দোঁহা

শতদল মিত্রের উপন্যাস

 


আধেকজান

(পর্ব - ৬)


॥ ১ 


ভোটের পরের দিন ইলেকশন ডিউটি লিভউদ্দালক অফিস যায় নি তাই। কাল রাতে সব সেরে ডায়মণ্ড হারবার ডিসিআরসি থেকে ছাড়া পায় সে, তখন রাত দশটা। অন্যেরা স্টেশন থেকে লাস্ট ট্রেন ধরে ফিরে যায়। সে তার গাড়িতে। ড্রাইভারকে বলা ছিল। বাড়ি যখন আসে রাত সাড়ে এগারোটা।জামা-প্যান্ট ছেড়ে, নিজেকে জীবাণুমুক্ত করে, তারপর খেয়ে রাত্রি প্রায় একটা নাগাদ সেই যে বিছানা নিয়েছে উঠেছে বেলা ন-টায়। তাও মালতীমাসি ডেকেছিল তাই। মালতীমাসি ওদের গভর্নেস। ওদের ঘরেই থাকে, সেই ঠাকুরদার আমল থেকে। কাল রাতে ও যখন ফেরে মাসি রাত জেগে বসেছিল তার প্রতীক্ষায়। যদিও রাত সাড়ে এগারোটা-বারোটা মেট্রোপলিস কলকাতায় তেমন রাতই নয়। তবুও সময় মেনে চলা তার মা নিজের বেডরুম থেকে বেরিয়ে একবার শুধু বলেছিল—ও! এসেছ। ঠিক আছ তো?

-হ্যাঁ, ঠিক আছি। তুমি শুয়ে পড়। উদ্দালক বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলো আলগোছে ভাসিয়ে দিয়েছিল।

 

-আজ তো ছুটি। কোথাও বেরিয়ো না। সময়ে খেয়ে নিও। বিশ্রাম নিও।

আজ সকালে ঘুম ভাঙলে কর্তব্যনিষ্ঠ তার মা নিজের ঘরে অন-লাইন ক্লাস শুরুর আগে তাকে সাবধান করেছিল। করোনাকালে কলেজ বন্ধ। যা ক্লাস সব অন-লাইন। ঘরে বসেই। উদ্দালক দুপুরে খেয়ে আবারও নিপাট একটা ন্যাপ দিয়েছিল। এ মুহূর্তে সে তার সাততলার ব্যালকনিতে আরামে বসে আকাশ দেখছে। হাতে চায়ের কাপ। শেষ বিকেল এখন। দূরে একটা হাইরাইজ কমপ্লেক্সের পেছনের ছাই-রঙা আকাশটায় মরা লালের একটু ছোপ। সূর্য ডুবে গেছে বোধহয় এতক্ষণে! তাদের এ কমপ্লেক্সে অনেক গাছ। তবু তাদের মাথায় বিকেলের কোনো লাল মায়া লেগে নেই। শুধু পাতাদের পাখিদের ব্যস্ত ডাকাডাকি দিন শেষের কথা মনে পরিয়ে দিচ্ছে। একে একে স্ট্রিট লাইটগুলো আলো বমি করতে শুরু করে। নগরে সন্ধ্যা নামে না বোধহয়। ভাবে উদ্দালক। তার ভাবনাকে ছিঁড়ে হঠাত্‍ই ফোন বেজে ওঠে। আম্রপালি। না, উদ্দালক বিয়ে করেনি। তবে স্টেডি রিলেশনে আছে আম্রপালির সঙ্গে আপাতত। হ্যাঁ, আপাততই। বিয়ের প্রাতিষ্ঠানিকতা?  জানে নে সে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে উদ্দালক। সে নিঃশ্বাসে আপাতত শব্দটা আবারও আদল পায়। নিঃশ্বাসের সঙ্গে আপাতত উড়ে যায় আম্রপালি। উঠে দাঁড়ায় সে। সিগারেট ধরায়। ব্যালকনির গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে ওপরের ফালি আকাশটাকে যতটা পারে চোখে টেনে আনে। ধোঁয়াটে আকাশে তারা খোঁজে সে। অনেক কষ্টে দুটো প্রাণহীন মিটমিটে তারা চোখে ধরা দেয় তার। সে দুটো গ্রহ, নাকি নক্ষত্র বুঝতে পারে না উদ্দালক। সিগারেটে শেষ টান দেয় সে। ব্যালকনির কোণে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দেয় সিগারেটের টুকরো আগুনটা। নিচের রাস্তায় চোখ রাখে সে। পুতুল-পুতুল মনে হয় বহু নিচের মানুষ আর চলন্ত গাড়িগুলোকে। রাস্তার ঝকঝকে আলোয় সমস্ত কিছুই ঝাঁ চকচকে। কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন। নাগরিকতার বিজ্ঞাপনের আড়ালে ঢেকে রাখা তার মজ্জাগত এ বিচ্ছিন্নতা। মনে মনে হাসে উদ্দালক। করুণার হাসি অথচ গ্রাম!


কোথাও বোধহয় বৃষ্টি হচ্ছে। দূর কালো আকাশে বিদ্যুত্‍-এর আলতো ঝলকানি। ঠান্ডা একটা হাওয়া ভেসে আসে। ঝড় উঠবে? ভাবে উদ্দালক। ভাবনার মাঝখানে আনমনা সে ব্যালকনির প্লাস্টিক চেয়ারটায় গা এলিয়ে দেয়। তার মনের দৃষ্টি সীমায় তখন মঞ্জিপুর। এই নাগরিক কেন্দ্রের তথাকথিত উজ্জ্বল ছটার বাইরে এক অন্য ভারতবর্ষ, অপর বাংলা। ভাগ্যিস ভোটের ডিউটি পড়েছিল! মঞ্জিপুর না এলে জীবনের অনেকখনি উপলব্ধির বাইরেই থেকে যেত তার। সে কি কোনোদিন ভাবতে পারতো—মসজিদে তার মতো পৈতেধারী ব্রাহ্মণের ছেলে টয়লেট ব্যবহার করছে? করতে দিচ্ছে? সাঁঝের অন্ধকার ঘন হতে থাকে ব্যালকনিতে। ঘন হতে থাকে তার চিন্তার জাল। নাকি মায়ার জাল? উদ্দালকের কানে এখনও যেন সেই আন্তরিক আক্ষেপের প্রতিধ্বনি—ইবার তো কিছু খাওয়াতি... । না, গ্রামের, তার মানুষজনের সবটাই ভাল নয়। মানে সে। সেখানেও গ্রামের নিজস্ব রাজনীতি, দলীয় রাজনীতির বিষ আছে। কী করে সে ভোলে ভোটের আগের দিন রাত্রে পঞ্চায়েত প্রধানের সেই ধাতব শীতল ভয় জাগানো! ভোটের দিনের বোমাবাজি। একজনের বেঘোরে মৃত্যু! তবুও সে নোংরামি তাদের পরিচিত ঢঙের। পাঁচ গাঁয়ের লোক সবাই সবাইকে নামে চেনে। কার ঘরে ভাতের সঙ্গে কী তরকারি রাঁধা হয়েছে, কার ভাত জোটেনি—জানে তারা। এমনই বলত তার ঠাকুরদা। হয়তো তাই-ই। ঠাকুরদার সঙ্গেই তাদের গ্রাম-শিকড় ছিঁড়ে গেছে। ভাবনারা, কিংবা মায়াই জাল বিছায় তার মনে।

     

আর মঞ্জিবেগম? মনে মনে হাসে উদ্দালক। গ্রামে পাকা রাস্তা, বাস, মোটর সাইকেল, টিভি, স্মার্ট ফোনের নাগরিক সাজ। তবুও আজও কী অবলীলায় তারা বেঁচে থাকে মিথে, প্রবাদে, পুরাণ-বিশ্বাসে! মঞ্জিবেগমের ওই কচি-কিশোরী হাত-পা তাকে কৌতুহলি করে তুলেছিল। আর সে কিশোরীও কী স্মার্ট তার পুরাণ ভূমিকায়। গট গট করে ঢুকল। আঙুল বাড়িয়ে কালি দাগাল। মেশিন পিঁ-শব্দে সংকেত দেওয়া মাত্র বোতাম টিপে আবারও গট গট করে বেরিয়ে গেল। যেন কতদিনের ভোট-অভিজ্ঞ সে। উদ্দালক পরে জেনেছিল যে গাঁয়ের সদ্য কিশোরীদের মধ্যে থেকে লটারি করে মঞ্জিবেগমকে বেছে নেওয়া হয়। যে নির্বাচিত হয় দু-দিনের জন্যে হলেও বিশেষ হয়ে ওঠে সে। এ ভোট-পরবে সম্মানিত গ্রাম-মাতা যে সে! নতুন জামা পায়, মিষ্টির প্যাকেট। ভোটের আগের দিনই দলনির্বিশেষে সব অভিজ্ঞরাই তাকে পাখি পড়ানোর মতো ভোটের নিয়ম-রীতি বোঝাতে থাকে, যাতে আসল পুজোয় খুঁত না ঘটে। যেন কুমারী পুজো!  


-কী গো ছেলে! অন্ধকারে বসে কী করছ? আলোটাও জ্বালনি। দুটো পাকোড়া ভেজেছি। গরম গরম খাবে এসো। চা-ও বসিয়েছি।

     মালতী মাসি তাকে ছেলে বলেই ডাকে। তার মায়েরই বয়সী প্রায়। হয়তো কিছুটা বড়। ওর হাতেই মানুষ উদ্দালক। না, উদ্দালকের কোনো ডাকনাম নেই।

-মা কী করছে?

-বৌদি তো এখন গানের প্র্যাক্টিসে বসেছে।

কলেজ আর গান এই নিয়েই তার মা ব্যস্ত রাখে নিজেকে। ছোটো থেকেই দেখে এসেছে উদ্দালক। মায়ের গান শুনেই নাকি তার ঠাকুরদা মা-কে একমাত্র ছেলের বউ করে নিয়ে এসেছিল। 

   

মালতী মাসি চলে যায়। উদ্দালক আড়মুড়ি ভেঙে চেয়ার থেকে ওঠে। গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে ঘাড় কাত করে আর একবার আকাশে চোখ চালায়। সেই দুটো মিটমিটে তারা ছাড়া অন্য তারা খোঁজে সে। নাঃ, কালচে আকাশে অন্য তারা নেই। দূরে ভাঙা ফালি চাঁদ ফ্যাটফেটে জ্যোত্‍স্না ছড়াতে চায়। শহরের কৃত্রিম আলো তার নৈসর্গিক আভাকে গিলে নেয়।

-আরে! ওই তো আর একটা তারা! সেই মলিন, মিটমিটে আলোবিন্দুই। তবুও নতুন আরেকটা তো। এ সন্ধানে উদ্দালকের মন আলো পায়। সে তিনটে তারা কখন যে মঞ্জিপুরের আকাশভরা নক্ষত্রপুঞ্জ হয়ে ফুটে ওঠে তার অবচেতনে, জানে না সে। জুইফুলের এ নৈবেদ্যে যেন আবারও তার বাবার মুখের ছায়া। পরক্ষণেই সে ছায়া মুছে গিয়ে উদ্দালকের ঠাকুরদার মুখ ভেসে ওঠে তার বাবার মুখের আদল অনেকটাই ঠাকুরদার মতো। আর সে নাকি মাতৃমুখী ছেলে!   


নিচ থেকে জ্যামে আটকে থাকা একটা অ্যাম্বুলেন্স তীক্ষ্ন স্বরে সাইরেন বাজিয়েই যায়। উদ্দালক আলো জ্বালে।

সচেতন উদ্দালক তার ঠাকুরদার জায়গিরে সেঁধিয়ে যায়।

 

॥ ২ 


অফিসে পা দিতেই ক্যাশিয়ার বোসদা-র উদার আহ্বান—কী ভাই! দেশি মুরগির ঝোল-ভাত, না বিরিয়ানি?

-দুর্ভাগ্য দাদা! হরিমটর। হেসে বলে উদ্দালক।

-তা, বিসর্জনের বাজনাবাদ্যিও বেজেছিল নাকি?

-ওই দু-একটা বোমা।

উদ্দালকের কথায় হেসে ওঠে ব্যাঙ্কে হাজির বাকি সকলে। গেটে ভিড় করা কাস্টমারদের দুয়েক জনাও। এখনো দশটা বাজেনি। উদ্দালক ওয়াশরুমে গিয়ে হাতে সাবান দেয়। কানে আসে রায়ার কথা।

-সত্যি, ভোট তো নয়, বিসর্জনই। হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দেওয়া। আমার তো ভয়ে এখন থেকেই বুক ধড়-ফড় করছে।


ওরও ভোট ডিউটি। তবে দু-সপ্তাহ পর। ইলেকশন কমিশনের অশেষ বদান্যতায় করোনাকালে মহিলাদের ডিউটি ঘরের কাছে। তাই রায়ার ডিউটি শেষ দফায়, কলকাতা পর্বে। উদ্দালক নিজের টেবিল-চেয়ারে বসার আগে স্যানিটাইজ স্প্রে করে। চেয়ারে বসতে বসতে সে অভয় দেয় রায়াকে।


-কোনো ভয় নেই। ভোটের আগে একবার শুধু বোসদা-র কাছ থেকে টিপস নিয়ে নেবে। আমি তো বোসদা-র মন্ত্রেই উতরে গেলাম। যেদিকে ঢাল শুধু সেদিকে নিজেকে গড়িয়ে দেওয়া... তারপর ভাগ্য। তবে তোমাদের তো ঘরের কাছে শহরে ডিউটি। আর তাছাড়া মহিলাদের জন্য পিসফুল বুথই দেওয়া হয়।


-যা হোক আপনি তো এ যাত্রা উতরে গেলেন। ভালোই ভালোই আমি উদ্ধার পেলে এখন বাঁচি। বোসদা আমাকে বাঁচাবেন কিন্তু। রায়া তার কাউন্টার থেকে কথাটা আলগোছে ছুঁড়ে দেয় ক্যাশিয়ার বোসের খাঁচায়।

-আরে, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। ভোটের দয়ায় তোমাদের তো ডবল ডোজ ভ্যাকসিন সারা। আমাদের ওপর সরকারের দয়া কবে হবে কে জানে!

বোসদার মুখে সত্যিই উদ্বেগের ছায়া। আর হবে নাই বা কেন? সেই ২০১৯-এর ডিসেম্বরে কেরলে প্রথম করোনা কেস ভারতের। সবার ভাবনায় ছিল গরমের দেশে এ ভাইরাস অত ছড়াবে না। টিভি চ্যানেলে ডাক্তাররাও অভয় দিল শুধু মাস্ক পরলে, ঘন ঘন হাত সাবান দিয়ে ধুলেই নাকি করোনা হবে না। আর অবশ্যই দু-গজি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। দূরত্ব সামাজিক হবে কেন? নিরাপদ কেন নয়? এ ভাবনা প্রথম থেকেই দখলদারি বসায় তার মাথায়। এমনিতেই তো ফোনমগ্ন আমরা পারস্পরিক বিচ্ছিন্ন। তাও যেটুকু সামাজিকতা ছিল,  করোনা এসে সেটুকুও মুছে দিল যেন। ভাবে উদ্দালক। হঠাত্‍ একটা কথা মনে পড়ায় তার মুখে হাসি খেলে যায় আনমনে। গত বছর শীতকাল। লকডাউন নেই। ও পাট পুজোর আগেই উঠে গেছে। কিন্তু করোনা একটু থমকালেও থেকেই গেছে। তাই সাবধানতার মার নেই ভেবে সে ব্যাঙ্ক আর ঘর ছাড়া বাইরে কোথাও যায় না খুব দরকার না হলে। কারণ তার মাথায় ঘোরে ঘরে দু-দুজন বয়স্ক মানুষ। ছুটির দিন সন্ধের সময় সে হাঁটতে বেরিয়েছে। গলির অন্ধকারে দেখে একজোড়া যুবক-যুবতী স্তব্ধ বাইকে বসে। জোড়া মুখে নীরব-নীলাভ আভা। দু-জনাই ফোনমগ্ন। অবাক হয়েছিল উদ্দালক। ওরা কি নিজেদের মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ চালাচালি করছিল! বাকহীন ভাষা! আর এ প্রসঙ্গেই ওর আম্রপালির কথা মনে পড়ে যায়। ভার্চুয়াল বাস্তবতার বাইরে কতদিন তারা পরস্পরকে রিয়্যাল জগতে চর্মচক্ষে দেখেনি! আজ একবার দেখা করলে হয়। কিন্তু কোথায় করবে? সাউথ সিটি মলের ক্যাফেতে ডেকে নেবে? ওখানে তো আবার বড়লোকের বখাটে ছেলেমেয়েদের অযথা আড্ডা—মুখোশহীন! 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন