দোঁহা

অন্য নামে ডেকো

 




অরিত্র দ্বিবেদী 

একটা সবুজ পাহাড়ের খাঁজ, সেটাতে ঘাসের রঙ গোলাপি। পাহাড়ের গায়ে শঙ্কু আকৃতির সবুজ পাতার গাছ, অগুনতি। খাঁজটার মাঝখানে একা একটা মিঠে গোলাপি, ফাঁকা ফাঁকা পাতার গাছ। গাছটার মাথার ওপরে, পাহাড়টাকে ছাড়িয়ে অনেক অনেক ওপরের দিকে, ঘন বেগুনি রঙ ওয়ালা আকাশ, তাতে হলুদাভ কমলা তুলো তুলো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। জাপানি অ্যানিমের মতন হাওয়া দাগ কেটে কেটে বইছে, দেখা যাচ্ছে। গাছটার মিঠে গোলাপি পাতা নীচের ইষৎ গাঢ় গোলাপি ঘাসে মিশে যাচ্ছে। সামনেই, গাছটার নীচে একটা কমনীয় ভঙ্গিতে এক রমণী, সে নাম না জানা ভিনদেশি। তার গা গাঢ় নীল, পিছন ফিরে সে দাঁড়িয়ে, কোমর থেকে নীচটুকু ধোঁয়া ধোঁয়া ধূসর। গাঢ় নীল, পাথরের মতন মসৃণ পিঠ থেকে দুটো লালচে হলুদ ডানা বেরিয়েছে। কালো আকাশী চুলে খোঁপা সাজিয়ে রেখেছে একটা আলতো সবুজ মাছ। মাঝে মাঝে গাছ থেকে দশরঙা তিনটে প্রজাপতি উড়ে এসে বসছে, কাঁধে, পিঠে, আর ঊর্ধগামী দুটো হাতে। ধবধবে সাদা বাঁ চোখে সমুদ্র কালো মণিটা তেরছা করে ফিরে আছে, ঠিক এই এইদিকে।

---অপূর্ব! অসাধারণ! নৈসর্গিক! কী দারুণ চিন্তা। ভীষণ ভালো! উফ্ চোখ দুটো যেন সার্থক হলো।

জায়েন্ট স্ক্রিনের দিকে চেয়ে মন্তব্য করল জনৈক রুচিশীল একজন। স্ক্রিনের নীচে যেখানে সবুজাভ দেয়ালের ওপর দিয়ে সাধারণ জনতার চোখ বাঁচিয়ে একটা কালো, দুটো হলুদ আর মোটা একটা সাদা তার নেমে গেছে, তার একেবারে সামনেই একটা ডায়াস, ডায়াসে ফুটে উঠছে ডিজিটাল কালি, সেটা ব্রেকিং নিউজের মতন সরে সরে যাচ্ছে। তার ওপরেই দাঁড়িয়ে একটা মানুষ, যার মাথার সাথে লাগানো যন্ত্রে ওই তার গুলো এসে জুটেছে আর নীচের ক্যাপশনে যার নাম দেখাচ্ছে অ দে। অ হল ভরকেন্দ্র। এই পুরো প্ল্যানিং এর, আর অতি অবশ্যই এক্সিকিউশনের। আজ মর্ডান আর্ট যে এই জায়গায় এসেছে তার জন্য অ এর তৈরি সংগঠন সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। এই যে পৃথিবী জুড়ে হইচই পড়ে গেছে, তার কারণ তো অবশ্যই অ এর সংগঠন, জলছবি। মর্ডান আর্টের যে এইরূপ, সিনেমা, সাহিত্য, আঁকা, গান, মূর্তি, আর্কিটেকচার বা আর পাঁচ সাত রকমের যে ভাগ আর্টের, তার আর কোনো ব্যারিয়ার নেই, মানে আর্ট মাত্রেই এখন ওই জায়েন্ট স্ক্রিন, আর আর্টিস্টদের মাথা। তারা যা ভাববে তাই ফুটে উঠবে ওখানে। ভিসুয়াল অ্যাপিয়ারেন্স হবে তার, সুর ভাবলে তাও শোনা যাবে ওই ওতেই। এই সবই অ এর মাথা থেকে বেরিয়েছে। অন্তত মূল আইডিয়াটা তো বটেই। কোনো বাধা নেই, কোনো সেন্সরশিপ নেই। রেকর্ডেড শো হয়, তবে সবথেকে বেশি ভিড় হয় লাইভ শো গুলোতে, যেখানে অডিয়েন্স দেখতে পায় একজন আর্টিস্ট ঠিক কীভাবে একটা আর্ট তৈরী করে। বলা বাহুল্য তাতে মর্ডান আর্টের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো আর্টের কদরও সমান। অপ্রত্যাশিত ভাবে আর একটা বিরাট পাওনা হয়েছে এতে। এই যে এতদিনকার সনাতন যুদ্ধ শিল্পীর, কালের বিরুদ্ধে। সেইটাই ঘুচে গেছে। আজকাল ক্লাউড স্টোরেজ সবচেয়ে সস্তা জিনিস পৃথিবীর বুকে, নাও নিয়ে হাজার হাজার প্ল্যাটফর্মে ছেড়ে দাও। হিট হয়ে গেলে লাইভ শো তে ডাক পাওয়া কোনো ব্যাপারই না। 

অ খুব নামকরা একজন কবি, মানে রাস্তাঘাটে ডিজিটাল 3ডি পোস্টারে ওঁর হেসে তাকিয়ে থাকা ফুটে ওঠে বেশ ভালোই। হঠাৎ এক সন্ধ্যেবেলা ক্যাথিড্রাল মেমোরিয়ালে এক বক্তৃতা চলাকালীন এই ভাবনা অ এর মাথায় আসে। যে এমন যদি হত, তবে কেমন হত? সায়েন্স আর লিটারেচার বা আর্টের কী দারুণ মেলবন্ধন, ভাবতে ভাবতে খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, তারপর মাংসের কুচি মুখে পুরে বাঙালি যেমন মুখের বাকি অংশে থাকা ভাতটা আগে খেয়ে নেয়, তারপর আয়েস করে মাংসের স্বাদ নেয়, অ ও ঠিক তাই করল। কিন্তু, ওভাবে খেলে যেমন মাংসের স্বাদ কিছু বাদ যায় আর ভাতের স্বাদছাড়া স্বাদটা বড্ড বেমানান লাগে তেমনি অ এর বাকি থাকা বক্তব্য বিস্বাদ হয়ে পড়ল, আর মাথায় আসা চমৎকার ভাবনাটা পুরোপুরি ভাবে রিস্টোর করা গেল না। অনুষ্ঠানের শেষ হওয়া অবধি, ভাবনার মাংস টুকরো মুখে নিয়ে সে জাবর কাটতে লাগল, সত্যি বোধহয় একবার ওর মনে হয়েছিল গরু হয়ে জন্মালে অন্তত এই ভাবনাটা গলা দিয়ে এত সহজে নেমে যেত না। সভা ভঙ্গ হলে অ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জিকে ডেকে বলল,

--এই জি! শোনো না একবার এদিকে, কুইক।

জি নিজের ওয়েল ডিজাইন্ড ড্রেসটা ধীরে সামলে, দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তির থেকে বিদায় চেয়ে নিয়ে খুব আস্তে আস্তে সমভূমির নদীর মতন নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে এল।

--আরে একটা দারুণ আইডিয়া এসছে মাথায়, তাড়াতাড়ি একটা মিটিং ডাকো জলছবির, তুমি আমি ঋ তো এখানেই আছি, বাকিদের কনফারেন্স রুমে ডাকো নাহলে ভারচুয়ালি জয়েন হতে বলে দাও।

 -আইডিয়া কী স্টেজে কথা বলতে বলতে এল !

 অ বুঝেছে বকুনি খাওয়ার সময় এসছে, সে একটা অপ্রস্তুত হাসি হেসে জিকে পাশ কাটিয়ে কনফারেন্স রুমে চলে গেল।

জি অনেক্ষণ ধরে চেয়ে রইল ওর চলে যাবার দিকে। কী দ্রুততা ফুটে উঠেছে ওর পায়ে, ওর সারা শরীরে উত্তেজনার রেশ যেন ফুটে ফুটে বের হচ্ছে। জি নিজের ঘন নীল চোখ দুটো দিয়ে তাকিয়ে রইল। অদ্ভুত আচ্ছন্নতা এনে দেয় জি এর চোখদুটো। সাধারণত এই ধরনের চোখ বড় একটা চোখে পড়ে না আজকাল। যেন সমুদ্রের গভীরতা আরো প্রগাঢ়তর হয়ে ধরা পড়ে ছোট্ট ছোট্ট দুটো গোলকে, ফুটে ফুটে বের হয় ভেতরকার মানুষটার গাম্ভীর্য আর ভালোবাসতে পারার ক্ষমতা। এইটাই অ সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। কী ভাবে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অ সারাক্ষণ তা অ ই বলতে পারবে, হয়ত নিজেকে গভীর, সুন্দরী সমুদ্রবক্ষে হারানো গাংচিল ভাবে বা হয়ত পশ্চিম আকাশের মেঘ যার সব কেড়ে নিয়ে দিয়েছে একটুকরো সামুদ্রিক নীল, ঘন নীল, স্তব্ধ গভীর নীল, সেরকমই এক পথভোলা নাবিক ভাবে। জি ওকে কতবার বলেছে কী ভাবছে বলতে, কিন্তু ও নিঃশব্দই থেকেছে বরাবর, হারিয়ে ফেলেছে সব ব্যাখ্যা সব শব্দ সব অনুভূতি, এক তাকিয়ে থাকার আনন্দটুকু ছাড়া। তাই, যখন কনফারেন্স রুমেও একবার চোখ পড়ে গেল ওই চোখদুটোর দিকে, ভাবনা, স্ক্রিন, ভারচুয়াল মিট, ভবিষ্যতের আইডিয়া, সায়েন্স-আর্ট সমস্ত কিছু তালগোল পাকিয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য, জি বুঝতে পেরে মুখ নামিয়ে নিল, কয়েকটা সেকেন্ড মাত্র, ঘরের অস্বস্তির উসখুসানি শুরু হওয়ার আগেই অ শুরু করল আবার যেখান থেকে একটু আগে হারিয়ে গেছিল। তো আমি যেটা বলছি সেটা হল আপাতত আলটিমেট ক্লাউড স্টোরেজ, তারপর আস্তে আস্তে লাইভ কনসার্ট, জায়েন্ট স্ক্রিনে অডিয়েন্স দেখবে হাউ আ মায়েস্ট্রো ক্রিয়েটস্। 

-তার মানে তুমি বলছ যে, সবসময় একজন আর্টিস্ট ওই জিনিস মাথায় পরে ঘুরবে ! তাই আবার হয় নাকি ! আরে শরীরে এফেক্ট করবে তো !

-না ঋ আমি সেটা বলছি না। যেমন এখন তুমি নোট প্যাড ইউজ করো ঠিক সেই রকমভাবে এই যন্ত্রটা ব্যবহার করো, তোমার অগোছালো, বেসামাল ভাবনাই মর্ডান আর্টের দরকার, ওই মেশিন সেটা ঠিক ফুটিয়ে তুলবে, সাউন্ড অবধি। শুধু একবার ওদের পেরেন্ট কম্পানির সাথে কথা বলে নেওয়া, বাকি এখানে আমি কথা বলেছি, ওরা বলেছে করে দিতে পারবে । হল?

খুব বেশি দিনের কথা নয় তারপর মাত্র কয়েকটা তারাই ততক্ষণে নিজের জায়গা পাল্টেছে, শীত সবে পড়ব পড়ব করছে, হাওয়া যেন ইয়ার ওল্ড জাপানি অ্যানিমের মতো সত্যি দাগ কেটে কেটে বইছে, তবে, হাড়ে। অ অনেকদিন ধরে প্র্যাকটিস করছে একটা আর্ট নিয়ে, বানাচ্ছে, রেকর্ড দেখছে,ভাবছে আবার কিছু চেঞ্জ করছে, তারপর আবার কেটে বানাচ্ছে। ভীষণ ব্যস্ত থাকছে সারাক্ষণ, সবসময় মাথাতে ওই চলছে যেন। জি খুব কষ্ট করে কাটাচ্ছে দিনগুলো, একে তো জলছবি র যত অফিস ওয়ার্ক, সইসাবুদ, তারপর আবার অ এর আপকামিং স্টেজ লাইভ এর যত ঝুটঝামেলা। আর তারও ওপরে অ এর তিরিক্ষি মেজাজ। অ এমনিতে খুব ভালো, কিন্তু ও যখন কিছু ক্রিয়েট করে, তখন মেজাজ আর স্বাভাবিকতা কোনোটাই ঠিক থাকে না, জি সেটা বরাবর দেখে আসছে, সেই কোন আদ্যিকাল থেকে, যেটা তৈরি হয় সেটা জিনিয়াস তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তৈরি করার সময় ওর সঙ্গে একসাথে থাকাটা যে কি ভীষণ দুষ্কর জি ছাড়া আর কেউ তা জানেনা। এবারেও ব্যতিক্রম নেই, কালকেই শো অথচ বাবুর এখনো পুরোটা নাকি তৈরি হয়নি, রাত দিন, জন্ম মৃত্যু অ এর কাছে মূল্যহীন, ও সৃষ্টির নেশায় মত্ত। যদিও, এতদিন ধরে এত হাই ইন্টেনসিটির কাজ করলে ওর শরীর খারাপ হওয়ার ভয় আছে, কিন্তু ওকে আটকাবে সাধ্যি কার ! অর্গানাইজার সকাল থেকে চারবার ফোন করেছে, কী কালারে কীভাবে শো এর নাম লিখবে সে চিন্তা তো আছেই সঙ্গে এও চিন্তা যে শো এর নাম কী দেবে ! অ নিজে ঠিক করবে বলেও এখনো কাউকে কিচ্ছুটি জানায় নি। অ এর ঘরের বাইরের ডাইনিং হলে নিজের সোফায় বসে এইসব ভাবছিল জি, আর ভাবছিল একবার দরজায় টোকা দেবে নাকি ; হঠাৎ করে দরজা খুলে অ বেরিয়ে এল, চোখ সেই উদভ্রান্ত, চুল উশকো খুশকো, মুখে বেশ কিছুদিনের না কামানো দাড়ি, আর করেছে কী ? গায়ে তিনদিন আগের গাউন শুধু এই ঠাণ্ডায় ! অ এর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই এই সব ব্যাপারে, সে ছুটে এসে সজোরে জি এর মাথায় একটা চুমু খেলো, জি তাকালে ওর দিকে, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, ও খুব ভালো করেই জানে এই অবস্থাটা। অ কে জি নিজের আনন্দটুকু করে নিতে দিল, এই সময় অ কে ঠিক একটা বছর চারেকের ছেলের মতো লাগে, যে সবে ঘুম থেকে উঠেছে মাকে নিয়ে একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখে কাঁদতে কাঁদতে, আর ঘর থেকে ছুটে বের হতে গিয়ে দেখছে দরজায় দুনিয়া আলো করা, সকালের উজ্জ্বল জোৎস্নার মতো রোদ নিয়ে মা দাঁড়িয়ে আছে। এই পর্ব মিটে গেলে জি বলল,

-অ, একটা কথা আছে, অর্গানাইজার বারবার ফোন করছে,শো এর নাম আর কালারিংটা…

অ এখন একেবারে স্বাভাবিক, যে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের এই পৃথিবীতে যেমন ব্যবহার করা উচিত এক্কেবারে সেইরকম ।

-ওহ্। তোমাকে বলিনি বুঝি। ইস্। সরি সরি। শো এর নাম দিতে বল "অন্য নামে ডেকো" আর কালারটা...হ্যাঁ, নীল, লাল, বেগুনি আর একটু সবুজ মিলিয়ে করে নিতে বলো, যেন দেখতে ভালো লাগে।

জি মনে মনে হাসল, ও এখন এইটুকুর জন্য সরি বলছে, বেচারা জানেই না গত ক'দিন ও কী ব্যবহার করেছে! যাক্ সে কথা। জি নিজেই ফোন করে সব কিছু ঠিকঠাক করে নিল, কম্পানিতেও একবার ফোন করে বলে দিল, যে কাল একটা বড় দিন, মেশিনটা একবার রিচেক করে নিতে, যেন কাল কোনো মিশহ্যাপ না হয়। গোটা পৃথিবীতে টেলিকাস্ট হবে একসাথে, এটলাস্ট! অ আইডিয়াটা যেদিন দিয়েছিল সেদিন বলেছিল,

-দেখো ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যারিয়ার অনেকটাই সরে গেছে যদিও এখন, তবুও এইটা হলে ওই ওয়ালটা চিরদিনের জন্য ভেঙ্গে যাবে।

গেছে ও তাই। গত তিন মাসে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড এই হিউজ ইমপ্যাক্ট ও আগেই দেখতে পেয়েছিল, বাকি সবার থেকে। এই ট্রেণ্ড এখন একটা সেনসেশন গোটা বিশ্ব জুড়ে। আমেরিকা আর জাপানে তো ইলেক্টেড গভর্নমেন্ট অবধি এটা নিয়ে মাতামাতি করছে, অ এখন সবচেয়ে বড় সুপারস্টার হব হব করছে। এই দেশের গভর্নমেন্টের সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি একটা মিটিং আছে জলছবির। সেইটা নিয়েই জি ভাবছিল, চোখ পড়ল স্টেজে, একটা ডিপ নীল রঙের ইনার সার্ট, ওপরে লাল লঙ গাউন, পুরোনোদিনের মতো তাতে হলুদ জরির নকশা করা, যদিও জৌলুস চোখে পড়ার মতো। মাথায় বেগুনি রঙা পাইরেট হ্যাট আর সবুজ পালক উড়ছে উত্তুরে হাওয়ায়, যেন অতীত যুগের মিউজিশিয়ান বা জাদুকর রিয়ালিটির ডাইমেনশনে ছ্যাঁদা করে উঠে এসেছে। রাতের আকাশ স্টেজের ব্যাকগ্রাউন্ড। অ কে কী সুন্দর লাগছে। কিন্তু অ যখন ক্রিয়েশন শুরু করল চোখ বুজে, একমনে। যখন কালো স্ক্রিনে ফুটে উঠতে লাগল ওর দুনিয়া, মনে হল গোটা পৃথিবীকে একসাথে জেগে থাকা অবস্থায় জীবন্ত স্বপ্ন দেখানো এই লোকটা আদৌ মানুষ তো? নাকি স্বপ্ন লোকের আদি বাসিন্দা, ভুল করে যে আজ সন্ধ্যেবেলায় পৃথিবীর বুকে বেঁচে আছে। 

গোটা স্ক্রিনটা প্রথমে কালচে গাঢ় নীল হয়ে উঠল, একটা দুটো তারা সাদা সাদা, ফুটে উঠল, আস্তে খুব মিহি আওয়াজে শুরু হল একটা শতাব্দী প্রাচীন গান, "তুমি রবে নীরবে"। তারপর কে যেন আকাশে একটা হালকা বেগুনি রঙের ডিবে উল্টে দিল, ঘুলে গেল গাঢ় নীলে, তারপর একটু লাল কয়েকটা কচি কলাপাতা সবুজ সবুজ ছায়াপথ, তাতে আকাশী নীলের আঁচড়, যেন কোনো শিশু মন আকাশ সাজাচ্ছে, নখ দিয়ে টেনে টেনে, এমন কিছু করছে যা আমাদের বুদ্ধির অতীত। তারপর ফুটে উঠল একটা খয়েরি মাটি, কোনো নিভে যাওয়া নক্ষত্র পৃষ্ঠ, তাতে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিকর্তা অ স্বয়ং, হাতে একটা ছোট্ট গাছের চারা, মুখ দর্শকদের দিকে, গান তখন পুরোমাত্রায় চড়া, সে কখন নিজের আওয়াজ তুলেছে কেউ ধরতে পারেনি..."মম দুঃখ বেদন/ মম সফল স্বপন…" "তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী সম…" গান শেষ হতে না হতেই সেই স্বপ্নময়ী দুনিয়ার অসহ্য সুন্দর আকাশের নীচে অ এর হাতে ছোট্ট গাছে ফুটে উঠে বড় হয়ে, ঠিক তালে তালে গানের, নিজের সম্পূর্ণ রূপ নিল একটা পাঁচটা পাপড়ি ওয়ালা হলুদ ফুল, অ তার নাম জানে না, সে ভাবল নাম দেবো এর জোৎস্নাকুচি। অ এর মুখ এবার দর্শকদের দিকে সে স্ক্রিন থেকে বলছে, তার মেঘের মতো গলার স্বরে ভেসে আসছে কবিতা…

       কী নাম তোমায় দেবো বলো

       উত্তুরে হাওয়া নাকি দক্ষিণের 

       স্বপ্ন দুনিয়ায় পালাই চলো

      ওখানেতে তুমি আমার পাশে থেকো

       এখন থেকে তবে আমায়

       অন্য নামে ডেকো...

 কথা শেষ, আস্তে আস্তে বুজে আসছে স্ক্রিনের আলো, গানের শেষ কটা কথা শোনা গেল আর একবার, "জাগিবে একাকী, তব করুণ আঁখি, তব অঞ্চল ছায়া মোরে রহিবে ঢাকি"।

স্রোত জিনিসটা যেমন ভালো তেমনি খারাপ, যতদিন লক্ষ্যের দিকে যাচ্ছে ততদিন ভালো, মাঝে মাঝে খারাপ লাগলেও ভালো, কিন্তু যখনই আশা আকাঙ্ক্ষার উল্টো দিকে বইতে শুরু করে তখন শুরু হয় গণ্ডগোল। অ প্রথমে এই ভাসানো স্রোতে গা ছেড়ে দিয়েছিল, অনেক অনেক নাম ডাক, বড় বড় কনসার্ট গোটা পৃথিবী জুড়ে, সরকারের সঙ্গে মিটিং, প্ল্যানিং। স্রোতে ভাসতে ভাসতে যেই তীরটা ভালো লাগছে সেদিকেই মানুষ দেখে, উল্টো তীরের বিসদৃশ দৃশ্য তার চোখে পড়ে না সচরাচর। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটল না। লাইভ কনসার্টের চাহিদা আর কদর হুহু করে বাড়তে লাগল, চার্জ বাড়িয়ে দিয়েও বিশেষ ফল হল না। এলাকায় একটা কনসার্ট না করাতে পারলে এখন আর জন সাধারণের সাপোর্ট মেলে না রাজনেতাদের, সেসব আগের সুখের দিন গেছে। এখনকার মানুষ জানে সে কী চায়। অ যত ব্যস্ত হতে লাগল, নীল চোখদুটোর কাছ থেকে সে ততটাই দূরে যেতে লাগল, আগে জি যে অপব্যবহার কখনো সখনো পেতো, এখন তা প্রায়ই ঘটে থাকে। অ ও কেমন যেন জিকে নিজের অধিকারের মতোই ভেবে ফেলেছে, জি এখন তার স্ত্রী কম ম্যানাজার বেশি হয়ে উঠেছে, অবশেষে যা হওয়ার তাই হল, পলি পড়তে পড়তে নদীর ওপরকার জলের চিহ্ন রইল না, ফল্গুধারা হয়ত আছে, তবে সেটা এতটাই কম, যে ভাসছে আর যে ভাসাচ্ছে দুজনেই একপ্রকার তা মেনে নিল, পাবলিক মানে আম জনতা চিরকাল যা করে এসেছে তাই করল, অ এর প্রতিটা দুঃখ মোড়া শৈল্পিক কনসার্টকে নিজেদের খাবার টেবিলের মুখরোচক বানিয়ে ফেলল। এইসব কিছুর আকস্মিকতা এত বেশি করে পেয়ে বসল অ কে যে সরকার আর রাস্ট্রবদ্ধ সংস্থার ছোটো ছোটো ডিসিশনগুলো অনায়াসে তার চোখ এড়িয়ে গেল, এমন নয় যে আর কারোর চোখে সেগুলো পড়েনি, কিন্তু জলছবি যখন এই মর্ডান আর্টের ফাদার ফিগার, আর তারাই চুপ, তাই বাকিদের ছুটকো ছাটকা প্রতিবাদ কেউ পাত্তাই দিল না, বিশেষত জন সাধারণ। কারণ সরকার পাবলিকের হিতের জন্য বলে প্রচার করলেও আদতে যে আর্ট এবং আর্টিস্টকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বানানোর তালে আছে, তাতে পাবলিকের কিছুই যায় আসেনা, তাদের চাই একটাই জিনিস এন্টারটেনমেন্ট! সেটাতে যখন সরকারই তাদের পক্ষে তো…

যতক্ষণে নিজের ক্ষোভ, ক্ষেদ, ক্লান্তি থেকে অ একটু রেহাই পেল, বিশ্রাম পেল, ততক্ষণে অনেক অনেক দেরী হয়ে গেছে। সরকার ততক্ষণে রাস্ট্রবদ্ধ সংস্থার অনুকরণে নতুন নতুন সব আইন পাশ করে বসে আছে। নিউজ চ্যানেলগুলো সেইসব আইনকে বিশ্লষণ করা বন্ধ করে ঐতিহাসিক দিন ঘোষণা করে ফেলেছে । ডিবেট চলছে পুরোদমে যে কীভাবে ভালো বা আরো ভালো হতে চলেছে। যেমন এই একটা খ্যাতনামা চ্যানেলের ছবি-

অ্যাঙ্কার-আজ, দেশের ইতিহাসে নিঃসেন্দহে একটা খুব বড় দিন, ঐতিহাসিক দিন। কী বলবেন আপনি ?

আইন বিশেষজ্ঞ-নিশ্চিত ভাবে, এই দাবি আমাদের অনেকদিনের ছিল, আইন করে, মনোরঞ্জনকে নাগরিক ভোগের অংশ করে দেওয়া হল, এ এক দারুণ প্রচেষ্টা। 

অ্যাঙ্কার রিটায়ার্ড মেজরের দিকে ফিরে বললেন,

 -মেজর এই বিষয়টা আপনি কী ভাবে দেখছেন? কী বলবেন আপনি?

মেজর-দারুণ খবর। আমরা যারা দেশকে পাহারা দিই সবসময় তাঁরাও তো দেশের নাগরিক। এই প্রথম একটা সরকার দেশের নাগরিকদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করল, আর বিশ্বে সেটা প্রথম। আসলে কী জানেন তো শিল্পীদের একটা ডিসিপ্লিনের খুব দরকার ছিল, ওই বোহেমিয়ানিজম দিয়ে কিছুই হয় না। 

অ্যাঙ্কারের পরের বক্তা একজন সাধারণ মানুষ, সে যে কেউ হতে পারে, হয়ত স্টুডিওর চা পিয়ন, কিন্তু সেও তো মানুষ, হোক না সে সমাজের নীচু শ্রেণীর, তবুও তো তার একটা বলার কথা থাকতে পারে।

সাধারণ মানুষ-দেখুন বাবু আমি অতশত বুঝিনা। এই যে রবিবার ছুটির দিন, দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে আমি কোনো অডিটোরিয়ামে বউ বাচ্চা নিয়ে গেলেই শো দেখতে পাবো। আমি অত্যন্ত খুশি, সরকারকে অসংখ্য ধন্যবাদ। 

বিরোধী নেতা-আমি একটা কথা বুঝতে পারছিনা, সরকার কিন্তু আমাদের সঙ্গেও কথা বলেছে, এটা একটা সম্মিলিত ডিসিশন, কিন্তু এমনভাবে প্রোজেক্ট করা হচ্ছে যেন আমরা কিছুই করিনি কোনোদিন। দেশের জন্য কখনো কিছুই করেনি আমাদের দল…

সরকারের প্রতিমন্ত্রী-আরে, আপনারা যদি কিছু করতেন তবে তো ক্ষমতাতেই থাকতেন, টিভিতে বসে উল্টোপাল্টা বকতেন না।

বিরোধী নেতা-ঠিক করে কথা বলুন, আর আপনি তো প্রতিমন্ত্রী, এখানে লেকচার না দিয়ে নিজের কাজটা ঠিক করে করুন না! 

অ্যাঙ্কার মুচকি হেসে ঝগড়াটা আর একটু চলতে দিয়ে দুম করে খুব বিরক্ত মুখে বলে উঠলেন,

আমরা দ্রুত একবার দেখে নেবো আজকের ঐতিহাসিক আইনটা। আমাদের সেইসব দর্শকদের জন্য যাঁরা নতুন করে জুড়েছেন।

কথা শেষ করেই মাইকটা খুলে বললেন

-বিরোধীদা আর সরকারদা আজ যা দিলে না, টিআরপি আকাশ ছোঁবে পুরো!

ক্রিকেটে স্ট্রাইকার আর নন-স্ট্রাইকারের মতো হাতে হাতে হাই ফাইভ দিয়ে চোখ মারলেন দুই রাজনেতা।

খবর তখন যাঁরা দেখছিলেন তাঁরা এসব কিছুই দেখতে পেলেন না। তাঁরা দেখতে পেলেন-

আজ দেশের ইতিহাসে বিরাট এক অধ্যায়ের সূচনা। সরকার নিয়ম করে দিয়েছেন দেশের সমস্ত আর্টিস্টকে বিকেল চারটে থেকে রাত দশটা অবধি প্রতিদিন লাইভে শো করতে হবে। কোনো অ্যামেচারকে দিয়ে হবে না। যে আর্টিস্ট হবে তাকে এটা মানতেই হবে অন্যথা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দেশের সমস্ত দল এই আইনে সম্মতি জানিয়েছে, এটা দেশের নাগরিকদের নতুন শতকের উপহার। তাঁদের মনোরঞ্জন এখন থেকে সরকারের দায়িত্ব। কিছু কিছু আর্টিস্ট এর প্রতিবাদ করছেন। সবচেয়ে বড় নাম জলছবি সংস্থা। যাঁরা এই মর্ডান আর্টের স্রষ্টা তাঁদের থেকে এটা আশা করা যায়নি। যদিও আমরা নিউজ চ্যানেল হিসেবে সুসংবাদ দিতেই পছন্দ করে থাকি। তাই সবার প্রথম ব্রেকিং নিউজ আমরা আপনাদের দিচ্ছি, সুপ্রিম কোর্টে আর্টিস্ট ফোরামের করা কেস, আদতে ধোপে টিকছে না। কাল আসতে চলেছে কোর্টের বক্তব্য, তবে আমাদের বিশ্বস্ত সূত্রের দাবি, প্রধান বিচারপতি নিজে এই কেসের ওপর খুব বিরক্ত। আর্টিস্টরা কোনো উকিল না পেয়ে নিজেরাই এই কেস পেশ করেছেন। জজ সাহেব গোপনে সরকারের এই ডিসিশনকে সমর্থন করেন। আসুন আমরা সরাসরি চলে যাই আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতার কাছে, তিনি জজ সাহেবের চাকরের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি বোঝার…

রাগের মাথায় হাতের গ্লাসটা ছুঁড়ে টিভি স্ক্রিনে মারল অ। ঝনঝন শব্দ করে তিনটে জিনিস ভেঙে গেল। টিভি, গ্লাস আর…

তারপর থেকে বিশেষ কিছু বদলায়নি। শহরের মানুষ, দেশের মানুষ সন্ধ্যে হলেই অডিটোরিয়ামে যায়, ডায়াসে দাঁড়ানো মূর্তি গুলো জামাকাপড়ের দোকানের ডামির মতনই অনেকটা। সবাই জামাকাপড় টাই দেখে ডামি গুলো শুধু বদল হয় তাও অজান্তে। আজকাল আর্টিস্টদের শুধু ওই নাম ভেসে যায় ব্রেকিং নিউজের হেডলাইনের মতন তাছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু দু চারটে বিষয় নিয়ে সরকার খুব বেশি চিন্তায় আছে, প্রথমত, নতুন কোনো ছেলে বা মেয়ে আর আর্টের দিকে ঝুঁকছে না, তারা খুব প্র্যাকটিক্যাল, তারা জানে এতে লাভের আশা কিছুই নেই। তাই সরকার বিরাট স্টোরেজ খুঁজছে, যাতে এখন থেকেই সমস্ত আর্ট স্টোর করা যায় এবং পরে সময় সুবিধা মতন সাফেল করে করে সেগুলো ব্যবহার করা যায়। দ্বিতীয়ত, কালচারাল প্রোগ্রাম একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়াতে কথায় কথায় অন্য দেশের সঙ্গে মেল বন্ধন আর সাধারণ মানুষকে ব্যস্ত রাখার সুযোগ দুটোই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সরকারকে তাই খুব হুঁশিয়ার থেকে সব কাজ করতে হয়। সাধারণ মানুষ পুরোপুরি জীবনমুখী, তারা নিজেদের অসুবিধা মুখ ফুটে বলতে দুবার ভাবেনা। তৃতীয় সমস্যাটা একটু ছোটো, নতুন আর্ট তৈরী না করতে পারাটা যখন এই আর্টিস্ট গুলোর হ্যাবিটে দাঁড়িয়ে গেল, তখন একদিনের ঘটনা, ভোরবেলায় যত পাখি আর যত জোনাকি আছে সবাই একসাথে আকাশে উড়ল, ভোরের সূর্য ছেয়ে গেল, পালকে, টিমটিমে আলোতে আর কিচমিচ শব্দে। ঋতু গুলো আর পাল্টায় না কখনো। একটা নাতিশীতোষ্ণ ভাব এসেছে সেই থেকে, গাছ গুলো যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেল। মৌমাছিরা হারিয়ে গেল দল বেঁধে। পাতা গজায়ও না আর বাড়েও না। ঠিক ওই বখাটে শিল্পীগুলোর মতনই দাঁড়িয়ে থাকে ভাবলেশহীন। সূর্যটা আকাশে জ্বলে কিন্তু আলো এসে পৌঁছোয় না এখানে। 

এই সবের মাঝে অ কথাগুলো শুনল নিজের ওই পাহাড়ী আর্ট নিয়ে, 

 অপূর্ব ! অসাধারণ! নৈসর্গিক! কী দারুণ চিন্তা। ভীষণ ভালো! উফ্ চোখ দুটো যেনো সার্থক হলো।

ঠাৎ লোকগুলো খেয়াল করল স্ক্রিনের ছবিটা কেমন বদলে বদলে যাচ্ছে যেন। আস্তে আস্তে সব মুছে গেল, মেয়েটা, প্রজাপতি দুটো, ঘাস, মাঠ, গাছ, পাহাড়। তার বদলে যেটা ফুটে উঠতে লাগল সেটা হল শব্দ, যজ্ঞডুমুর, ভাঁটফুল, জোনাকি, মাঝিমাল্লা, দুঃখপুকুর, নবীন কিশোর, অশনি সংকেত, আকাশের মিতা, সব্যসাচী, কৃষ্ণ, মিলানকোলি, মেঘবালিকা, সময়ঘড়ি, ফুটপাথ, কালবেলা… আরো অনেক অনেক সাদা সাদা শব্দ কালো স্ক্রিনে ঘুলিয়ে উঠতে লাগল, যেমন করে মেঘ তৈরি হয় আকাশে পাহাড়ের চূড়ায়। একটা ধুলো মাখা চাদর গায়ে দেওয়া ছেলে ফুটে উঠল, ছেঁড়া চাদর, পিঠ করে আছে এদিকে, ডান হাতে একটা কাঠের বাঁশি, বাঁ হাতটা আকাশে ওঠানো যেন ডাকছে সে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে। ধীরে ধীরে ফুটে উঠল মেঠো পথ, আগাছা ফণীমনসার ঝোপ, সামনে দূরে জঙ্গল। আর সেই শব্দগুলো একে একে মিশে যাচ্ছে নিজেদের মধ্যে, গিয়ে সৃষ্টি করছে শরতের মেঘ, কোনো রূপকথার নায়িকার ফোঁপানো চুলের মতো। চট করে নতুন কিছু আর কেউ বানায় না, কিন্তু এই নতুনত্ব দেখে ভিড় জমে উঠল অ এর ডায়াসের ঠিক সামনেটায়। একজনের চোখ পড়ল অ এর দিকে, তার নজর এড়ালো না অ এর চোখ থেকে ঝরে পড়া অবিমিশ্র রূপোলি মুক্তোর ফোঁটা। 

সবাই দেখতে লাগল স্ক্রিনে, আবার বদলাতে শুরু করেছে স্ক্রিনটা, নিজের কিছু ভাবার ক্ষমতা অ হারিয়েছে, বাকি শুধু সারাজীবন ভালোবেসে আসা শিল্প গুলোর প্রতিক্রিয়া। খুব ছোটোবেলায় মায়ের কাছে একটা পুরোনো রাশিয়ান গল্প শুনেছিল ও, সেইটাই ফুটতে লাগল স্ক্রিনে, অ এর মত করে।

ছেলেটা হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গেল শরৎ আকাশের নীলিমায়। ঝাপসা হয়ে এল গাছপালা, ঝোপঝাড়, করুন একটা ডুডুক বেজে নামিয়ে আনল সন্ধ্যে, আর তার সাথে অনেক দূরের কোথাকার বালি, অনেক বালি, বিষণ্ণ আলো ঢেকে রাখা একটা বসন্ত ছাড়া মরুভূমি। তাতে জ্বলন্ত সূর্য আর গরম হাওয়া বয় সব ঋতুতেই। তাতে আবহাওয়া পরিবর্তন হয় না, প্রাণের চিহ্ন নেই কোনোদিকে। একটা শুধু পাথর পড়ে। কোথা থেকে একটা বীজ এসে পড়ল পাথরের ছায়ায়। গরম হাওয়া তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারল না, পাথরটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সূর্য আর গরম হাওয়া হাত কচলাল মেরে ফেলার মত কিছু পেয়ে, সারাদিনের আঁচ সহ্য করে বীজটা কিন্তু মরল না। সে আঁকড়ে ভালোবাসল ভোরবেলার ঠাণ্ডাকে, সে মাটির নীচে ছিলনা, কিন্তু পাথরের স্যাঁতসেঁতে ছায়ায় সে যখন নিজের নীচে মাটির আভাস পেল, গাছ হতে চেষ্টা করল অলীক কল্পনায়। তার প্রাণ এল ধীর পায়ে এক সন্ধ্যেয়, ডুডুকটা তখন নিজেকে নিংড়ে বাজছে বেসামাল। সূর্য আর গরম হাওয়া ভাবল গাছ হলেই বের হবে পাথরের আড়াল থেকে, তাদের অট্টহাসি শোনা গেল। গাছ হল বীজটা, সূর্য জ্বালাতে গিয়ে তাপ দিল, কিন্তু সে গাছ তাকিয়ে রইল, পাথর ছেড়ে বের হয়ে, সূর্য আর গরম হাওয়া দেখল, তাতে ডালপালা কিছুই নেই, ফুল ধরেছে কটা, আরো প্রাণের চিহ্ন দিয়ে কটা মৌমাছি উড়ছে তার ফুলে ফুলে, আর ফুলগুলো সতেজ মুখে চেয়ে রয়েছে জ্বলন্ত সূর্যের দিকে। সূর্যমুখী গাছ হয়েছে বীজটা। সবাই  স্ক্রিনে তাকিয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে, ডুডুক থেমে গিয়ে বাঁশি বাজছে এখন মিষ্টি করে, যেনো ভোরের প্রথম হাওয়ার ছোঁয়া।

সেই ছেলেটা যে সবার অলক্ষ্যে অ কে দেখেছিল মুক্তো ছড়াতে চোখ থেকে, সে মুখ তুলে চাইল বাইরে। অডিটোরিয়ামের কাঁচের বাইরে, আকাশ থেকে কীসের যেনো আলো এসে পড়েছে তেরছা করে। সে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল পায়ে পায়ে, দেখল ডুবন্ত সূর্য আলো দিচ্ছে তেরছা করে, আকাশের অন্য দিক থেকে ভেসে আসছে নাম না জানা সব রঙবেরঙা পাখি, রাস্তার ধারের ভাবলেশহীন গাছের মাথায় ছোটো ছোটো করে মেঘ জমে নামিয়ে দিচ্ছে বর্ষা, জীবন যাত্রা স্তব্ধ হয়ে গেছে। জীবনমুখী মানুষেরা থমকে গেছে প্রাণের উচ্ছাসে। অদ্ভুত সুন্দর অলীক রঙের ফুল ফুটছে গাছে গাছে। পিছন ফিরে তাকিয়ে সে দেখতে পেল, অ এর মরুভূমির রঙ পাল্টেছে, সেটা আস্তে আস্তে হয়ে যাচ্ছে আগের সেই উপত্যকাটার মতন, অচেনা ভাষায় ভেসে আসছে রাগ...গম্ভীর গলায়, আর আসছে গন্ধ, স্ক্রিন থেকে, এসে ছড়িয়ে পড়ছে অডিটোরিয়ামে, মিঠে বাঁশির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতন, আলো ফুটে বেরোচ্ছে অ এর গা থেকে...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন