোভন বলে, “আমি তো বেশ আছি। দিব্যি আছি। খবর তো তোরই এখন!” গার্গী একটু অবাক হয়ে যায়। “ফাটিয়ে লিখছিস, প্রতি সপ্তাহে একটা করে বড় স্টোরি আসছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ডিবেট প্যানেলে বসছিস। তুই কিন্তু লাগিয়ে দিলি ঠিক, জার্নালিজমটা – কি বলিস?” সুশোভন হাসছে। গার্গী একটু অবাক হয়। হ্যাঁ কাগজের দুনিয়াতে তার একটু পরিচিতি হয়েছে বটে, সে কথা সত্যি। কিন্তু কলকাতায় তার বন্ধুরাও - বিশেষত সুশোভনের মতো কেউ যে তার এতখানি খবর রাখবে, এতটাও সে বিশ্বাস করে উঠতে পারে না। “আরে তোর সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলেই আমি নজর রাখি রে ভাই। একটা স্টোরিও বাদ দিইনা। দারুণ লিখছিস রে তুই!” সুশোভন বলে চলে। গার্গী কিছু একটা বলতে গিয়েও একটু থেমে যায়। তারপর প্রসঙ্গ এড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “চা খাবি তো ? দাঁড়া চা বলি।” সুশোভন ঘাড় নাড়ে। “সঙ্গে একটা করে স্লাইস কেক নিই? এই সব কেকগুলোর কিন্তু আলাদাই টেস্ট হয়,” আপন খেয়ালেই গার্গী বলে ওঠে হঠাৎ। মাটির কাছাকাছি এই সমস্ত ছোট ছোট জিনিসগুলোকেই হাতে করে তুলে নেওয়ার যে সুখ, এগুলোর থেকে কোনও দিন, কোনও কারণেই যেন বা দূরে সরে যেতে না হয়; নিজেকে সে এমনটাই শিখিয়ে এসেছে। হাতে হাতে কেক তুলে নিয়ে দুজন দুজনের দিকে তাকায়।

-“তারপর, তোর খবর বল,” গার্গীই সুশোভনকে জিজ্ঞেস করে।
-“আমার আর খবর, প্রোগাম লিখে চলেছি। আর কোডিং, টেস্টিং, প্রেজেন্টেশন,” সুশোভন হাসতে চেষ্টা করে, “আমাদের পৃথিবীটা তো একঘেয়ে, আজ্ঞাবহ দাসেদের জগৎ।” গলায় তার স্পষ্ট ফ্রাস্ট্রেশনের ছাপ। গার্গী এটা লক্ষ্য করেছে। সে এবারে পালটা জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু তোরও তো তার জন্য লেখা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। এবারেও তো তিনটে না চারটে অনলাইন শারদীয়ায় লিখেছিস দেখলাম।” সুশোভন অবাক হয়ে যায়।

-“তুই আমার লেখা পড়িস? মানে খেয়াল করিস!”
-“কেন করব না, আমার তো পেশাগত ভাবেই লেখালিখির জগৎ। তোর সব লেখা না পড়লেও, চোখে পড়লে ঠিকই পড়তে চেষ্টা করি।”

প্রচণ্ড শব্দ করে হর্ন বাজিয়ে একটা ট্রেন এসে দাঁড়ায়। হুড়োহুড়ি করে লোকজন ওঠানামা করছে।

“লেখাটা চালু রেখেছি রে, যে করেই হোক লেখা চালু রাখতেই হবে আমায়। স্বপ্ন তাড়া করার বয়স কি একেবারেই পেরিয়ে গিয়েছে?” সুশোভন মাথা নেড়ে দরাজ গলায় জিজ্ঞেস করে। গার্গী মনে মনে হাসে। ফ্রাস্ট্রেশন থেকে চূড়ান্ত অপটিমিজমের মধ্যে বেশিরভাগ লোকজনের এই অযাচিত লাফালাফিটাকে সে অনেকবার করে দেখে এসেছে। এদের মনের জোর থাকে না। ঘষতে ঘষতে দু’চার কলম লিখে যাওয়াকেই এরা বিরাট স্ট্রাগল বলে মনে করে। গার্গীর এদের জন্য করুণা হয়। তার মাথায় চট করে একটা ভাবনা খেলে যায়। সে সুশোভনের দিকে তাকায়।

-“চল হাঁটি, সুকান্ত সেতুর উপরটা থেকে ঘুরে আসি। তারপর ঝিলপাড়ে গিয়ে বসবখন। তোর হাতে তো সময় আছে কিছুক্ষণ?” গার্গী প্রস্তাব দেয়। সুশোভন মাথা নাড়ে। হাতের কেক শেষ হয়ে এসেছে। ওরা চায়ে শেষ চুমুক দেয়।

সুকান্ত সেতুর উপরে বিশেষ একটা জায়গা আছে। আছে না বলে ছিল বললেই ভালো হয় বোধহয়। কিছুদিন আগেই সেই জায়গাটা দিয়ে ঘুরে আসতে গিয়ে গার্গী দেখেছে পুকুরটাকে বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। ভলিবল খেলার মাঠ হবে বোধহয়। নয়তো বা পার্কিং লট। জায়গাটা কেপিসি হাসপাতালের যে কম্পাউণ্ড, তারই ভিতরে। সেখানে ছোট মতো একটা পুকুর ছিল। সেতুর উপরে দাঁড়িয়ে দিব্যি নীচের ঘন কালো জল আর জলের ধারে পড়ে থাকা রাবিশ আর জমে থাকা কচুরিপানার জঙ্গল দেখা যেত। মশার একটু উপদ্রব থাকলেও অনেক সন্ধ্যেতেই কোনও না কোনও বন্ধুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে হলুদ হ্যালোজেন আলোর তলায়, ঘন কালো জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গুরুগম্ভীর বিষয়ে আলোচনা চলত। সেতু কাঁপিয়ে বড় বড় বাস অথবা ম্যাটাডরগুলো ছুটে যেত। সেই কম্পনকে বিভিন্ন মাত্রা অনুযায়ী অনুভব করা যেত। হ্যালোজেন আলোর তলায় কুয়াশারা জমে আছে এখন।

-“স্বপ্ন তাড়া করার বয়স কি কখনও পেরিয়ে যায়?” গার্গীই জিজ্ঞেস করে, “রুশদির প্রথম উপন্যাস ৩৪ বছর বয়সে। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার ১৩ বছর পর। সেই সময়ে একাধিক এ্যাড এজেন্সিতে চাকরি আর তাঁর কথাতেই ট্র্যাশ কিছু নভেল লেখার চেষ্টা। স্বপ্নের প্রথম ধাপ কখন কোন বয়সে এসে পৌঁছয় কেউ তো জানে না,” গার্গীরা ঠিক ওই হ্যালোজেন বাতিটার তলায় এসে দাঁড়িয়েছে। “ঝুঁকি নিতে পারলে স্বপ্নকে তাড়া করার সত্যিই কোনও বয়স নেই, প্রশ্ন হচ্ছে সেই ঝুঁকি নেবার মতো ধক সকলের আছে কিনা,” গার্গী একটা সিগারেট ধরায়। সুশোভনকে হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা অফার করে। সেও হাত বাড়িয়ে একটা সিগারেট তুলে নেয়। “ঝুঁকি নেবার সুযোগটাও তো দরকার, কে দেবে সেই সুযোগ?” সুশোভন বলে, “লেখার জগতে পুরোপুরি যেতে চাইলে রোজগারের পথ বলতে সাংবাদিকতা। ডিগ্রি না থাকলে সেই চাকরিতেই বা সুযোগটা আসবে কোত্থেকে?”

“ধর যদি আমিই তোর একটা সিভি প্লেস করে দিতে চেষ্টা করি?” গার্গী সোজাসুজি সুশোভনের চোখের দিকে তাকায়, “আজকাল বেশ কিছু উঠতি পোর্টাল আছে, যেখানে সাংবাদিকতার সুযোগও রয়েছে। যদিও বেশিরভাগেরই ভাষাটা ইংরেজি, তবে বাংলাতেও সুযোগ আসছে। আমার কাছে একআধজন বলেছিল, যদি কেউ কমবয়সী আগ্রহী থাকে। কম বয়স না হলেও তোর যেহেতু লেখার একটা অভ্যাস আছে, ফুলটাইমার হিসেবেই আমি তোর কথা বলতে পারি। কিন্তু তুই কি সত্যিই যেতে আগ্রহী থাকবি?” সুশোভন উজ্জ্বল চোখে তাকায়। সেতু কাঁপিয়ে একটা ভারী বাস যাত্রীবোঝাই হয়ে পার হয়ে যাচ্ছে তখন। গার্গী মৃদু হাসে। “তোর সেরা লেখাগুলোর মধ্যে থেকে, যেগুলো ফিচার হিসেবে লিখেছিস, খান তিন-চার পাঠিয়ে দিস আমায়। দেখছি কতদূর কি করতে পারি।” বাসটা পার হয়ে গেল।

[***]

সুশোভন যখন অফিস যায় ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস কুয়াশায় ঢেকে থাকে তখন। নতুন গজিয়ে ওঠা, ঝাঁ চকচকে সমস্ত আবাসনের মধ্যে দিয়ে হঠাৎ একেকসময়ে দিগন্তবিস্তৃত চাষজমি দেখা যায়। নালার মতো একাধিক জলস্রোত সেসবের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। পূর্ব কলকাতা জলাভূমি অঞ্চল এখন কেবল অতীতের ছায়াটুকু নিয়ে বেঁচে আছে। অনেক দূরে দেখা যায় ধাপার মাটির স্তুপ। রাস্তার পাশেই কপির ক্ষেত আর তারই মধ্যে বড় বড় বিজ্ঞাপনী হোর্ডিংয়ের দাপট। আবাসনও উঠছে খুব। বাসে যেতে যেতেই সুশোভন ঘুমিয়ে নেয়। চোখ মেলে দেখে কুয়াশা ভরা মাঠের প্রান্তে একেকটা সুউচ্চ, সুসজ্জিত ইমারত মাথা তুলে আছে। জায়গাটার নাম রাজারহাট। অফিস এসে পড়েছে তার।

লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে কখনও শামিল হয়নি সুশোভন। ওর লেখার বৃত্তটাও তাই অনেকই পোশাকি। অনেকটাই পপুলারিস্টিক ধাঁচের। তবুও ওর লেখার পিছনে একটা পরিশ্রম থাকে। এই দেশের মাটিতে যেখানে অশীতিপর যাজক-বৃদ্ধকে জল খাবার জন্য প্রয়োজনীয় গেলাস অথবা নার্ভের দুর্বলতা রয়েছে বলে হাত কাঁপার সমস্যা এড়াতে চুমুক দেওয়ার জন্য সামান্য স্ট্র-টুকুকে অবধি না দিয়ে জেল হেফাজতে মেরে ফেলা হয়, সেই দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে সাহসী হয়ে উঠতে চাইলে অনেকটাই বেশি করে সাহসের প্রয়োজন হয়। সুশোভন সেকথা হৃদয়ঙ্গম করে। ও তাই নিজের গণ্ডিতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। তবুও লেখার প্রয়োজনে সে মানুষের কথা লেখে। চেষ্টা করে সমস্ত শ্রেণীর বক্তব্যকে তুলে আনতে। গল্পে সাজাতে চায় সমাজের প্রতিটা স্তরেরই উপাখ্যান। সুশোভনেরা একেকটা ধাপ অবধি পৌঁছিয়ে যেতে পারে। তারপর বাকি পড়ে থাকে নিজস্ব ভবিষ্যৎ ...

অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সুশোভন আবারও স্টেশন প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকায়। সুকান্ত সেতুর উপরে, যাদবপুরের একেকটা রাত। কুয়াশায় মোড়া স্টেশন প্ল্যাটফর্ম, নিত্যযাত্রীদের হুড়োহুড়ি। ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে। সেতুর নীচে একটা কাঁচা শুয়োরের মাংসের দোকান হয়েছে। কখনও চেখে দেখা হয়নি। সুশোভনের পর্ক খেতে ভালো লাগে। মদ খায় না সুশোভন। স্টেশনের উপর নেমে আসা ধোঁয়াশার পরত পেরিয়ে গার্গীকে সে আর দেখতে পায় না। তার ফোন এসেছে।

হাতে ধরা চায়ের কাপটাকে সামলে নিতে নিতেই গার্গী ফোনটাকে রিসিভ করে নেয়, ওপাশ থেকে ইয়ারফোনে গলা শুনতে পায়।

-“হ্যালো, গার্গী কেমন আছো? ব্যস্ত নাকি? ছুটি কেমন কাটছে?”
-“আরে হ্যাঁ সনৎদা বলুন, আমি ভালোই আছি বলতে পারেন। ছুটিও তো প্রায় ফুরিয়েই এল এবার,” গার্গী জবাব দেয়।
-“হা হা, তা তো বটেই। আবার তাহলে সেই ব্যাক টু মুম্বাই আর কাজের জগৎ। সে যা হোক, আমি একটা অন্য দরকারে ফোন করেছিলাম।”
-“ওই সিভিটার বিষয়ে তো? বলুন কি দাঁড়ালো?” গার্গী কি এক মুহূর্তের জন্যও অস্বাভাবিক কিছু কল্পনা করে বসে? একটাও কি বিপ্লব হবে না কোথাও?

গার্গী অতটাও আশাবাদী হতে পারে না। তবুও কোথাও ... ভাবতে ভাবতেই ওপাশ থেকে সনৎ রায়ের উত্তর ভেসে আসে।

-“নাঃ আমি কিন্তু মেইল করেছিলাম জানো। প্রাথমিক ইন্টারভিউয়ের পর এইচ আর লেভেলে পার্সোনাল ইন্টার্যাাকশনের জন্য সময় চেয়ে। কোনও রেসপন্স আসেনি। মাইনেপত্রের ব্যাপারেই হয়তো, জানি না। আসলে এনারা ঠিক -”
-“বিপ্লবের জন্য তৈরি নন,” গার্গী জবাব দেয়, “এনারা স্বপ্নবিলাসেই বিপ্লব করতে ভালোবাসেন। মাইনে যতই কম হোক না কেন, ঠিক চালিয়ে নিতে পারব, প্যাশনের জন্য এটুকু ছাড়তে পারব না – ইত্যাদি বুকনি দিয়ে বেড়ান!” গলাটা কি একটু তিক্ত হয়ে গেল তার?
-“আরে, তুমি আবার রেগে যাচ্ছো নাকি? আমি কিন্তু কিচ্ছুটি মনে করিনি।“

গার্গী গলা নামিয়ে নেয়।

-“তা হলেও, আমি কষ্ট করে আপনাকে পাঠালাম সিভিটা। আপনিও সময় নিয়ে দেখলেন, চেষ্টা করলেন,” গার্গী ক্ষমা চেয়ে নিতে থাকে, “আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।”

সুশোভনও যে এই একই শ্রেণিতে পড়বে সে আন্দাজ করতে পেরেছিল। তবুও কষ্ট হয় তার। একটা তাচ্ছিল্যবোধ জেগে ওঠে। এরা আসলে কাপুরুষ, ঝুঁকির কথা মুখে বলাতেই এদের যত গা গরম। আসল জায়গাতে ... গার্গী আবারও একবার সনৎ রায়ের কাছে মাপ চেয়ে নেয়। সুশোভনের বাসটা বাসস্ট্যাণ্ডে এসে দাঁড়িয়েছে। বাস থেকে নেমে এসে সুশোভন আকাশের দিকে তাকায়।

[***]

ওদের বাড়ির দোতলার ছাদের উপর সুশোভন দাঁড়িয়েছিল। ওর মা’ও কখন জানি পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন।

-“আরতি চলে গেল। বলেছে সামনের মাস থেকে ওদের নাকি একশো টাকা করে বেশি দিতে হবে। আয়া সেন্টার থেকেও নাকি ওরা ফোন করে জানাবে।”
-“আগে জানাক,” সুশোভন ছোট্ট করে জবাব দেয়।
-“এভাবে সত্যি কতদিন, জানি না,” সুশোভনের মা হা-হুতাশ করেন, “সাড় নেই, এভাবে বিছানায় পড়ে রয়েছে মানুষটা,”
-“তুমি নীচে যাও মা। আমি নীচে আসছি।” সুশোভন পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে আনে।

তিনমাস হয়ে গেল সুশোভনের বাবা শয্যাশায়ী। মাসে মাসে মোটা টাকার ওষুধ আর আয়ার খরচ। ওর মা নেমে যেতে যেতে স্বগতোক্তি করেন, “ভাগ্যিস চাকরিটা ছাড়িসনি তুই। তোর এই এত বড় বেসরকারি মেডিক্লেম আর ডাক্তারির খরচ – এখন যে চাকরিতে যেখানে আছিস, সেখানে না থাকতিস যদি, আজ কিই বা হতে পারত, কখনও ভেবে দেখেছিস?” মা’র গলা সিঁড়িতে মিলিয়ে যায়। সুশোভন সিগারেট নেই দেখে হাতের প্যাকেটটা হাত থেকে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে। অন্ধকার।

সনৎ রায় আবারও একবার ফোন করেছিলেন। সুশোভন ফোন ধরেনি। তার আগের দিন রাত্তিরেই ওর বাবার শরীর খারাপ হয়। অত কম মাইনেতে রিস্ক নেওয়াটা আর সম্ভব ছিল না। সুশোভনের সাংবাদিক হওয়া হয়নি। গার্গী ওকে কাপুরুষ বলে জানে। সুশোভন স্বচক্ষে দেখতে পায়, ওর ভিতরকার না হওয়া সাংবাদিক সত্ত্বাটা এক ছুটে ওর শরীর থেকে বেরিয়ে এসে দোতলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে হঠাৎ নীচেকার অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ওর শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে।

[সামনের জুলাইতেই সুশোভনের মাইনে বাড়বে। এইচ আর বিভাগ থেকে এমনই আশ্বাস মিলেছে তার।]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন