দোঁহা

রামকৃষ্ণ বুয়া ও সেই সন্ন্যাসী 



প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত 

কে গাইছে এমন ভাবে? কার গলা ধ্বনিত হচ্ছে আশ্রমের আনাচে কানাচে? আহীর ভৈঁরোর এমন স্বর্গীয় আলাপ, আওচার, শুদ্ধ স্বরপ্রয়োগ...সকাল যেন অন্যরকম সেজে উঠেছে! যেন রেওয়াজে বসেছেন স্বয়ং পিনাকপাণি! এমন উদাত্ত কণ্ঠস্বর কার? একলহমায় ঘুম ভেঙে যায় পণ্ডিত রামকৃষ্ণ বুয়া ভাজের (২৮ নভেম্বর ১৮৭১ - ৫ মে ১৯৪৫)।

বরাবর সাতসকালেই ঘুম থেকে উঠতেন বুয়া। সেদিনই ব্যতিক্রম। বহুদূর নেপাল থেকে ফিরছেন তিনি। বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন এবার নেপালের রাজ দরবারে। নেপালের মহারাজ তাঁর গানের বড় ভক্ত। শ্রদ্ধা ভরে ঠাঁই দিয়েছেন তাঁকে প্রাসাদের অন্দরমহলে৷ দিয়েছেন প্রাপ্য সম্মান।

দীর্ঘদিন সেখানে কাটিয়ে এবার বাড়ি ফেরার পালা। কিন্তু সে বড় দূরের পথ৷ তাই 'এন রুট' আতিথেয়তা নিয়েছেন বেরিলির এই আশ্রমে। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসে, বলাই বাহুল্য, শরীর মন ক্লান্ত। আর তা-ই বুঝি সেদিন ঘুম থেকে উঠতে...

অথচ ভোর থাকতে থাকতেই তাঁর খুলে যেত চোখ। নিম-দাঁতন করে সারতেন আরাধ্য বিঠলদেবের নিত্য পুজো-আর্চা। তার পর যৎসামান্য প্রসাদ মুখে দিয়ে, রেওয়াজ...বাঁধতেন তানপুরা। শুরু হতো দৈনন্দিন সারস্বত সাধনা৷ 

এই তাঁর ধরাবাঁধা রুটিন, গত চল্লিশ বছরের। মায়ের দেওয়া তালিম। দীর্ঘদিনের অভ্যাস। এত সহজে তা যায় না। কিন্তু বয়স হচ্ছে বুয়ার। বৃদ্ধ হচ্ছেন যে, তা তিনি বোঝেন। আজকাল একটুতেই যেন হাঁপ ধরে। যদিও তানপুরা নিয়ে রেওয়াজে বসলে মনেই হয় না কোনও অসুখ আছে তাঁর। 
 
 
২৮ নভেম্বর, সন ১৮৭১ (মতান্তরে ১৮৫৮ সাল)। বম্বে প্রেসিডেন্সির (অধুনা মহারাষ্ট্র) সিন্ধুদুর্গের ভজারে গ্রামে জন্ম হয় বুয়ার। পুরো নাম রামকৃষ্ণবুয়া ভাজে। খুবই অল্প বয়সে হারিয়েছেন বাবা নরহরি ভাজে'কে। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের হাত ধরে পাড়ি দেন কোলহাপুর। অপরিচিত সে জায়গা, অপরিচিত সব মানুষজনের সাথে পরিচিত দারিদ্র্য। 

বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাজ করতেন বুয়ার মা। শুরু হয়ে ছিল গ্রাসাচ্ছদনের জন্য নাছোড়বান্দা, অভাবনীয় লড়াই। দিন রাত হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে মজুরি নিয়ে মা বাড়ি ফিরলে, চড়তো হাঁড়ি। খেতে বসার আগে মা গান গাইতেন, প্রার্থনা সংগীত। তাঁর সঙ্গে গলা মেলাতেন ছোট্ট বুয়া। সেই স্বল্প উপার্জনেই চলতো পড়াশোনা, মা ছেলের একলা-দোকলা সংসার। 

মায়ের কাছেই গানের প্রথম পাঠ বুয়ার। মা-কে দেখে অবাক হতেন তিনি। মা-র প্রতিটি কাজকর্মে অদ্ভুত ভাবে জড়িয়ে ছিল গান। সুললিত কণ্ঠের অধিকারিনী তিনি। গগনচুম্বী দারিদ্রের সেই সংসারে গান-ই ছিল একমাত্র আশ্রয়। মায়ের কোলে বসে বসেই একের পর এক গান তুলতেন বুয়া৷ সংগীতের মূর্চ্ছনায় ভেসে কেটে যেত সময়। চলছিল প্রাথমিক বিদ্যাভাসের চর্চাও। এভাবেই দেখতে দেখতে ক্লাস ফোর-এ উঠলেন বুয়া। এর মধ্যেই ১২ বছর বয়সে বুয়ার বিয়ে দেন তাঁর মা। কিন্তু নাবালকের সংসারে মন নেই। যত টান সবই যেন সংগীতের প্রতি।

একটু বড় হতেই মা তাঁকে তুলে দেন বিখ্যাত  মারাঠি সংগীতশিল্পী বলওয়ান্ত রাও ফড়ের হাতে। এইবার শাস্ত্রবিধি মেনে সংগীত শিক্ষা শুরু হয় তাঁর। কিছু কাল পর, মালভন যান তিনি, বিঠোভা আন্না হরপের কাছে নেন তালিম। একসময় প্রাথমিক তালিম শেষ করে হাজির হন ইন্দোরে। সেখানে তিনি বিখ্যাত তাল বাদ্যে শাস্ত্রজ্ঞ নানাসাহেব ফনসের কাছে গাঁট বাঁধেন। বুয়ার অসামান্য সংগীত প্রতিভা দেখে নানা সাহেব তাঁকে সরাসরি গোয়ালিয়র পাঠান। প্রাচীন গোয়ালিয়র ঘরানার কিংবদন্তি শিল্পী উস্তাদ বড়ে নিসার হুসেইনের (নথথু খাঁ-র ছেলে) কাছে গাণ্ডা বাঁধেন রামকৃষ্ণবুয়া। 

বড়ে নিসার হুসেইন সন্তান স্নেহে দেখতেন তাঁকে। তিনি বুঝেছিলেন অসীম প্রতিভাধর এই মারাঠি ছেলেটি। একাধারে পুত্রস্নেহে ভরিয়ে রাখতেন, অন্য দিকে ছিলেন অত্যন্ত কড়া ধাতের শিক্ষক। গোয়ালিয়রে থাকাকালীন ফকিরি জীবনে নিজেকে ঢেলে নিয়েছিলেন বুয়া৷ গুরুসেবা করে যা পেতেন, তা-ই খেয়ে বাঁচতেন। সাথে চলত নিরলস সংগীত সাধনা। ক্রমশই ভয়াবহ কৃচ্ছসাধনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। অচিরেই ছড়ায় তাঁর গানের খ্যাতি। বিখ্যাত সংগীত শাস্ত্রবিদ বি আর দেওধরের মতে, এই সময়েই তৈরি হয় তাঁর নিজস্ব 'ভাজে গায়কী'। ধ্রুপদ, ধামার, খেয়ালে বুয়া হয়ে ওঠেন অজেয়। এর পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। কণ্ঠসংগীতের পাশাপাশি বেহালা এবং সেতারেও হয়ে উঠেছিলেন সিদ্ধহস্ত।

বুয়ার খ্যাতি তখন সপ্তমে। গুরুর আশীর্বাদে তাঁর তখন বেশ নামডাক। গোয়ালিয়র, কোলহাপুর, নাগপুর, সৌরাষ্ট্র, বিদর্ভে ক্রমশ ছড়িয়েছে তাঁর নাম। গুরুআজ্ঞা পালন করে নিয়েছেন তাঁর শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার ভার। ভাজের সাংগীতিক গুণপনা নিয়ে চর্চা তখন মধ্যগগনে। তাঁর লয়কারি, শুদ্ধস্বরের প্রয়োগ, তানকর্তব নিয়ে বাড়ছে বিস্ময়। বিশেষ করে বিলম্বিত খেয়ালে সংক্ষিপ্ত আলাপে গমকের ব্যবহারে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। তাঁর সংগীত পরিবেশন মানেই বিরল কিছু রাগ - গৌড় সারং, গৌড়গিরি, গৌরকল্যাণ, খট, ভাটিয়ার ও নট বিলাবলের অধুনালুপ্ত বন্দিশের উঁকিঝুঁকি। বি আর দেওধর জানাচ্ছেন, ততদিনে মধ্য ও পশ্চিম ভারতে প্রভূত জনপ্রিয়তা ও স্বীকৃতি পেয়েছে তাঁর গায়কী, লোকে বলত - 'ভাজে কী গায়কী'। ১৯৩৩ সালে বেরলো প্রথম ৭৮ আরপিএম রেকর্ড, যা জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায় তাঁকে।

পাশাপাশি মারাঠি নাট্যসংগীতেও বুয়া রেখেছেন সমান ছাপ৷ ১৯২০-৩১ সাল টানা ১১ বছর তিনি 'ললিত কলা আদর্শ সংগীত নাট্যমণ্ডলী' ও 'বলবন্ত সংগীত নাট্যমণ্ডলী' দুটি বিখ্যাত নাট্যদলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। মারাঠি নাট্যসভা ও সংগীতে এক নয়া দিগদর্শন খুলে দেন বুয়া। বেশ কিছু শাগির্দও জোটে তাঁর। সুযোগ্য শিষ্যদের মধ্যে বুয়ার পুত্র শিবরামবুয়া ভাজে, কেশবরাও ভোঁসলে, বাপুরাও পেনধরকড়, গুরুরাও দেশপাণ্ডে, বিণায়করাও পটবর্ধন ও মাস্টার দীনানাথ মঙ্গেশকর (লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলের বাবা) ছিলেন অন্যতম। শুধু সংগীতচর্চা নয়, পঠনপাঠনেও ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন তিনি। স্কুলের গণ্ডি না পেরনো বুয়া মারাঠি পত্রিকা 'দৈনিক বসুন্ধরা'তে ভারতীয় মার্গসংগীত নিয়েও লিখেছেন 'কলাম'। বুয়ার সংগীতজীবনের সফরের বহু অজানা তথ্য তুলে ধরেছেন তাঁর আত্মজীবনী - 'সংগীত কলাপ্রকাশ' (দুই খণ্ডে) এ। 

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সেই প্রবাদপুরুষ, গোয়ালিয়র ঘরানার দিকপাল ব্যক্তিত্ব রামকৃষ্ণবুয়া ভাজে স্থানুবৎ বসে আছেন খাটে। যেন নড়াচড়ার শক্তিটুকু হারিয়েছেন তিনি। সুরের অতীন্দ্রিয় মায়াজাল এমনই আচ্ছন্ন করেছে তাঁকে। আহীর ভৈঁরো যে তাঁরও খুব পছন্দের রাগ। উস্তাদ নিসার হুসেইন অনেক যত্নে শিখিয়েছিলেন বুয়াকে৷ কিন্তু মন্দ্রসপ্তকে এমন আলাপ, সুরের নিখুঁত বিন্যাস, তানসেনি ধ্রুপদাঙ্গের এমন অপার্থিব কারুকার্য - আগে কখনও শোনেননি বুয়া। ধীরে ধীরে উঠে বসেন তিনি, বেরিয়ে আসেন ঘর ছেড়ে। সুরেলা তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে এসে দাঁড়ান আশ্রমের মাঝ-বরাবর, ছাদের ধারের ঘরটিতে৷ এখান থেকেই ভেসে আসছে সুর। ভাজে দেখেন, মুণ্ডিতমস্তক, গেরুয়াবসনধারী এক সন্ন্যাসী পেল্লায় মিরাজের তানপুরা হাতে ধ্যানস্থ৷ তাঁর একহাত তানপুরায় গায়ে খেলে বেড়াচ্ছে, অন্যহাত'টি শূন্যে, চোখ বন্ধ, শুধু ঠোঁটটুকু কাঁপছে, আর তাঁরা সারা অঙ্গ, সারা ঘর থেকে যেন ঠিকড়ে বেরোচ্ছে অভাবনীয় দ্যুতি। বিস্ময়ে বুয়ার মুখে কথা সরে না। চোখ দিয়ে কখন বেরিয়ে এসেছে জল, খেয়ালও নেই। হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকেন ঘরের বাইরে।
 
 
কতক্ষন এভাবে দাঁড়িয়েছিলেন খেয়াল নেই বুয়ার। সন্ন্যাসীর ডাকে ঘোর কাটে। "সুপ্রভাত, উঠে পড়েছেন দেখছি!" বুয়া চোখমেলে দেখেন হাসিমুখে তাঁরই দিকে তাকিয়ে রয়েছেন সেই সন্ন্যাসী৷ হাতছানি দিয়ে ডাকেন - "বাইরে কেন? ভিতরে আসুন!" বয়সের বিচারে সন্ন্যাসী তাঁর চেয়ে বছর সাত-আটেকের বড়। কিন্তু সারামুখে তাঁর কী অদ্ভুত শান্তির আলো, কী অদ্ভুত তরুণকান্তিময়, দীপ্ত চেহারা। মন্ত্রবৎ ঘরে প্রবেশ করেন বুয়া। বসেন চারপায়ার এককোনে। অস্ফুটে বলেন, "মহারাজ, এ কী শোনালেন আপনি?" পণ্ডিত রামকৃষ্ণ বুয়ার বিহ্বলতা চোখ এড়ায়না সন্ন্যাসীর। হো হো করে হেসে ওঠেন তিনি, বলেন - "আরে, ও কিছু না৷ এ আমার নিত্যদিনের কাজ। বাবুদের (আবাসিক) ঘুম ভাঙানোর ফন্দি। নয়তো কেউ খাটিয়ে ছাড়ে না। গান গেয়েই তাঁদের ঘুম ভাঙাতে হয়।" 

বুয়া করজোড়ে বলেন, "স্বামীজি, এতদিন গান গেয়েছি, রাগ-রাগিনী নিয়ে ঘর করেছি, কিন্তু ভৈরবের এমন রূপ, এমন আলাপ আগে কখনও দেখিনি, শুনিনি। আমার এখানে আসা সার্থক হল।" সন্ন্যাসী এগিয়ে এসে তাঁর হাত ধরেন - "আমি যে জানি আপনাকে। ভারতবিখ্যাত গায়ক আপনি। আপনিও তো পরমসাধক। সংগীতসাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরন্বেষণের পথ খুঁজে নিচ্ছেন। পরমব্রহ্মে নিহিত যে সুরালোক, তা খুঁজে বেড়াচ্ছি আমিও। আমরা দু'জনেই সন্ধানী, আমাদের কোনও ফারাক নেই যে।" অবাক হয়ে সে কথা শোনেন বুয়া। সন্ন্যাসী মজা করে বলেন, "আপনি তো মশাই আমার প্রণম্য৷ আমার গুরুর নামেই যে আপনার নাম। গুরু প্রণাম করলে পাপ হবে যে।" হাসিতে ফেটে পড়েন সন্ন্যাসী। আবেগে আপ্লুত, আনন্দাশ্রুতে ভেসে, স্বামীজির দুটি হাত বুকে টেনে নেন, মাথা ঠেকান বুয়া। প্রণাম জানান অন্তরের সর্বস্ব উজার করে।

সময় থমকে দাঁড়ায় সেই অপার্থিব সন্ধিক্ষণে...


______
তথ্যসূত্র: 


১. সংগীত কলাপ্রকাশ, রামকৃষ্ণবুয়া ভাজে, পুণা, ১৯৩৮
২. রামকৃষ্ণ বুয়া ভাজে, ভি আর আটওয়ালে, মারাঠি বিশ্বকোষ (সূত্র. সাহাপিডিয়া.কম)
৩. দ্য কুইন্ট, কামাথ পটপিউরি, দ্য স্ক্রোল
৪. সংগীতকল্পতরু, নরেন্দ্রনাথ দত্ত ও বৈষ্ণব চরণ বসাক, প্রাসঙ্গিক তথ্য ও আলোচনা - ড. সর্বানন্দ চৌধুরী, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার, কলকাতা
৫. টু মেন এণ্ড মিউজিক, জানকি বাখলে, ২০০৫
৬. পিলার্স অফ হিন্দুস্তানি মিউজিক, বি আর দেওধর, পৃষ্ঠা. ১২৮-১৩০

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন