আধেকজান
(পর্ব ৭)
-স্যার, এ চেকটা... ।
আধখানা এ কথাই বাস্তবে ফেরায় উদ্দালককে। সে চেকটা পাস করে দেয়। তাদের এ ব্রাঞ্চটা নতুন, তাই ছোটোও। ম্যানেজারের পর সেই-ই একমাত্র অফিসার। অ্যাকাউন্ট খোলা, ফিক্সড ডিপোজিট, রেকারিং, লোন—এ সব কাজ তারই। কিন্তু বর্তমানে করোনা হু-হু করে বাড়তে থাকায় তাদের হেড অফিসের নির্দেশে ব্যাঙ্কে শুধু টাকা তোলা-জমা ছাড়া অন্য সব কাজ বন্ধ আপাতত। তাই তার কাজের তেমন চাপ নেই এখন। এ বছরে দুই মাসের মধ্যেই ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে প্রবল বিক্রমে সারা দেশ জুড়ে। এবং গত বছরের অপেক্ষা দশগুণ বেশি বেগে যেন। দিল্লি, মহারাষ্ট্র, গুজরাত,
গেটে একটা গণ্ডগোলের আভাসে উদ্দালকের ভাবনা আবারও চিড় খায়। একটা লোক ফিক্সড ভাঙাবে। তাই ঢুকতে চায়। কিন্তু সিকিউরিটি দীপক বাইরে ঝোলানো নোটিশ দেখিয়ে তাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। লোকটাও নাছোড়।
-আমার টাকা আমি ভাঙাবো। তাতে ব্যাঙ্কের কী? আমার টাকার দরকার খুব। ও সব আইন-ফাইন আমি জানি না।
লোকটাকে দেখে দিন আনি-দিন খাওয়া বলেই মনে হয় উদ্দালকের। মায়া হয় তার। সে আওয়াজ দেয় দীপককে, লোকটাকে ঢুকতে দিতে বলে। মানুষটা ঢুকলে সে তাকে দূর থেকেই কথা বলতে বলে ইশারায়। যদিও সে মানুষটার মুখ মুখোশে ঢাকাই। আর ঢোকার সময় সেফটির খাতিরে সিকিউরিটি দীপক তার হাতে স্যানিটাইজও স্প্রে করে দিয়েছে নিয়মমাফিক। উদ্দালক দূর থেকেই কথা ভাসায়।
-দেখুন, করোনার জন্য শুধু টাকা জমা-তোলা ছাড়া আর সব কাজ তো বন্ধ। তা, আপনার কী দরকার বলুন।
-আমার এই ফিক্সডটা ভাঙাতে চাই। আগাম। খুব দরকার স্যার।
-প্রিম্যাচুয়র ভাঙাবেন? তাতে তো সুদ কম পাবেন। কেন? খুব দরকার?
-হ্যাঁ, স্যার। বাবার খুব শরীর খারাপ। টাকাটা দরকার খুবই। করোনা স্যার। অনেক দৌড়ঝাঁপ করে কালকে হাসপাতালে ভর্তি করতে পেরেছি।
করোনা—এ শব্দ এমনই ভয়ংকর ও ছোঁয়াচে যে ব্যাঙ্কের সকল স্টাফ যে যার জায়গাতেই সিঁটিয়ে যায়। ভেতরের দু-জন কাস্টমারও ছিটকে দূরে সাড়ে যায়। উদ্দালকের ভয়ের চেয়ে সংকোচ বেশি হয় যেন। ও ডেকে ঢোকাল মানুষটাকে। অন্যরা কে কী ভাববে? যা হোক, গতস্য শোচনা নাস্তি। নিরুপায় সে অগত্যা ইশারায় তাকে কাস্টমারদের টেবিল দেখায়।
-শুনুন, ওই টেবিলে গিয়ে লিখুন—due to
-স্যার, আমি ইংরেজি লিখতে পারি না। উদ্দালককে থামিয়ে দেয় সে কাস্টমার।
-সই করতে পারেন? নাকি টিপছাপ? নরম উচ্চারণেই জিজ্ঞাসা করে উদ্দালক।
-না, না, সই করতে পারি আমি। উদ্দালকের নরম স্বরে ভরসা পায় যেন সে।
-তাহলে ফিক্সড সার্টিফিকেটের উল্টোদিকে সই করে নিচে সেভিংস অ্যাকাউন্ট নাম্বারটা লিখে দিন। পাসবই এনেছেন তো?
-হ্যাঁ, স্যার। নিয়ে এসেছি।
-তাহলে থাক শুধু সই করে পাসবইয়ের সঙ্গে ফিক্সডটা আমাকে দিয়ে যান।
উদ্দালকের টেবিলের সামনে স্বচ্ছ আড়াল খাড়া করোনা-কথিত সামাজিক ছোঁয়াচ এড়াতে। মানুষটি সে দূরত্বে সংকোচে দাঁড়ায়। উদ্দালক তাকে বসতে বলে ইশারায়। হাত বাড়িয়ে ফিক্সডের কাগজ ও পাসবইখানা নেয়। পঞ্চাশ হাজার টাকার ফিক্সড, পাঁচ বছর মেয়াদীর। এখনো দেড় বছরের মেয়াদ বাকি। তাই আশ্বাসের সুর আঁকে।
-বাহ! ঠিক আছে। একবার আপনার সইটা মিলিয়ে দেখব একটু। তা, আপনি লোনও নিতে পারেন কিন্তু—ছত্রিশ হাজার পাবেন। মাসে মাসে শোধ দিতে পারেন। তাতে আপনার লাভ।
-না, স্যার। পুরোটাই ভাঙাবো। শোধ দিতে পারব না আর। সংসারেও লাগবে...
-কী করেন আপনি?
-অটো চালাই স্যার। গত লকডাউনে ছ-মাস বসে ছিলাম। এখনো তেমন প্যাসেঞ্জার নেই...
কম্পিউটারে দ্রুত আঙুল চালানোর ফাঁকে উদ্দালক এক ঝলক মুখ তুলে তাকায়। দীর্ঘশ্বাস চেপে বলে, --আপনার মেসেজ অ্যালার্ট, মানে ব্যাঙ্ক থেকে আপনার ফোনে মেসেজ যায় তো?
-হ্যাঁ, স্যার।
কাজ শেষ করে কম্পিউটার থেকে চোখ তোলে উদ্দালক। উল্টোদিকের মানুষটির দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। সে দৃষ্টিতে মায়া আঁকা।
-সব ঠিক আছে। আজ বিকেলে আশা করি মেসেজ পেয়ে যাবেন। পাসবইটা থাকল। কাল টাকা তুলতে পারবেন। তখন পাসবইটা আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন।
আশ্বস্ত মানুষটি উঠে দাঁড়ায়। নমস্কার করে। মুখে তার কৃতজ্ঞতার আলো যেন। সে আলো সংক্রমিত হয় উদ্দালকের মনে। পরিতৃপ্ত তার চোখ টেনে নেয় দেওয়ালে টাঙানো জাতির পিতার বাণী—খদ্দেরই মহামূল্য সম্পদ। মহাত্মা গান্ধী কি আজও জাতির পিতা? তাহলে বলতে হয় তিনি অসফল জনক। ভাবনারা আবারও শেকড় চারায় উদ্দালকের চেতনে। গান্ধী তো নোটবন্দি ছবি শুধু আজ! তবুও নেহাতই গান্ধী নামের ওজন, নইলে বর্তমান রামাবতার রাজর্ষি কবেই নিজের ছবি প্রতিটা কারেন্সি নোটে খোদাই করে দিতেন। ওই তো গুজরাটি অস্মিতাকে ধোঁয়া দিতে প্যাটেলের বিশাল-বেঢপ মূর্তি বানিয়ে প্যাটেলেরই নামাঙ্কিত স্টেডিয়াম নিজের হাতে নিজের নামে দাগিয়ে দিলেন! উদ্দালক এই সেদিনই একটা মাগাজিনে পড়েছে হিটলার-মুসোলিনিও নাকি নিজেদের জীবদ্দশাতেই নিজেদের নামে স্টেডিয়াম বানিয়েছিল! ওর কেমন যেন মনে হয় আজকাল, সব তন্ত্রের সার বোধহয় একনায়কতন্ত্র!
একনায়কতন্ত্র আর নোটবন্দি—শব্দদুটিতে উদ্দালকের মনে পাঁচ বছর আগের কালোস্মৃতি জেগে ওঠে। ৮ই নভেম্বর, ২০১৬। রাত্রি আটটা। প্রধানমন্ত্রীর শ্রীমুখের হঠাত্ বাণী সারা দেশকে রাতারাতি লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। কী না, ‘কালাধন’ উদ্ধার! ব্যাঙ্কের কর্মী সে জানে-- একটাও কালোটাকা তো উদ্ধার হলই না, বরং দেশের খুঁড়িয়ে অর্থনীতি মাজা ভেঙে শুয়ে পড়ল একটা কালাবাণীতে। আর সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল না। করোনা- লকডাউনে এখন তো কোমায়! আদৌ জ্ঞান ফিরবে কিনা কে জানে? না, অতিধনী এক শতাংশ, বা তার মতো সুবিধাভোগী তিরিশ শতাংশ ভারতবাসীর একটা লোমও খসে পড়েনি। মরেছে, মরছে বাকি ভারত, ঘাম-মাটির ভারতাত্মা।
-কী গো? পরশু আসছো তো?
উদ্দালক জেগে ওঠে বোসদা-র ছুঁড়ে দেওয়া এ তিরে। এ সময় ব্যাঙ্ক একটু ফাঁকা। কাস্টমার নেই। এমনিতেই মাসের প্রথমেই যেটুকু ভিড়। করোনার জন্য মানুষ মাসে একবারেই কাজ সেরে নেওয়ার চেষ্টা করে। টাকা তোলার বেশির ভাগটাই তো এটিএম মারফত। আর সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া মানুষের হাতে টাকাও তো নেই। তাই ব্যবসাদারদেরও টাকা ব্যাঙ্কের ঘরে তেমন ভিড় জমায় না। ব্যাঙ্কে বসে অর্থনীতির নাড়ি অনেকটাই বোঝা যায়। ভাবনার ফাঁকে বোসদা-র তির বর্শা দিয়ে কাটে সে।
-তা আপনি যদি ইনকিলাব জিন্দাবাদ নাড়া লাগান, তাহলে আসব আমি আপনাকে সঙ্গ দিতে। ভিড় বাড়াতে।
-বোসদা, লোক লাগলে বলবেন। ভাড়া খাটার জন্য এখন প্রচুর বেকার। কাউন্টার থেকে আওয়াজ ভেসে আসে।
-না হে, না। এখন ভোটমচ্ছব। সব বেকার ন্যাতার ছাতার তলায়। বোসদা ভাঙবেন তবু মচকাবেন না।
আসলে পরশু ব্যাঙ্ক ধর্মঘট। সরকারি ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে। বাজেটে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে লোকসানে চলা দু-একটা ব্যাঙ্ক নাকি বিক্রি করে দেবে কেন্দ্র সরকার। করোনার ডামাডোলে সামনের সংসদ অধিবেশনে বিল পাসও করিয়ে নিতেও পারে এ সরকার। গতবছর যেমন করোনাকালে কৃষিবিল, শ্রমবিল পাস করিয়ে নিয়েছিল। কৃষকরা এক বছর ধরে দিল্লির সীমানায়, রাস্তায়। রাজর্ষির কোনও হেলদোল নেই! ভাবখানা যেন-- আমি রাজা, আমি যখন বলছি ভালো, তখন সর্বনাশ হলেও জনগণকে তা ভালো বলে মানতে হবে। এমন গরিববিরোধী সরকার ভারতে আগে আসে নি।
উদ্দালক নিজের অজানতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। যা আবার তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার-তাদের চাপা আশঙ্কার অতল আঁধারে। কে জানে তাদের ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের সে আওতায় কিনা! অবশ্য একটা আশার আলো ক্ষীণ হলেও জ্বলে, যদিও তা দুরাশা সঞ্জাতই। সবে গত বছরে তাদের ব্যাঙ্কের সঙ্গে আরও দুটো ব্যাঙ্ক মার্জ করেছে। তাই তাদের ব্যাঙ্ক শিগগির প্রাইভেটাইজেসন হবে না বলেই তাদের আশা। তবুও এ যা তুঘলকি সরকার, না আঁচালে বিশ্বাস নেই। এই তো এ অঞ্চলেই আধ কিলোমিটারের মধ্যেই দুটো ব্যাঙ্ক মার্জ করাতে তাদের টি-তিনটে ব্রাঞ্চ! সব ব্রাঞ্চ রাখবে? কত স্টাফ নতুন করে ছাঁটাই হবে! নীরবআদি মোদী-আদানি-আম্বানিরা হাজার হাজার কোটি টাকা লোন নিয়ে, শোধ না দিয়ে ব্যাঙ্কগুলোকে ছিবড়ে করে দিল। আর ‘ছপ্পন’ ছাতির সরকার নীরবে চোখ বুজে ঘুম দিল। সরকারের সাহসই নেই সেই সব ঋণখেলাপী শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার। শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা! সরকারই পড়ে যাবে। বিরোধীরাও তেমনই। সব শিয়ালের এক রা। বিরোধী থাকাকালীন খুব হৈ চৈ, গদিতে বসলেই চুপ। চোর পুঁজির হাতের পুতুল সব কটা পার্টিই। পুঁজির উচ্ছিষ্টভোগী। আর তাদের ইউনিয়নও পার্টিগুলোর পোঁ-ধরা। বিপ্লবী সব! বুকের পাটা থাকে তো ঋণখেলাপী ডাকাতদের নাম প্রকাশ করুক! বলুক ওদের পণ্য বয়কট করতে! ধর্মঘট তো ইউনিয়ণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য লোকদেখানো নাটক কেবল! আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। তবে এবার সচেতনে, কেননা সে গরম হাওয়ার অভিঘাত তার মুখে বাঁকা হাসি আঁকে। তার মনে পড়ে যায় তার এক মজারু বন্ধুর কথা—বন্যেরা বনে সুন্দর, রাজনীতিকরা বিরোধী হলে! সেই ছোট থেকে টাটা-বিড়লার হাত ভাঙতে ভাঙতে নিজেদের হাতই ভেঙে নুলো হয়ে গেল! ওদিকে আদানি-আম্বানি কত যে নিত্য নতুন হাত...