দোঁহা

বসন্ত যখন, ডেকে ডেকে যায়

 


রাজা চট্টোপাধ্যায় 

আনন্দ বসন্ত সমাগমে এই পলাশের মাসে, বহমান মাতাল হাওয়া তৃষিত হৃদয়ে এনেছে আনন্দের ঢেউ। ফাগুনের মোহনায়, প্রজাপতি মন, লাবণ্যে পূর্ণ হয়ে মন হারানোর উৎসবে চঞ্চল। পরিযায়ী পাখিরাও প্রণয়ী খুঁজে, ভালোবাসার পৃথিবী গড়ে তুলতে তৎপর। প্রেমের বার্তা নিয়ে, কিশোর কিশোরীর নয়নে লেগেছে ঝিম ধরানো নেশা। প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে, কিছুটা রঙ মাখামাখি করে, কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে নান্দনিক বসন্ত উৎসব ধ্বনি। কালের অতলে জাঁকজমক হারিয়ে গেলেও, দেশজুড়ে নিজস্ব ছন্দে আজও পালিত হয় দোল উৎসব বা হোলি। আমার বেড়ে ওঠা শহর বর্ধমানে দোল উৎসব অবশ্য একটু অন্য আঙ্গিকেই দেখেছি। দেশজুড়ে হোলি বা দোল উৎসব একই দিনে পালিত হলেও বর্ধমান রাজার প্রায় দুশো বছরের ঐতিহ্য বজায় রেখে এই শহরে আজও রঙের উৎসব "দোল" পালিত হয় পরের দিন। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, প্রায় চারশো বছরেরও আগে, রাজস্থান থেকে এক রাজপূত সিংহ পরিবার এই ঐতিহাসিক শহরে বাণিজ্য করতে এসেছিলেন। পরে এই সিংহ পরিবারকে "রায়" উপাধিতে ভূষিত করেন তৎকালীন বর্ধমান মহারাজ। শহর জুড়ে গড়ে উঠেছিল লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দির, রাধামাধব জিউ মন্দির, সোনার কালীবাড়ি, সর্ব মঙ্গলা মন্দির সহ আরও অনেক মন্দির। রাজপরিবারের সদস্যরা দোল পূর্ণিমার শুভদিনে মন্দিরের দেব দেবীদের পায়ে, অর্পণ করতেন রঙীন আবীর। যেহেতু এই বিশেষ দিনে দেবদেবীরা আবীর মাখতেন তাই তৎকালীন রাজবংশের প্রথানুযায়ী, রাজা-প্রজা সকলে মিলে, তার পরের দিনই একসাথে রঙ খেলায় মেতে উঠতে চেয়েছিলেন। এখন সেই রাজাও নেই, নেই রাজ্যপাট। তবুও বেঁচে আছে, রাজার প্রতি সেই ভালোবাসা, আবেগ। তাঁকে স্মরণ করে তাঁরই পথে চালিত হওয়ার একান্ত ইচ্ছে। 

সারা ভারতবর্ষ জুড়ে বিভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির মিশেলে হোলি এবং দোল উৎসব পালিত হয়। বাঙালি জাতি মূলত মহাপ্রভু চৈতন্য দেবের স্মরণেই দোল উৎসব পালনে ব্রতী হন। উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে আসামের বরাক উপত্যকা, ত্রিপুরায় বেশ ঘটা করে দোল উৎসব পালিত হয়। 'মণির দেশ' মণিপুরেও নবদ্বীপের অনুসরণে পালিত হয় পাঁচদিনের দোল উৎসব। কথিত আছে তৎকালীন রাজা ভাগ্যচন্দ্র বাংলার নবদ্বীপের  চৈতন্যধাম ভ্রমণে এসে মুগ্ধ হয়ে সংস্কৃতির মিলনের সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তারপর থেকেই মণিপুর রাজবাড়ী চত্বরে প্রাচীন বকুল গাছের তলায় পূর্ণিমার জোৎস্না ভরা চাঁদের আলোয় নৃত্যের আসর বসে। এই ছোট্ট রাজ্যটির নানা প্রান্ত থেকে উপজাতি সম্প্রদায়ের নারী পুরুষ একত্রিত হয়ে, পরস্পরের হাত ধরাধরি করে শুরু করেন বিশেষ নৃত্য। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে 'থোবাল চোঙবা' উৎসব। এখানে একটা মজার কাহিনী শুনেছি। আমরা যেমন একজন বিবাহিত নারী বুঝতে তাঁদের মাথায় সিঁদুর এবং গলায় মঙ্গলসূত্র দেখেছি। কিন্তু মণিপুরে মেইতেই সম্প্রদায়ের মধ্যে, বিবাহিত মহিলাদের পার্থক্য করার জন্য রয়েছে সম্পূর্ণ এক নতুন ধরণের পদ্ধতি। বেগুনি রঙের একটা স্থানীয় ফুল যদি কোনো নারী তাঁর ডান কানে গুঁজে রাখেন তাহলে বুঝতে হবে তিনি বিবাহিত। মেইতেই সম্প্রদায়ের কোনো অল্পবয়সী নারী যদি তার বাম কানে কোনো ফুল গুঁজে রাখেন তাহলে বুঝতে হবে তিনি অবিবাহিত এবং সঙ্গীর প্রতীক্ষায় রয়েছেন। 

মণিপুরে বসন্ত উৎসবে, প্রাচীন কাল থেকেই খড়ের তৈরী কুঁড়ে ঘর, স্থানীয় ভাষায় 'ইয়াওশাং' পুড়িয়ে এই উৎসবের শুভ সূচনা হয়ে থাকে। এরপর স্থানীয় ভাষায় নাকাথেঙ নামক এক ঐতিহ্যবাহী রীতির মাধ্যমে, নতুন বস্ত্র পরিধান করে ছেলে মেয়েরা স্থানীয় বাড়িগুলোয় অর্থ অনুদান সংগ্রহে বের হন এবং সেই অর্থ সংগ্রহের টাকায় তাঁরা পছন্দ মতো মিষ্টি চকলেট ইত্যাদি কিনে খান। মহারাজা নরসিংহের শাসনকালে নির্মিত রাজ্যের বৃহত্তম বৈষ্ণব মন্দির, শ্রী শ্রী গোবিন্দজী টেম্পলে দেবতার পায়ে রঙিন আবীর দিয়ে পালিত হয় দোল উৎসব। শহর জুড়ে আরও নানা মন্দিরে, রঙ ছড়িয়ে গাওয়া হয়, পাহাড়ি সুরে বিশেষ ভক্তিগীতি এবং গৌর চন্দ্রিকা। তবে প্রত্যেক বছরই মণিপুর থেকে বহু মানুষ এসে জড়ো হন, আমাদের বাংলার চৈতন্যধামে। কারণ এই নবদ্বীপের অনু মহাপ্রভু মন্দিরে আজও মণিপুরী নিয়ম মেনেই পালিত হয় দোল উৎসব। শোনা যায়, জাতিগত ঐক্যের ধারণা ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য নয়, বলা ভালো ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতবাসী লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অপমানিত হওয়ার পর থেকেই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছেন। এবং তাই নানা ভাষা, নানা মত এবং নানা পরিধানের  বৈচিত্রতার মধ্যেই এক অন্তর্নিহিত ঐক্যের সুর, সংস্কৃতির আদান প্রদান আমাদের রীতিমতো মুগ্ধ করে। আবেগ পরিপূর্ণ হয়ে বেঁচে থাকার রসদ জোগায় মননে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন