দোঁহা

চৈতালীর কবীর

 


সব্যসাচী মজুমদার

১.

কবীর তো কখন‌ই কোন‌ও ছকবন্দী ভাষায় কথা বলেননি। বলেছেন মানুষের ভাষায়।স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বতঃপ্রসারী লব্জে রহস্য নির্মাণ করেছেন, চাবিও ছড়িয়ে রেখেছেন সে ভাষার শব্দে শব্দে।সে ভাষার এমন‌ই আততি, এমনিই স্বভাব সারল্য যে সহজেই নিজের মতো করে নেওয়া যায়।সোজা কথায়, তৎকালীন প্রাতিষ্ঠানিক ভাষাকে অগ্রাহ্য করে গড়ে তুললেন এমন একটি সাংকেতিক ভাষা যা কেবল অধিকারী‌র পক্ষেই ভেদ করা সক্ষম,তা ব্যাতীত এ কথা তো বলা যায়‌ই , সমস্ত বিরোধী ধর্মের স্বভাব অনুসারে নির্মাণ করলেন কোড ল্যাঙ্গুয়েজ।অবশ্য প্রাক্-কথনে চৈতালী চট্টোপাধ্যায় , 'সন্ধ্যা ভাষা 'বলে চিহ্নিত করে লিখছেন,

"কবীরের কবিতা আগাগোড়া সন্ধ্যাভাষায় মুড়ে দেয়া।এই টেক্সট মূলতঃ গান গানেই মানুষের সঙ্গে সেতু বাঁধা তাঁর।"

'চৈতালীর কবীর '-এর প্রাক্ -কথনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আমাদের সাব অলটার্ন স্টাডিজের একটা তর্ক উসকে দিতে পারে,

"কবীর বেনারসে থাকতেন।যে পবিত্র জায়গায় মরণকালে থাকতে পারলে মৃত্যুর পর স্বর্গবাস হয়, মানুষ এমনটাই বিশ্বাস করে। কবীর কিন্তু শেষজীবনে বেনারস ছেড়ে চলে গেলেন মগহর নামক শহরটিতে। অপরিচ্ছন্ন, নীচু জাতের মানুষে ভরতি লোকালয়। জনশ্রুতি, সেখানে মারা গেলে পরজন্মে গাধা হতে হয়!এমন স্হানটিই বেছে নিলেন সন্ত কবীর ‌। কেন? তিনি বললেন,পুণ্যের ঘড়া পূর্ণ হ‌ওয়ার জন্য যেখানে খুশি মরলেই হল। শুধু,অন্তরে ভক্তিটুকু অটুট থাকুক!"

যদি চর্যাপদের সঙ্গে,এই সূত্র ধরে একটা তুলনামূলক আলোচনা নির্মাণ করা যায়,দেখা যাচ্ছে, চর্যা অবশ্য‌ই সাব অলটার্ন বিষয়কে ধারণ করেছে, কিন্তু কবিরাও কী সাব অলটার্ন ছিলেন! বোধহয় নয়।প্রত্যেকেই আলোকিত বৃত্তের শিক্ষিত মানুষ। কিন্তু, কবীর জন্ম সূত্রেই সাব অলটার্ন। উচ্চ বর্ণের মাতৃ পরিত্যক্ত, মুসলমান তন্তুবায়ের সন্তান হিসেবে বড় হয়েছেন। সঙস্কৃতের আবদ্ধ পরিবেশ থেকে বের হয়ে এসে মাতৃভাষার স্বতঃস্ফুর্ত প্রবাহে স্নান রেখেছেন। নিজের জীবনকে, রচনাকে নিম্নবর্গের অভিমুখী করে তুলেছিলেন যুগপৎ।এখন স্বভাবতঃই প্রশ্ন তৈরি হয়, কিন্তু চর্যা একটি নির্দিষ্ট যুগপর্বের ইতিহাসকে চিহ্নিত করে, কবীরের সুফিয়ানায় কতটা ইতিহাসের উপস্হিতি?সেক্ষেত্রে এই আলোচক, কিন্তু,'চৈতালীর কবীর '-এর কিছু উদাহরণ তুলে ধরতে পছন্দ করবে,
"মসৃণ রাজপথে,
 সর্বস্ব খোয়ায় কেউ
 ডাকাতের হাতে ।"(পৃঃ ১১)

কিংবা,

"চালাক চতুর লোকে
 ছেয়ে গেছে শহরবাজার।"(পৃঃ ১৮)

কিংবা

"বাজারে এনেছে রাম। দাসের বাজার।
 ক্রেতা ,বিক্রেতা সে একা।"(পৃঃ ৫৯)

ষোড়শ শতকের ভারতীয় ইতিহাসের এক একটা চিহ্ন কী ঘুরে ফিরে সরে যেতে থাকে না!

চর্যা অবশ্যই নিম্নবর্গের ইতিহাসকে ধারণ করেছে, কিন্তু,যে অর্থে কবীর,সর্বাংশে পেরেছেন,চর্যা পেরেছিল কী?

চৈতালী চট্টোপাধ্যায় অনুবাদ করেননি। বরং সংশয়ে থেকেছেন,

"অজ্ঞানের অন্ধকারে ডুবে - থাকা আমি এইসব অনুবাদের অধিকারী কি?"(প্রাককথন)

তিনি ভারতের ঘর বন্দী পর্বে অনুভব করার চেষ্টা করেছেন কবিতা। কবীরের সেইসব কবিতাকে নিজের ভাষায় পৌঁছে দিয়েছেন পাঠকের কাছে। মূলত গদ্য ভঙ্গিতে, অনিয়মিত প্রত্যক্ষ ছন্দের মৃদু উপস্হাপনে আর স্বভাব অন্ত্যানুপ্রাসে পদগুলোকে নিয়ে এসেছেন একদম বাঙালি নিম্নবর্গের প্রহেলিকায়,

"কবীর রামের দাস।
 রাতকেই জানে,অন্য
 কাউকে জানে না।

 কাজল পরলে চোখে,
 ক-জন দেখতে পায় ভালো!
 সে প্রেমিকা দেখে সব,
 যার চোখে মোহনের আলো ‌।"(১)

সাজিয়ে গুছিয়ে কবীরকে সঙস্কৃত করে তোলার প্রয়াস যেমন লুপ্ত এ কাব্যে,তেমন‌ই কিন্তু, কবীরের বৈষ্ণব সামীপ্যকে অটুট রেখেছেন চৈতালী চট্টোপাধ্যায়।বৈষ্ণব সাধক নিজেকে গোপী রূপে,রাধা ভাবে বারংবার ভজনা করেছেন নিঃসীম কালোর।মঞ্জরী ভাবে নিবেদন করেছেন নিজেকে।'চৈতালীর কবীর '-এর ছড়িয়ে রয়েছে কবীরের মঞ্জরীভাব,

"আমার পতির নাম হরি
 আমি তাঁর তরুণী ভার্যা।
 স্বামীর নাম রাম।
 বেশি নয়,লম্বা আমার চেয়ে একটুখানি।

 সেজেগুজে বসে আছি,
 মিলনপিয়াসি।
 ত্রিভুবনেশ্বর তিনি,
 তবু আমি খুঁজে পাই না।"(১৯)
গৌড় বঙ্গের অন্যতম কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায় হয়তো এভাবেই অনুভব করেছেন কবীরকে তাঁরই ছলে ও ছলনায়,

"এসো জ্ঞানী,বলো দেখি,
 কীভাবে আমার
 নারীতে রূপান্তর ঘটে গেল!

 বিবাহ করিনি।
 গর্ভ ধরিনি
 তবু জন্ম দিলাম।"(৫১)

কুহক ও ভাষার পিচ্ছিল অর্থ আধিক্যের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে যে পদ গুলি,সংগত কারণেই তাদের আর একটি ভাষায় নির্ণয় করা দুরূহ এক প্রয়াস এই গ্রন্হটি।চৈতন্যোত্তর সময়ের কবীরের এই পদগুলিতে বৈষ্ণব সামীপ্যকে লক্ষ করা গেলেও,মনে রাখতে হবে,কখন‌ই তা সাধনার বৈষ্ণব ধারার সঙ্গে মিশে যায় না। সচেতনভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখে। উল্লিখিত পদগুলির চলনে যখন‌ই আপনার মনে হতে থাকে কবীর নিজেকেই নারী রূপে সংস্হাপন করেছেন,তখন‌ই কবীরকে সেই সত্তার  আরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন পদকর্তা। তিনি বলেন,

"এক‌ই ছাদের নীচে বসবাস,
 এক শয্যায়।
 দেখা হয় না!
 সে মেয়ে সৌভাগ্যতী ,বলছে কবীর,

 এই জন্মেই
 স্বামী সোহাগ পায় যে।"(১৯)

বরং এ স্বর অনেক বেশি স্বস্তি পায় লালনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে,

"সে আর লালন একখানে রয়
 তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে..."

তবু চোখে পড়ছে যেটি, বৈষ্ণব মহাজন কিংবা মহামতি লালন,দু',জনেই নিজেকে রূপকের উপমান হিসেবে নির্বাচন করেছেন। কিন্তু, কবীর নিজেকে সর্বজ্ঞের ভূমিকায় রেখে বলছেন,

"শোনো হে সন্তগণ,
 এই কথা, কবীর উবাচ।"(৫২)

অনুবাদকের কৃতিত্ব এখানেই, নিরপেক্ষভাবে, অনুবাদের সারল্যে কবীরের এই বোধিসত্তাকে অবিকল পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

পূর্বেই একথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে,কুহক ও ভাষার পিচ্ছিল অর্থবিস্তারের সঙ্গে দ্বিরালাপ চালিয়েছে এ কাব্যের দর্শন। এক্ষেত্রে একটি অনিবার্য উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা পারে এই পদটিকে,

"ধীরে সুস্থে চিবিয়ে খাচ্ছি।
 প্রথমে ঠাকুমা।
 পরে মা।
 তারপর জামাইবাবাজি।
 দেওর দুজন‌ও আছে।
 শ্বশুরমশাই, সঙ্গে।
 এভাবে একে - একে হোক।
 শেষপাতে মিষ্টির মতো
 শহরের বাকি সব লোক।"(৩২)

আত্মভুক সেপিয়েন্সের আদিম রিরংসার অবদমিত গর্জন শোনা যায় যেন।ক্যানিবলিজমের অস্বস্তি পাঠককে ঘিরে ধরতে থাকে। চৈতালী রূপক ব্যখার চেষ্টায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটিও বিশেষণ ব্যবহার করে পাঠকের দৃষ্টিকে রূপকার্থের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি। এ পদে কেবল একটি চাবিশব্দ তৈরি করেছেন পিনদ্ধতায় 'প্রিয়র'। এই শব্দটিই পাঠককে রূপকার্থের দিকে স্বাভাবিক পদচারণায় নিয়ে যায়।

এতদিন বাঙালি পাঠক অভিসারের আত্মনিগ্রহের চূড়ান্ত রূপ দেখেছে,

"কণ্টক গাড়ি     কমলসম পদতল
            মঞ্জীর চিরহী ঝাঁপি।"(গোবিন্দদাস) -তে। কিন্তু এ হেন সর্বগ্রাসী,আত্মভুক রূপকাকারের সঙ্গে পাঠক পরিচিত ছিল না। কিন্তু,ঐ 'প্রিয়' শব্দখানি পাঠককে মুহূর্তে নিয়ে যায় অভিসারিকার রিপু মুক্তির বাসনায়। ষড়রিপুকে নাশ করে কিংবা বশ করেই সাধকের বহু আকাঙ্খিত সেই মিলন পর্ব আসে।একটি শব্দের অভিঘাতে রূপকের এতটা নিস্তার ঘটানো নিঃসন্দেহে দুর্লভ অনুবাদকের চিহ্ন।

এই চিহ্নটি ছড়িয়ে থাকে অনুবাদকের শব্দশৈলীর আনাচেকানাচে।

২.

অনুবাদের একটা বড় অসুবিধা হলো,ভাষা দর্শনের।এ কারণেই অনেক সময় দেখা যায়, 'বিশুদ্ধ কবিতা ',যা কয়েকটি সাঙ্কেতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সূত্রের ওপর নির্ভর করে পাঠকের পরিশুদ্ধি ঘটায়,তার অনুবাদ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।কারণ অনুবাদক খুব ভাষা দক্ষতার পরেও ঐ ভাষা -দর্শনের সঙ্গে অন্য ভাষা -দর্শনে বিশ্বাসী পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রায় অপারগ হন।

যেমন 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে '-কে অনুবাদে প্রান্তিকের মৌলিক অধিকারের দাবি হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। একজন মায়ের সন্তানের কল্যাণ চিন্তার ছায়াও স্পষ্ট হতে পারে। কিন্তু, দুগ্ধ ও অন্নের সহাবস্থানে মাতৃদুগ্ধ ক্ষরণের আকুতির সঙ্গে কৃষি সভ্যতার যে দার্শনিক সম্পর্ক, লক্ষী দেবী কোজাগরে ধানের বুকে দুধ রেখে যান,ভাত আর দুধের এই অলীক সম্পর্কের কালোত্তীর্ণ রূপ তো অনুবাদে ধরা পড়ে না। কিন্তু, কবীরের অনুবাদ এ দিক থেকে কিছুটা নিরাপদ। কেননা, কবীর মূলত যে ভাষার শব্দগুলি ব্যবহার করেছেন, সেগুলি হলো, আওয়াধী -ব্রজভাষা ও ভোজপুরি। লক্ষ করা যায়,সবকটি ভাষার সঙ্গে বাংলার আঞ্চলিক সম্পর্ক যেমন রয়েছে, রয়েছে আদান -প্রদানের সম্পর্ক‌ও। তাছাড়া ভারত ভূমির সুবিধার জন্য, ভাষাগুলির দর্শন‌ও প্রায় একই রকম।আর‌ও একটি বিষয় এই প্রসঙ্গে মনে করা যায়, কবীর যে সময় তাঁর পদগুলি রচনা করছেন, সেই সময়েই বাংলায় বৈষ্ণব পদাবলীর ধারা সুপুষ্ট ও অব্যহত;এক‌ই লগ্নে জোরদার হচ্ছে বাউল -ফকির আন্দোলন। রোসাঙ রাজ দরবারে লেগেছে রোমান্সের ঢেউ।সব মিলিয়ে সর্বত্রই একটা মুক্তিকামী আবহাওয়ার অধিকার টের পাওয়া যাচ্ছিল।ফলত, কবীরের ভাষা দর্শনকে আত্মস্হ করা তাঁর‌ই 'উত্তর-সাধক'চৈতালীর পক্ষে বিশেষ অসম্ভব ছিল না।
এবং সেই দুরূহ কাজটি যে অনুবাদক নিপুণভাবে সেরেছেন,তার উদাহরণ এ গ্রন্হের ভাষা শৈলীর ওতোপ্রোত ।একটি নমুনা এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতেই পারে,

"পাণ্ডিত্য,
 প্রায়শ্চিত্ত,
 জপমালা হাতে নৃত্য,
 ওসব তোমার জন্য
 দেবতাপ্রাপ্তি কোন‌ও ঘটিয়ে দেবে না।(৫৩)

প্রথমতঃ 'জপমালা'শব্দটির ওপর লক্ষ রাখতে অনুরোধ করবো।দুই শব্দের বিশেষণ কিন্তু তার ও-কারান্ত উচ্চারণ বিশেষ দেখা যায় না বাংলা ভাষায়। মূলতঃ রুদ্ধ হয় দুই শব্দের বিশেষণ গুলির।পর পর দু'টি পংক্তিতে রুদ্ধ উচ্চারণের ঝংকার 'জপমালায় 'এসে স্তিমিত হয়ে গেল। রসিকের হৃদয়ে এই অবস্হার‌ই সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন সম্ভবতঃ কবীর। কেননা, শব্দগুলির নেতিবাচকতার ভূমিকা হিসেবে শব্দের ঝংকার কমানোর দরকার ছিল। অনুবাদক সেই দায়িত্বটি পালন করেছেন 'জপমালা'শব্দের অনিবার্য উপস্হাপনে। কিন্তু,এই আলোচকের দৃষ্টি অধিক আকর্ষণ করেছে, 'দেবতাপ্রাপ্তি কোন‌ও'-এর ব্যবহার। সাধারণত অনির্দেশক 'কোন‌ও' কর্তৃ বা কর্মের আগে বসে।নির্দেশক যেভাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এখানে শব্দটিকে ক্রিয়াবিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করলেন অনুবাদক।ফলে অর্থ হলো 'কোন‌ও প্রকার'।

দেবতাপ্রাপ্তি ঘটে। ঘটা সম্ভব। কিন্তু 'পাণ্ডিত্য'বা 'প্রায়শ্চিত্ত'অথবা 'জপমালা' কিছুই সে সাধনার প্রকার হতে পারে না। বরং তার বদলে অন্য পথ রয়েছে। এবং সেই সরণির উল্লেখ এরপরেই কবীর দিতে চলেছেন,

"শান্ত থাকো।
 পরস্ত্রী ও পরধনে
 লোভ দূরে রাখো"(৫৩)

ফলত রসিকের জন্য ঐ 'কোন‌ও'-এর ব্যবহারটি একটি কি-ওয়ার্ড হয়ে উঠে সমস্ত কৃতজ্ঞতা বর্ষিত হয় অনুবাদকের প্রতি।

৩.

আবার ফিরে যাব, চৈতালী চট্টোপাধ্যায় কৃত ভূমিকার কাছে।অনুবাদক লিখছেন,

"সংশয়,সন্দেহ নিয়ে কবীরের কবিতায় হাত দেওয়া ঠিক নয় বোধহয়। বারবার, বারবার পড়ছিলাম,সন্ধ্যাভাষার মোড়ক খুলে কিছু পেতে পারি কিনা,প্রার্থনা করেছিলাম অদৃশ্যের কাছে।আস্তে আস্তে সব কেমন সহজ হয়ে এল। আমার অবিশ্বাস নরম হয়ে এল, বিশ্বাসে বলব না, মুগ্ধতায়, কবিতায়।"

সংশয়, ধর্মীয় সন্ধ্যার ভাষা, বিশ্বাসের সমর্পণ ইত্যাদি বহুবিধ দরজা অতিক্রম করে অনুবাদক প্রকৃত‌ই পৌঁছতে চেয়েছিলেন কবীরের কবিতার কাছে।মত ও পথের বিবিধ বন্ধুর পেরিয়ে তিনি যথার্থই প্রবেশ করেছেন,সেই কবিতার বৈভবে।

 কবীর বিপ্লব নির্মাণ করেছেন। বিশ্বাসের অভিমুখের সঙ্গে সঙ্গে যাপনের প্রক্রিয়াকেও ভেঙে ফেলার এক রকমের এনার্কিই চালিয়েছেন। কিন্তু,এও মনে রাখা প্রয়োজন,এই এনার্কি আসলে শিল্পের এনার্কি। জীবন‌ও একটা শিল্প। আসলে মুক্তির এষণা তাঁকে বাউড়া করেছিল।আর সেই উন্মার্গের কথা বলতে গিয়ে কবীর তো বস্তুত‌ই সব ব্যতিরেকে কবিতাই লিখেছিলেন।

চৈতালী চট্টোপাধ্যায় কবি। বাংলা ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি। ফলতঃ তাঁর পক্ষে কবীর অনুবাদ বিশেষ সহজ হয়ে গিয়েছে,তার প্রধান তিনটি কারণ,

১.শিল্পের এনার্কি অনুবাদকের কবিধর্মের সঙ্গে সাযুজ্যমান।

২.কবীর আসলে তো গান লিখেছেন। এবং কথাগুলো নিঃসন্দেহে ও এক‌ই সঙ্গে লিরিক কবিতার‌ও উদাহরণ (এখানে গানের কথা আর লিরিক কবিতা উভয়কে উভয়ের প্রকৃত অর্থে ধরা হয়েছে); এবং চৈতালী চট্টোপাধ্যায় লিরিক্যাল কবিতার অন্যতম উত্তর সাধক।

৩.চৈতালী সন্ধ্যাভাষার অর্থ নির্ণয়ে ব্রতী না হয়ে, আসলে কবিতাকে পড়তে চেয়েছেন নিরপেক্ষ পাঠক হিসেবে।

অনুবাদের দুরূহ প্রতিবন্ধকতা সহজেই অপসৃত এই গ্রন্হের পদগুলিতে।সহজ ভাষা এবং তদুপরি সারল্য, সন্দেহাতীত সারল্য পদগুলিকে বাংলার নিজস্ব লব্জে পরিণত করে যেন,

"শরীর দিঘির মতো,
 আত্মা যেন বা রাজহাঁস" (৩৩)।

কিংবা,

"জেনো, রাজাধিরাজ
এক লহমায় সব মুছে যায় "(৪৪)-তখন‌ই এ পাঠকের স্মৃতিতে গুঞ্জায়,

"এ কথা জানিতে তুমি,ভারত ঈশ্বর হে শা জাহান,
কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধন মান "(শা জাহান)
ঠিক যে কাজটি কৃত্তিবাস অথবা কাশীরাম করেছিলেন,এই অনুবাদকের ভূমিকাও অনেকটা সেরকমই।

আসলে তো আদানপ্রদানটি ঘটে গেছে বহুসময় আগে। চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সে গমনাগমনের একটা নিরুপম উদাহরণ রাখলেন গ্রন্হে।অনুবাদ হিসেবে নয়,আবহমানের কবিতা হিসেবেই পাঠ করা যায় রচনাগুলিকে।এ ব‌ই গ্রন্হি মোচনের,এ ব‌ই 'আত্মপ্রতিবাদের ঐক্যে'-র।




চৈতালীর কবীর: চৈতালী চট্টোপাধ্যায়: ধানসিড়ি:একশো পঁচিশ টাকা: প্রচ্ছদ - সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন