সুনির্মল বসুর গল্প
ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হসপিটালে গতরাতে গোকুল সামন্ত মারা গিয়েছেন। দীর্ঘদিনের অসুখ। বহুদিন ধরে চিকিৎসা চলছিল। অবশেষে জীবনের পরিসমাপ্তি।
একমাত্র মেয়ে সুমিতার বিয়ে দিয়েছিলেন চাকরি থাকতে থাকতেই। জামাই সরকারি কর্মী। একমাত্র নাতি তাতাই। স্ত্রী মিতালী অনেক দিন ধরে অসুস্থ। গোকুল বাবু আগেই জানিয়েছিলেন, নদীর ধারের প্রাচীন শ্মশান ঘাটে যেন তাঁকে দাহ করা হয়। তাঁর
বাবাকেও এখানেই দাহ করা হয়েছিল। পৌরসভা থেকে নতুন করে বৈদ্যুতিক চুল্লি স্থাপন করা হলেও,
গোকুল বাবু সেখানে যাবার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন।
বাড়িতে তাঁর শবদেহ এলো। মেয়ে-জামাই ও নাতি এলো। প্রতিবেশীরা এলেন। বিস্তর কান্নাকাটি হলো।
তারপর গভীর রাতে পাড়ার যুবকেরা তাঁকে শ্মশান ঘাটে নিয়ে গেল। তখন গভীর রাত। প্রবল শীতের রাত্রি। চারদিকে কুয়াশার চাদর বিছানো। পথে ধ্বনি উঠলো, বল হরি, হরিবোল।
শ্মশানে বামুনের প্রয়োজন হয়। হাত কাটা শ্যামল ডাক দিল, ও ডাকুদা, প্লিজ উঠুন।
ডাকুদা মদে চুর হয়ে থাকেন। তিনি বেড়ার ঘরে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন।
ন্যাপলা আবার ডাকল,ডাকুদা, আসুন না, প্লিজ।
কোনো সাড়াশব্দ নেই।
অনিমেষ ততক্ষনে কাঠ কেনা নিয়ে ব্যস্ত। দীপ্তেন বাঘ মার্কা বিড়ি ধরিয়ে লম্বা টান দিচ্ছিল।
সিদ্ধার্থ বরাবরই একটু রগচটা ধরনের।
এগিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল। বলল, এই শালা ডাকু, জলদি উঠবি কিনা বল্।
ভেতর থেকে সাড়া এলো, দাঁড়া শালা, আসছি।
ডাকুদা বের হতেই, শ্যামল ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোকে সুদ্ধ চল্ জ্বালিয়ে দিই।
রাত বাড়ছিল। চিতা সাজানো হলো। ডাকুদা পারলৌকিক কাজ করে চলে গেলেন। নাতি দাদুর মুখে আগুন দিল।
চিতা জ্বলে উঠলো। ধোঁয়ায় শীতের আকাশ ভরে উঠলো। পাশের নদীর ধীর-স্থিরভাবে বয়ে চলল। কয়েকজন চিতার ধারে দাঁড়িয়ে তদারকি করছিল।
কয়েকজন চা সিগারেট খেতে গেল।
ওরা সিগারেটে সুখটান দিয়ে গোকুল সামন্তের চরিত্রের গুনাগুন আলোচনা করছিল।
শ্যামল বিড়িতে একটা লম্বা টান দিল। অনিমেষ বলল, তুই এমন ভাবে বিড়ি টানছিস, যেন ফাইভ ফিফটি ফাইভ খাচ্ছিস,
ন্যাপলা বলল, গোকুলদা মানুষটা ভালো ছিল, কিন্তু ছিলেন হাড় কিপ্যুস। পূজোর সময় কিছুতেই চাঁদার টাকা বাড়াতে চাইত না।
শ্যামল বললো, কিন্তু কেউ বিপদে পড়লে, নিজেই হেল্প করতে এগিয়ে আসতো।
সিদ্ধার্থ বলল, কিন্তু শ্মশানে সব পুড়ছে।
অনিমেষ বলল, কি,
ন্যাপলা বলল, সংসারে কিছুই থাকে না রে, এত যে আমার আমার করি, শেষ পর্যন্ত সব পুড়ে যায়।
অনিমেষ বলল, মানে।
এখানে শরীর পোড়ে,
কি বলছিস,
ভালোবাসা পোড়ে,
তাই নাকি,
বিবেক পোড়ে,
আর,
মানবিকতা পোড়ে,
তারপর,
সব পুড়ে যায়,
অনিমেষ বলল, ভুল বললি গুরু,
কেন,
স্মৃতি পোড়ে না,
ন্যাপলা বলল, এত হাই লেভেলে কথা বলিস না তো, আমার মাথার অ্যান্টেনা ক্যাচ করতে পারছে না,
অনিমেষ বলল, আমার কাছ থেকে হাজার টাকা লোন নিয়েছিল গোকুলদা, সেই টাকাটা মায়ের ভোগে গেল, ও শালা আর ফেরত পাব না,
শ্যামল বললো, লোকটাই ফুটে গেল, আর তোর কাছে টাকাটা বড় হয়ে গেল,
অনিমেষ বলল, না ,আমি তা বলছি না।
সিদ্ধার্থ বলল, এইতো জীবন, আজ আছে কাল নেই, তাই নিয়ে মানুষের কত অহংকার, কত কেরামতি,
সামনে দাউ দাউ করে চিতা জ্বলছিল।
ন্যাপলা বলল, গোকুলদা পূজোর চাঁদা দিতে চাইত না বটে, তবে আমার মেয়েটা অসুস্থ হলে, প্রচুর টাকা দিয়ে আমাকে হেল্প করেছিল, আমাকে বলেছিল, মন্দির না বানিয়ে এদেশে হাসপাতাল বানানো উচিত, আমি ওর কথা সেদিন পাত্তা দিইনি।
রাত ভোর হয়ে আসছিল। ভোরের পাখি নদীর উপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছিল।
সন্টে বলল, এই ন্যাপলা, একটা চারমিনার সিগারেট দেতো, বিড়ি টেনে টেনে বুকের মধ্যে সুয়েজ ক্যানেল হয়ে গেছে।
শ্যামল বলল, আমার সিগারেটটা হাফ পোর্শন টেনে তোকে দিচ্ছি।
সন্টে বলল, থ্যাংকু দোস্ত।
রাতের আকাশ চিতার আগুনে এবং ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। পাশে ভাগীরথী নদীর এই শাখা অংশটুকু ধীরে প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছিল। বিশাল নিম গাছের ওপর রাত পাখি ডেকে চলেছিল। দূরে দূরে দুই পারের গ্রামগুলি নীরবে নিস্তব্ধভাবে যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। রাতের আলো গুলো যেন স্বপ্নের মতো কেমন একটা আচ্ছন্ন চেতনায় ঘুমিয়ে ছিল।
সিদ্ধার্থ বলল, সংসারে মানুষের কত ঠাটবাট, কত অহংকার। এখানে সবাই সমান,
শ্যামল বললো, এটা বুঝতেই এক জীবন কেটে যায়,
ন্যাপলা বলল, আমার শালা কেমন কান্না পাচ্ছে,
সিদ্ধার্থ বলল, কেন রে,
ন্যাপলা বলল, মানুষ আসে, মানুষ চলে যায়। জীবন একই রকম থাকে। পৃথিবীতে কারো কিছু এসে যায় না,
শ্যামল বললো, এ শালা কেমন দামি দামি বুলি ঝাড়ছে,
অনিমেষ বলল, আর বেশিক্ষণ সময় লাগবে না, মোটের উপর কাজ শেষ হয়ে এসেছে,
সিদ্ধার্থ বলল, জীবনের একটা শুরু যেমন আছে, তেমনি শেষও আছে, সবার জীবনেই এই দিনটা একদিন আসে,
মানুষ সব জানে, মানুষ সব বোঝে, তবু কেন যে এত অহংকার, কেন যে এত খেয়োখেয়ি, শ্যামল বললো।
সিদ্ধার্থ বলল, জীবন যেন পদ্ম পাতায় এক বিন্দু জল, বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কত ছল,
ন্যাপলা বলল, গুরু, এ শালা যে কবিতা হয়ে গেল,
সিদ্ধার্থ বলল, জীবনে কোনোদিন কবিতা লিখিনি, পরিবেশটাই কবি বানিয়ে ছাড়লো,
তখন চারদিক ফর্সা হচ্ছে। দূরে জেলেদের মাছ ধরার নৌকা থেকে হাকডাক কানে আসছিল। দূরে গাছের ফাঁকে সূর্যের তরুণ আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল।
মাটির কলসিতে করে চিতায় জল ঢালা হল। ওরা নদীতে নেমে স্নান করে বাড়ি ফিরছিল।
শ্যামল বললো, রাতটা কেমন করে কেটে গেল,
অনিমেষ বলল,গোকুলদার মৃত্যু আমাদের একটা স্বপ্নের রাত উপহার দিয়ে গেল,
সিদ্ধার্থ বলল, স্বপ্ন, না দুঃস্বপ্ন, বুঝিনা, এখানে এলে, বুঝি, এখানে মানুষের শরীর পোড়ে, স্বপ্ন পোড়ে, ভালোবাসা পোড়ে,
অনিমেষ বলল, শুধু স্মৃতি টুকু পোড়ে না,
ন্যাপলা বলল, এখন শোক ও স্মৃতির বয়স এক বছর নয়,
সিদ্ধার্থ বলল, মানুষ দ্রুত মানুষকে ভুলে যায়,
অনিমেষ বলল, গত রাতটা আমাদের অনেক কিছু শেখালো,
শ্যামল বললো, রাতের আকাশ, রাতের নদী, রাতের শ্মশান, রাতে মৃত্যুর ভয়াবহতা, সবকিছু তো দেখা হলো,
ন্যাপলা বলল, ইসি কা নাম জিন্দেগি, মেরা দোস্ত,
ততক্ষণে সূর্যের চড়া রোদ্দুর ওদের গায়ে এসে পড়ছিল।
শ্যামল বললো, গোকুলদা কেমন ড্যাং ড্যাং করে ওপারে চলে গেল, তাই নারে,
সিদ্ধার্থ বলল, যাওয়া আসাই জীবন,
অনিমেষ বলল, ফুল ফোটে, ফুল ঝরে, দিনগুলো যায় চলে,
সকাল হতেই, ওরা সবাই বাড়ি ফিরে এলো।
অন্যান্য দিনের মতো আবার একটা নতুন দিন শুরু হলো।