দোঁহা

ফিরে দেখার গান



অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়


-বসন্ত বলতেই আমাদের প্রথম কি মনে পড়ে?
-রঙ
-আর রঙ বলতেই?

“হোরি খেলে রঘুবীরা!”...

বচ্চন সাহেবের কন্ঠে সেই সুগম্ভীর আহ্বান। হোলি অথবা দোল বলতেই বচ্চন সাহেবেরই অন্তত দুখানি গান কালজয়ী হয়ে সেলুলয়েড তথা সমাজেও অক্ষয় হয়ে থেকে যেতে পেরেছে। একদিকে ‘বাগবান’এর পূর্বোক্ত গানটি, আর অন্যদিকে ‘সিলসিলা’ ছবির ‘রঙ বরষে’র আবাহন। বাঙালীরা অনেকেই এই সময়ের আবহে, এই পরিপ্রেক্ষিতে রে রে করে উঠতেই পারেন। একদিকে যখন হিন্দি-আগ্রাসনের ঠেলায় রীতিমতো এক জঙ্গি প্রতিযোগিতার মরসুম শুরু হয়েছে তখন আমিও কিনা দোলের বদলে হোলির গান দিয়েই বসন্ত সংখ্যার প্রবন্ধের নান্দীমুখ করে বসলাম? এই একেকটা উৎসবের দিন আমাদের বোধ করি মিলনের দিন হিসেবেই পালন করা উচিত। মনে রাখা দরকার, আমরা যত বেশি ভাঙব–ততই আমরা দুর্বল হয়ে পড়ব। যারা কিনা বিভেদের রাজনীতিকে নামিয়ে আনছে, তারাও কিন্তু চায় ঠিক সেটাই। প্রদেশে প্রদেশে বিভাজন, ধর্মে ধর্মে বিভাজন, ভাষাতে ভাষাতে বিভাজন, মেলবার কথা বা মিলনের প্রয়োজনীয়তার কথা শোনা যায় না আর। মিলের সময় ফুরিয়েছে।

আজ আর তাত্ত্বিক কচকচিতে যাব না। সে সব অনেক হয়েছে। আজকে নাহয় বসন্ত আর মার্চ মাসের ধুলো ওড়া সময়ের কথাই ফিরে দেখতে চেষ্টা করি। কলকাতায় আর কিছু না হোক, শীত পেরিয়ে প্রথম গরম পড়া শুরু হতে না হতেই আমরা পাতাঝরার মরসুম পেরিয়ে গাছে নতুন পাতা আসার দৃশ্যকে অনুভব করি। টকটকে লাল হয়ে ফুটে থাকে শিমুল, হয়তো বা পলাশ। এসপ্ল্যানেড ট্রামলাইনে দাঁড়িয়ে কত না স্মৃতিকেই সে মনে পড়ায়। আমার একটি ছেলের গল্প মনে পড়ছে।

আগাগোড়া বয়েজ স্কুলে পড়ে আসা ছেলেটি কলেজে ভর্তি হতে না হতেই দুম করে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। সেকেণ্ড সেমেস্টার তখন। তখনও বসন্ত কাল। মার্চ অবশ্য পেরিয়ে গিয়েছিল বোধহয়। মার্চের শেষ অথবা এপ্রিলের গোড়া তখন। স্বপ্নের উপহারের মতোই ছেলেটি অবাক হয়ে দেখেছিল ফিজিক্স ল্যাবের জন্য তিনজন তিনজন করে যে মণ্ডলী ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, রোল নম্বরের আশীর্বাদে সেও কেমন করে জানি গিয়ে পড়েছে তার ভালো লাগা মেয়েটির সঙ্গে একই মণ্ডলীতে হঠাৎ। ফিজিক্স ল্যাবের বড় বড় কাচের জানালাগুলোর ঠিক পাশটিতেই ছিল এক ডালপালা ছড়ানো কৃষ্ণচূড়ার উপস্থিতি। টকটকে লাল ফুল, গরম বয়ে আসা বাতাস, তেমনই মনোমুগ্ধকর একজনের সাহচর্য আর তারই সঙ্গে কিনা নিউটন’স রিংয়ের সেই চোখে জ্বালা-ধরানো এক্সপেরিমেন্ট? অণুবীক্ষণে পড়ত চোখ, চাকতিগুলো মোটেও ফুটে উঠত না। বরং সেই হলুদ-সোনালী আলোর গুচ্ছতেই, আবারও ছেলেটি অনুভব করত ঘাড়ের উপরে বয়ে আসা পূবালী হাওয়ার গন্ধ, মাটির গন্ধ, ধুলোর গন্ধ। মেয়েটি তখন স্যরকে খাতা দেখাতে ছুটত। এক্সপেরিমেন্টের চৌদ্দটা বাজত সেইখানেই। বসন্ত মানে তো স্মৃতিরই উদযাপন। ভালো করে ভেবে দেখুন, এমন স্মৃতিমেদুরতায় আর কোনও ঋতুই আপনাকে আচ্ছন্ন করে না।

তেমনই এক বসন্তে কলেজের ছেলেপুলেরা মিলে রঙ খেলার আয়োজন করেছিল। ততদিনে ছেলেটির জীবনে কবীর সুমনের গান সত্য হয়ে নেমে আসতে পেরেছে। সুমন যেমনটা লিখেছিলেন, “প্রথম প্রেমে পড়ার পর সবাই পস্তায়!”, ছেলেটিও তখন হন্যে হয়ে (ক্লাস অবশ্য সে তেমন কাটেনি), ঘুরেছে রাস্তায়। আবিষ্কার করে ফেলেছে কলকাতা শহরের অনেক অজানা কোণ, অচেনা রোদেলা সুখ। সন্ধ্যে পেরিয়ে ঘুরে দেখে এসেছে জব চার্ণকের সমাধিস্থল, কলকাতার প্রথম পাকা ইঁটের বাড়ির উদাহরণ। এই সময়টা ছিল ছেলেটার তৈরি হওয়ার সময়। ডায়েরির পাতায় একেকটা করে মনোলগ ফুটে উঠত, আর মনে মনে সে ভাবত রবীন্দ্রনাথ। বসন্তের গরম দুপুরগুলোয় কখনও বা সে চলে যেত জোড়াসাঁকোর বারান্দায়। এই সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথ, জাগতিক ও তার চেয়েও বড় কিছুর আধার যিনি, তিনিই ক্রমশ তার প্রাণপ্রিয় আশ্রয় হয়ে উঠতে শুরু করেন। তা বলে দলবেঁধে কলেজের হোলি খেলার উৎসবেও তার অনুপস্থিত থাকার মতো কোনও কারণ ঘটেনি। হয়তো বা সে ছিল। হয়তো বা তার মন অন্য কোথাও পড়েছিল। বাতাসে আবিরের গন্ধ ছিল সেদিন।

মোট কথা বসন্ত বলতেই সে এক পালানো সুখের ক্ষণ। আমার, আপনার সক্কলকার জীবনে, বসন্ত নিয়ে আসে এক প্রগাঢ় উষ্ণতা। যে উষ্ণতা পোড়ায় না, ওম দেয়, আর কখনও বা দেয় এক ঝলসানো আভিজাত্যের সুখ। হাঁটতে হাঁটতে তখন পেরিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় বাগবাজার থেকে আহিরীটোলা ঘাট। হয়তো বা একেবারেই নিমতলায়, যেখানে রবীন্দ্রনাথকে দাহ করা হয়েছিল। বসন্তে মৃত্যুর কথা বলতে নেই। কিন্তু যা অমোঘ, যা সত্য, তারও মধ্যে এক সৌন্দর্য রয়েছে। অথচ তা রয়েছে ততক্ষণই কেবল, যতক্ষণ না অবধি সেই শোক ব্যক্তিগত হয়ে দাঁড়ায়। সেই ছেলেটি এমনই এক বসন্ত দুপুরে আবিষ্কার করেছিল, ‘মেমরিজ ইন মার্চ’ ছবিতে প্রিয় বন্ধুর সৎকার হয়ে যাওয়ার পর ঋতুপর্ণ ঘোষ অভিনীত চরিত্রটি যে ঘাটের পাশটুকুতে বসে অস্থির জন্য অপেক্ষা করছিল, সে আসলে কাশী মিত্তিরের ঘাট। কতবারই না ছেলেটি সেই ঘাটের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছে। হেঁটে গিয়েছে গঙ্গার পাড় বেয়ে। একাকী বিকেলে চুপটি করে বসে থেকেছে নিমতলায়। পোড়া গন্ধ নিয়েছে। রাস্তার পাশে তাকিয়ে দেখেছে কৃষ্ণচূড়ায় এসেছে ফুল। সে অবাক হয়ে বসন্তের গন্ধ নিয়েছে। তার শ্বাস ভরে এসেছে নিস্তব্ধতায়।

সরস্বতী পুজো অথবা স্যাঁ ভ্যালন্তি দিবসের ভালোবাসা অনেকাংশে সাময়িক। অনেকাংশে হুজুগে বলেও মনে হয়। আসলে সেই একেকটা দিনের চেয়েও বসন্তের সার্বিক উপস্থিতি অনেকটা বেশি করেই মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে। শুকনো পাতা পোড়ানোর গন্ধ, ধুলোর গন্ধ, মাটির গন্ধ–এইগুলোকেই বারেবার করে ফিরে দেখতে ইচ্ছে হয়।

ছোটবেলায় রঙ খেলতাম। এখন দেখি আবাসনগুলোয় প্রতিবেশী মানুষেরা আমাদের বাড়িতে আসেন। আবির মাখিয়ে দেন। আমাদের বাবা-মায়েদের বয়স বাড়ছে। এখন তাঁরা অধিকাংশ সময়েই আশীর্বাদ দিয়ে থাকেন। তাঁদের আর আশীর্বাদ চেয়ে নেওয়ার মতো তেমন কেউ নেই। বসন্তে তাঁরা যেন আরও সুন্দর, আরও বিস্তৃত হয়ে উঠুন। চাওয়া বলতে এইটুকুই কেবল। সেই ছেলেটিও নিশ্চয়ই এখন বড় হয়ে গিয়েছে অনেকটাই। যদি বা হঠাৎ করেও আজ, তার সঙ্গে সেই প্রথম ভালোবাসার মেয়েটির দেখা হয়ে যায়, হয়তো বা প্রবল আত্মসম্মানেই দুজনে দুজনকে মাথা নোয়াবে। চলে যাবে অন্য কোনও রাস্তার অভিমুখে। হয়তো বা সেদিনও বসন্ত থাকবে কলকাতায়। হয়তো বা সেদিনও বিকেল, সেদিনও বাতাসে ভাসবে ধুলোটে বিকেলের রঙ। মনে পড়বে দোল-দুপুরের চিনির শরবত। ঠাণ্ডাই অথবা ভাঙের তখনও বয়স হয়নি। রঙচঙে চিনির খেলনা বাজার থেকে নিয়ে এসে, মিশিয়ে দেওয়া হতো জলের পাত্রে। হালকা লেবুর স্পর্শ। আবিরের গন্ধ, আর চিনির গন্ধতেই তখন মিলেমিশে যেত কৈশোর-যৌবনের মৌতাত কেবল। অবলীলায় Oবসন্ত আচ্ছন্ন হয়ে থাকার সময়। সময় স্মৃতিমেদুরতার ...

সেই জন্যই বোধহয় এমন ভাবে ফিরে দেখতে চেয়েছিলাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন