দোঁহা

বিভূতিভূষন ও শিশুকিশোর সাহিত্য

 


শাল্মলী রায় 

গত শতকে যাদের লেখা না পড়লে বা নাম না-জানলে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান কতটুকু সেই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকত, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সাহিত্যিকদেরই একজন। 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনারীতির দিকে মনোনিবেশ করলে একথা বিনা দ্বিধায় বলা যায় যে তিনি বাংলা সাহিত্যে একমেবাদ্বিতীয়ম। প্রকৃতি এবং মানুষকে যে নিগুঢ় বন্ধনে তিনি তাঁর কথাসাহিত্যে বেঁধেছেন; তা রবীন্দ্রপরবর্তী যুগে আর কোথাও পরিলক্ষিত হয়নি। সেই কারণেই শিশুকিশোর মনের সঙ্গে প্রকৃতির যে অদৃশ্য বন্ধন এবং তার ফলে কিশোর মনের যে স্বাভাবিক বিকাশ, বিভূতিভূষণ তাঁর লেখনীতে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তেমনটি আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়না। 
পেশাগতভাবে বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিভূতিভূষণ প্রতিদিন শিশুকিশোর মনের অভিব্যক্তি, বিকাশ, দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন, চিনেছিলেন তাদের সারল্যকে-তাই তাঁর লেখায় এটি ছাপ রেখে গেছে। 
প্রথম উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ লিখেই সাহিত্যপ্রেমীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। বুঝিয়েছিলেন এমন করে শৈশব আর কৈশোরকে এর আগে বাংলা সাহিত্য দেখেনি। দেখেনি যে কেমন করে গ্রামের সাধারণের থেকেও সাধারণতর জীবনও হয়ে উঠতে পারে রূপকথার মতন স্নিগ্ধ উপন্যাস। এমন ধারার উপন্যাস বাংলা সাহিত্য বিভূতিভূষণের আগে কখনো দেখেনি। তাই কৌতূহলী পাঠক আকৃষ্ট হয় এই ধারার রচনারীতিতে এবং অবশ্যই বিভূতিভূষণে। তাই ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত উপন্যাস বিভূতিভূষণকে পাঠকমহলে আদৃত করে তোলে। এরপরে ‘পথের পাঁচালী’র পরবর্তী খণ্ড ‘অপরাজিত’ প্রকাশিত হবার পর স্পষ্টই বোঝা যায় যে বাংলা সাহিত্য তার নতুন নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত হতে শুরু করেছে। যে যুগে বিভূতিভূষণ সাহিত্য রচনা করতে শুরু করেছেন, সেই যুগে বাংলা সাহিত্যের আকাশে ধ্রবতারার মত বিরাজ করছেন রবীন্দ্রনাথ; তারই সঙ্গে বিরাজ করছেন তারই সুযোগ্য উত্তরসূরি কথাসাহিত্যিকগণ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যাদের মধ্যে অন্যতম। তাই বর্তমান পাঠকের মনে এই প্রশ্ন জাগবেই ঠিক কোন গুণে বিভূতিভূষণ 'অখ্যাত' এবং সাহিত্যজগতে সম্পূর্ণ অপরিচিত হওয়া সত্বেও এমন তারকাখচিত আকাশে নিজস্ব আলোকবলয় সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যেই নিহিত আছে বিভূতিভূষণের কাল বিস্তৃত প্রাসঙ্গিকতা। 

প্রথম উপন্যাস 'পথের পাঁচালী’তেই নজর কেড়েছিলেন যিনি, তার লেখার বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য মুগ্ধ করেছিল পাঠক সম্প্রদায়কে। সুকুমার সেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্কে তার ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন-
 “বিভূতিভূষণের বস্তু অভিজ্ঞতালব্ধ হইলেও বাস্তব নয়, তাঁহার দৃষ্টি স্বচ্ছ নয় বলিয়া তাহা রোম্যান্টিক। সে দৃষ্টিতে প্রকৃতি মানবজীবনের খেলাঘর অথবা পটভূমিকা নয়, মানবজীবনই প্রকৃতির খেলাঘর অথবা পটভূমিকা হইয়া প্রতিভাত।"
 এমন বর্ণনাই বলে দেয় বিভূতিভূষণের ব্যতিক্রমী রচনারীতি এবং বৈশিষ্ট্যের কথা। প্রকৃতি যে ধরনের কথাসাহিত্যে নিজেই একটি চরিত্র হিসেবে প্রতিভাত হয়, সেই ধারার কথাসাহিত্যেরই পূজারী বিভূতিভূষণ। তাই প্রকৃতি নয়, মানবজীবন এখানে প্রেক্ষাপট যেখানে প্রকৃতি তার নানান চরিত্র নিয়ে বুনে গিয়েছে কাহিনীজাল। প্রকৃতি এবং মানবজীবনের যে সম্পর্ক তা নিয়েই বিভূতিভূষণ তার রচনাকে বড় যত্নে গড়েছেন। স্বচ্ছ দৃষ্টির যে প্রখরতা তা প্রশ্রয় পায়নি তার রচনায়। বরং প্রশ্রয় পেয়েছে স্নিগ্ধতা, দুঃখ এখানে রূঢ়ভাবে প্রতিভাত হয়নি। ভাদ্রের একটানা বৃষ্টির মত কিংবা মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মত সজল বিষণ্ণতা দিয়ে যত্নে গড়ে উঠেছে ‘তালনবমি’ বা ‘পথের পাঁচালী’, ‘পুঁই মাচা’ কিংবা ‘ভণ্ডুলমামার বাড়ি’। নেহাত সাধারণ, সহজ সরলতাই বিভূতিভূষণের সৃষ্টির আত্মা জুড়ে বিরাজিত। আর সেই আত্মার মধ্যে সদা জাগরূক এক শৈশব। ছোটবেলার যাবতীয় ফ্যান্টাসি যে বড় বয়সেও আমাদের ছেড়ে যায়না, বিভূতিভূষণ সেই বিশ্বাসটুকুই বাঁচিয়ে রাখেন পাঠকের মধ্যে। এমন করে এই বিশ্বাস বাংলা কথাসাহিত্যে এত সহজ কথার মাধ্যমে আর কেই বা কবে বুঝিয়েছেন? বিভূতিভূষণ বাংলাদেশ বা বাংলার বাইরের প্রকৃতির বিশালতার মাঝে যে শিশু, কিশোর, যুবক বা বৃদ্ধের ছবি অঙ্কন করে গেছেন নিরন্তর, তার মুল রস রূপকথার রস; ফ্যান্টাসি। পরিচিত সমাজজীবনের জটিলতায় যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত মন যখন কোথাও হাল ছাড়ার জায়গায় পৌঁছয়, তখনি মনের স্বাভাবিক গতিতেই সে বুনে ফেলতে চায় এক কল্পলোক। যে কল্পলোকে কোন জটিলতা নেই, নেই নিত্যদিনের রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে জীবনের কিংবা মনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। তাই তার বালক অপু স্বপ্ন দেখে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণের প্রতি যে অবিচার তা ঐ তেপান্তরের মাঠে অন্য কোনো সময়ে বদলে গিয়ে মহাভারতকে অন্য এক রূপ দেবে। শিশুমনের যে কল্পনাজাল বোনা হয়, তাকে বাস্তবতার আঘাতে ভাঙতে চাননি বিভূতিভূষণ। তার সাদামাঠা জীবন তাকে হয়তো কোথাও বুঝিয়েছিল যে দৈনন্দিন জীবনের নিত্য জটিলতায় জীবনবোধ ধরে রাখতে গেলে শৈশবকে ধরে রাখতে হয়। শৈশব এক অদ্ভুত অস্ত্র রূঢ় বাস্তবের কঠিন আঘাতের মোকাবিলা করার জন্য। শিশুর কৌতূহল, এবং কবির মত কল্পনার প্রলেপ দিয়ে বিভূতিভূষণ অননুকরণীয় ভাষায় এমন গ্রামীণ জীবনের চিত্র অঙ্কন করেছেন যে, চিত্র হিসেবে তা অনবদ্য এবং অনতিক্রম্য। দুঃখ দারিদ্র্যর যন্ত্রণা যাতনার যে চিত্র তিনি প্রতিনিয়ত কথা দিয়ে বুনেছেন, সেখানে জটিল সামাজিক বা অর্থনীতির তত্ত্বনির্ভর কোনও প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়নি। বরং দুঃখ বয়ে বেড়ানোর যে বিষণ্ণতা সেটাই কেবল কথা দিয়ে বুনে গিয়েছেন তিনি। কথাসাহিত্যে তাই তত্ত্ব নয়, কথা এবং অন্তরের কোমল অনুভূতিগুলিই প্রধান হয়ে উঠেছে। 
 
অন্তরের এই অনুভূতি, বিষণ্ণতা এগুলি সমস্ত মিলে যে চরিত্রগুলিকে বাংলা সাহিত্যে উপহার দিয়েছেন বিভূতিভূষণ, তার সঙ্গে তুলনীয় চরিত্র বাংলা সাহিত্যে বিরল। কেবল বড়দের কথাসাহিত্যেই নয়, শিশুকিশোরদের জন্য যে সাহিত্য তিনি রচনা করেছেন, সেখানেও এক অদ্ভুত স্বপ্ন তিনি বুনেছেন পাঠকের মনে। শিশু ও কিশোর মনের প্রতিনিয়ত যাতায়াত কল্পনা এবং বাস্তবের মধ্যে। এক বারান্দা দিয়ে যেন কল্পনা এবং বাস্তব দুপ্রান্তের দুটি ঘরের মত যুক্ত। তাই বাস্তব জীবনের যেকোনো ঘটনাই শিশু ও কিশোরমনে কল্পনার রসে সিক্ত হয়ে ওঠে এবং এক অন্যতর বাস্তব মনের মণিকোঠায় বাস করতে থাকে। বড়দের পৃথিবী যে বাস্তবকে গ্রাহ্য করেনা কোনদিনই, বড়রা যেই অনুভূতিগুলিকে জোর করে গাম্ভীর্যের আড়াল করে দেয়, শিশু ও কিশোর মন তাকেই সযত্নে লালন করে। আর তারই সঙ্গে লালন করেন বিভূতিভূষণ। তাঁর সামগ্রিক কথাসাহিত্যে তো বটেই; তারই সঙ্গে তাঁর শিশুকিশোরদের জন্য রচিত সাহিত্যেও। 
 বিভূতিভূষণের মধ্যে সর্বদা বিরাজ করেছে এক রোম্যান্টিক মন। বিদ্যালয় শিক্ষকের চাকরির সাদামাঠা জীবনের মধ্যেও তিনি আফ্রিকায় দুঃসাহসিক অভিযানের স্বপ্ন দেখেন এবং কোনদিন আফ্রিকায় না গিয়েও নিপুণ দক্ষতায় লিখে ফেলেন ‘চাঁদের পাহাড়’। দেখেন গ্রামের সাধারণ ছেলে শঙ্করকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হীরের খনির মালিক বানানোর স্বপ্ন। কিন্তু সেখানেই বিভূতিভূষণের ম্যাজিক শেষ হয়ে যায়না; বিভূতিভূষণের ম্যাজিক বরং আর মনকাড়া হয় মূল্যবোধের আলোয়, যখন হীরের লোভ অনায়াসেই ত্যাগ করে শঙ্কর, বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব ছাড়াই। শুধু শঙ্করই নয়, রোম্যান্টিক অনুভূতিরা পরতে পরতে ঘিরে থাকে বিভূতিভূষণের রচনায়। ‘হীরা মাণিক জ্বলে’ বা ‘মিশমিদের কবচ’ তার ব্যতিক্রম নয়। কিশোরবেলার যে অভিযানের লোভ তা উস্কে দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে এই লেখাগুলি। তবে শুধু অ্যাডভেঞ্চারই নয়, কিশোরমনকে আরও গভীরভাবে দেখে বিভূতিভূষণ অনায়াসে বুঝেছিলেন বয়সসন্ধিকালের অতিরিক্ত সংবেদনশীলতাকেও। তাই বয়সসন্ধিকালের সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি যেন কথা দিয়ে অঙ্কিত চিত্রশিল্প হয়ে উঠেছে। দুর্গার চাপা কষ্ট কিংবা তালনবমীর ব্রতের নেমন্তন্নের অপেক্ষায় থেকেও নেমন্তন্ন না পাওয়া গোপাল এত জীবন্ত হয়ে উঠেছে সেই লেখকেরই কলমের জাদুতে। অথচ কোথাও তো এতটুকু জটিলতা বয়ে আনেনি, কেবল এক মন ভার করা বিষণ্ণতার রেশ রেখে গেছে পাঠকের হৃদয়ে। কি করে বিভূতিভূষণ চিনেছিলেন শৈশবকে এত গভীরভাবে, তা প্রশ্ন রেখেই যায়। হয়তো বিদ্যালয় শিক্ষকের জীবন তাই সেই সুযোগ করে দিয়েছিল। অগণিত কিশোর বয়স্ক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মেলামেশাই হয়তো তাকে চিনিয়েছিল শৈশব কৈশোরের ঝড়বাদলের অনুভূতিগুলিকে কিংবা তার নিজের ছেলেবেলা হয়তো সযত্নে লালিত ছিল এক শিক্ষকের অন্তরে।
মূল্যবোধের অবক্ষয়ের যুগ আধুনিককালে শুরু হয়েছিল বিভূতিভূষণ যখন সাহিত্য রচনা করছেন তখন থেকেই। কারণ তিনি যখন তাঁর সাহিত্য রচনার সুচনা ঘতিয়েছেন, তখন সারা পৃথিবীই একটি বিশ্বযুদ্ধ দেখে ফেলেছে। দেখে ফেলেছে মানবিক মূল্যবোধ কেমন করে একই সঙ্গে সারা বিশ্বেই তলানিতে গিয়ে ঠেকে। কি করে নির্বিচারে চলে হত্যালীলা। আর বিভূতিভূষণ সেই পৃথিবীতে শুধু বাসই করেননি সাহিত্য রচনাও করে গেছেন আমৃত্যু। কিন্তু অন্ধকার যেমন কখনো অন্ধকারকে দূর করতে পারেনা, কেবল আলোই তা পারে, তেমনি কেবল যুদ্ধবিগ্রহের বর্ণনা করেই বিভূতিভূষণ যুগচিত্রকে তুলে ধরতে চাননি। বরং তার রচনায় রাজা উজিরের জগতের অন্ধকারের থেকে উলুখাগড়ার দৈনন্দিন জীবনের প্রতিনিয়ত যে লড়াই তাকেই তিনি উপজীব্য করে তুলেছেন। বৃহৎ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সাধারণ ছোট ইতিহাস লুকিয়ে থাকে; যে ইতিহাস কেবল সাধারনের জীবনচক্রের ইতিহাস তাই বিভূতিভূষণের লেখনীতে মায়াময় আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে প্রকাশিত। তাই সঙ্কটের যুগের সঙ্কটের চিত্র আরও মহিমান্বিত না করে বিভূতিভূষণ ছবি এঁকেছেন এক সারল্যমাখা জীবনচর্যার। যেই জীবনচর্যায় দুঃখ থাক্লেও জটিলতা নেই, সঙ্কট থাকলেও উগ্রতা নেই, সংগ্রাম থাকলেও উদ্ধত শ্লোগান নেই; কেবল আছে এক বহমানতা, এক চিরকালিনতা। ভালো এবং মন্দের সহাবস্থানের মাধ্যমে ফুটে ওঠা সহজ অথচ গভীর জীবনদর্শন। 

বিভূতিভূষণ নিজে স্বশিক্ষায় বিশ্বাসী ছিলেন। 'চাঁদের পাহাড়' বা 'হীরা মাণিক জ্বলে'-এর মত শিশু ও কিশোর সাহিত্যেও তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। তিনি নিজে কোনোদিন সেই সমস্ত স্থানে না পৌঁছেও শুধু বই পড়ে তা থেকে জ্ঞানার্জন করে এমন সকল ক্লাসিক রচনা করেছেন। শুধু তাই নয়, এই জ্ঞানার্জন এতটাই  স্বতঃস্ফূর্ত এবং সহজ ছিল যে কোথাও এই সাহিত্যে সাহিত্যকের অহেতুক পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের লিপ্সা দেখা যায়না। বরং শঙ্কর কিংবা সনৎ-এর মধ্যে দিয়ে পাথক খুঁজে পায় এক জ্ঞানপিপাসু কিশোরমনকেই। আসলে শৈশব এবং কৈশোরের স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান পিপাসা বিভূতিভূষণ আমৃত্যু লালন করেছিলেন নিজের মধ্যেই। তাই তার এই চিরকিশোর মনের প্রতিফলন ক্রমাগতই ঘটেছে তার শিশু কিশোর সাহিত্যে এবং অবশ্যই তথাকথিত বড়দের সাহিত্যের শিশু, কিশোর এবং যুবক চরিত্রগুলির মধ্যেও। তাই আমরা অপুর চরিত্রে দেখতে পাই এক অসাধারন প্রকৃতিপ্রেমিক সত্ত্বা। প্রকৃতির সকল রস এবং রহস্য জানবার এক তীব্র আকাঙ্খা অপুকে চালিয়ে নিয়ে গেছে। ঘর থেকে পথ এবং পথের থেকে ঘর এই দুইয়ের মাঝেই চক্রাকারে আবর্তিত হয়েছে তার জীবন। ঠিক তেমনি শঙ্করের জীবনেও একই ঘটনা ঘটেছে। 'চাঁদের পাহাড়' উপন্যাসের সূচনায় পাই-

 “সন্ধ্যার বেশি দেরি নেই। নদীর ধারে নির্জনে বসে বসে শঙ্কর এইসব কথাই ভাবছিল। তার মন উড়ে যেতে চায় পৃথিবীর দূর, দূর দেশে শত দুঃসাহসিক কাজের মাঝখানে। লিভিংস্টোন, স্ট্যানলির মত, হ্যারি জন্সস্টন, মার্কপোলো, রবিন্সন ক্রুসোর মত। এর জন্যে ছেলেবেলা থেকে সে নিজেকে তৈরি করেচে- যদিও এ কথা ভেবে দেখেনি অন্য দেশের ছেলেদের পক্ষে যা ঘটতে পারে, বাঙালি ছেলের পক্ষে তা ঘটা একরকম অসম্ভব। তারা তৈরি হয়েছে কেরানী, স্কুল মাস্টার, ডাক্তার বা উকিল হবার জন্যে। অজ্ঞাত অঞ্চলের অজ্ঞাত পথে পারি দেবার আশা তাদের পক্ষে নিতান্তই দুরাশা। প্রদীপের মৃদু আলোয় সেদিন রাত্রে সে ওয়েস্টমার্কের বড় ভূগোলের বইখানা খুলে পড়তে বসল। এই বইখানার একটা জায়গা তাকে বড় মুগ্ধ করে। সেটা হচ্ছে প্রসিদ্ধ জার্মান ভূপর্যটক অ্যান্টন হাউপ্টমান লিখিত আফ্রিকার একটা বড় পর্বত 'মাউন্টেন অফ দি মুন' (চাঁদের পাহাড়) আরোহণের অদ্ভুত বিবরণ। কতবার সে এটা পরেচে। পড়বার সময় কতবার ভেবেচে হের হাওউপ্টমানের মত সেও একদিন যাবে মাউন্টেন অফ দি মুন জয় করতে। 
 স্বপ্ন! সত্যিকার চাঁদের পাহাড় দুরের জিনিসই হয়ে থাকবে চিরকাল। চাঁদের পাহাড় বুঝি পৃথিবীতে নামে?"

এই স্বপ্নই তাকে পরবর্তীতে বাধ্য করে ঘর ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে। আবার আফ্রিকায় গুহায় বন্দী হয়ে থাকা শঙ্করের মনে পড়ে তার ঘরের কথা, মায়ের কথা, গ্রামের কথা। এ তো সকল শিশু কিশোরদেরই মনের চিরকালের কথা। ঘর এবং ঘর ছেড়ে পথে বেরনোর অর্থাৎ নিজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবার মাঝের সময়টুকুই শৈশব এবং কৈশোরকাল। যে সময়টুকুকেই বিভূতিভূষণ চিরকালীন করে রেখেছেন তার সাহিত্যে, যে পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে গ্রেটা থানবার্গের মত কিশোরী পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন চালাচ্ছে, সেই পৃথিবীতেই এমন চরম সঙ্কটের দিন আসার আগাম বার্তা বিভূতিভূষণ দিয়েছিলেন তাঁর ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে, যেখানে যুগলপ্রসাদের মত মানুষেরা আপ্রাণ চেষ্টা করে মানুষের ধ্বংসলীলা থেকে পরিবেশকে রক্ষা করতে। চেষ্টা করেন বিভূতিভূষণ, প্রতিনিয়ত, মানুষ এবং প্রকৃতিকে এক সুতোয় বাঁধতে, মানবসভ্যতার শিকড় যে প্রকৃতিতে রোপণ করা, সেই প্রকৃতিকে বাঁচাতে। বিভূতিভূষণ তাই এক ধারা, যা বাংলা সাহিত্য নয়, কিশোর মনন, চিন্তন ও সাহিত্যকে দিয়েছে এক নিজস্ব পরিচয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন