দোঁহা

শতদল মিত্রের উপন্যাস

 


 আধেকজান

(পর্ব # ১০)

  

বাবা...

এ নামের মায়া তার জীবনে ছিল? কোনোদিন? কতখানি? ভাবে উদ্দালক। সামনে চালু টিভিটা নিজের মনে সবাক এবং রঙিন চলচ্ছবি উগরে দিতে থাকে, দিতেই থাকে। সংবাদ চ্যানেল। আপাতত অধ্যাপক ও রাজনীতিক নামধারী কিছু দু-পা বিশিষ্ট জীবের যুক্তিহীন চিত্কার, একসঙ্গে-- কেউ কারোর কথা না শুনেই, অন্যকে বলতে না দিয়ে। উদ্দালকের খোলা দৃষ্টিতে তা ছায়া আঁকে না। মনে তার অন্য শব্দ-ছবির ফ্ল্যাশব্যাক।

     যেন এ বাড়ির অথিতিই— বাবা বলতে এ ছবিই ভেসে আসে উদ্দালকের মনে। শান্ত, নিস্পৃহ, উদাসীন একটা মানুষ নিজের ঘরের ঘেরাটোপে স্বেচ্ছাবন্দি সকালে বাঁধা সময়ে স্কুলে যাওয়া সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি ফিরে আসা। যেটুকু সময় বাড়িতে, দরজা বন্ধ করে বই-কাগজ পড়া, সঙ্গে মৃদু সুরে গানের ভেসে যাওয়া—রেডিওতে কিংবা সাউন্ড সিষ্টেমে রবীন্দ্রনাথ, হেমাঙ্গ, সলিল, রবিশঙ্কর, বিলায়েত, বাখ, বিঠোভেন, মোজার্ট... না, ঘরে বই ছিল না তার। যা পড়তো, তা তার স্কুলের লাইব্রেরী থেকেই আনা। বই কিনে ঘরে সংগ্রহ করতো না। অশান্তি এড়াতেই বোধহয়। ভাবে উদ্দালক।              

     উদ্দালকের ধূসর থানে যেন চেতন-অবচেতনের টানাপোড়েনে আলো-ছায়ার কাটাকুটি খেলা। অলস হাতে সে চ্যানেল পাল্টায়, কোথাও তেমন থিতু না হয়েই। সব সংবাদ চ্যানেলেই সেই একই ভাড়াটে মুখের ভিড় শুয়োরের মতো ঘোঁত-ঘোঁত করে যায়, করেই যায়। ফলে উদ্দালকের অবচেতনে চকিতে ফুটে ওঠে অবলুপ্ত প্রবাদখানি—সংসদ শুয়োরের খোঁয়াড়। এ প্রবাদ তার বাবার ছবি আঁকে আবার তার চেতনায়। মনে পড়ে যায় একদম ছোট্টবেলার ছবি। তখন তারা ভবানীপুরের বাড়িতে। ছুটির দিনে, সন্ধ্যায় স্কুল থেকে ফিরে তাকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, ছাদে পায়চারি করতে করতে বাবা নামক মানুষটি দেশ-বিদেশের রূপকথার গল্প শোনাতো তাকে। গাছ চেনাতো, পাখি, তারা... গ্রামের গল্প বলতো। বাংলা যেটুকু পড়তে লিখতে জানে উদ্দালক তা তার বাবার কাছ থেকেই শেখা। সে তো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র। এক দিনের ঘটনা মনে পড়ে উদ্দালকের। তখন সে ক্লাস থ্রী। তার বাবা সেদিন স্কুল থেকে ফিরে তার হাতে তুলে দিয়েছিল এক সেট বই—রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, নেতাজি, মার্কস, লেনিনের জীবনী। দেখেই ফেটে পড়েছিল তার মা।

     --এই সব ছাই-ভস্ম শেখানো হচ্ছে ছেলেকে! নিজের ভবিষ্যত্‍ তো জলাঞ্জলি দিয়েছই। ছেলের মাথাটা না খেলে চলছে না!

     টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল তার থেকে কেড়ে বইগুলো তার মা। ভয়ে জড়সড় হয়ে গিয়েছিল সে। তার স্কুলশিক্ষক বাবা নীরবে বইগুলো কুড়িয়ে নিয়েছিল পরম মমতায়। না, তখনও কোর্ট থেকে ফেরেনি তার ঠাকুরদা। পরের দিন মানুষটা বইগুলো নিয়ে গিয়েছিল তার স্কুলে।

     সেই থেকে তার বাবা আরও যেন গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। যদিও নিয়মিত তার পড়াশোনার খবর নিত। না, নিছক রুটিন কর্তব্য শুধু ছিল না তা, বরং তাতে ছিল মানুষটার পিতা হয়ে ওঠার গোপন ধ্যান। এখন বোঝে তা উদ্দালক। কিন্তু পরিস্থিতির নিরুপায় শিকার ছোট সে তখন ক্রমশ ঢাকা পড়েছিল মায়ের ছায়ায়। তাও যতদিন ঠাকুরদা ছিল ততদিন রাত্রের খাওয়াটা একসঙ্গেই করত তারা সকলে মিলে। ঠাকুরদার পড়ে সে পাটও মুছে দিয়ে বাবা তার খাবার নিজের ঘরেই খেত। আর সে, উদ্দালকও ক্রমশ হয়ে উঠেছিল তার মায়ের ছেলে। না, উদ্দালকের স্মৃতিতে ঠাকুরমার স্মৃতি নেই। সে যখন এক বছরের তার ঠাকুরমা তখন মারা যায়।

     তবুও বাবা—এ নামের ফল্গুমায়ার সজল স্পর্শ থেকেই যায় যখন উদ্দালক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতো, প্রতিবারই তার বাবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখতো সে। মাথায় স্নেহের পরশ জীবন্ত হয়ে উঠত যেন। মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক-জয়েন্ট— সে ভালো করায় খুব খুশি হয়েছিল তার বাবা। মাধ্যমিকের সময় তো ম্যাট্রিকে স্কুল থেকে পাওয়া নিজের মেডেলটা তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিল।

     --এর চেয়ে বেশি কিছু দেওয়ার তো আর আমার নেই।

     বাবার চোখে কি জলের আভাস রেখেছিল সেদিন সে? জানে না উদ্দালক। শুধু এই টুকুই জানে তুখোড় মেধাবী ছিল তার বাবা। যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর দাপুটে ছাত্র। সেও যখন যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পায়, তার বাবার মুখে কি মৃদু হাসি দুলে উঠতে রেখেছিল সে? যেন এমনই ভাবখানা—কী কেমন দিলাম? সে হারতেই হল তো! না, জানে না উদ্দালক আজ। এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টিভির অকারণ ভাঁড়ামি বন্ধ করে সে রিমোট টিপে ব্যালকনিতে যায় সে সিগারেট ধরায় আলগোছে ধোঁয়া ছাড়ে অথচ এই নির্বিরোধী, নিস্পৃহ, উদাসীন তার বাবার চোখে আগুনের ঝলক দেখতে পেত, যখন তার মেসোর গলায় শ্লেষ বেজে উঠত—কী কমরেড? ভালো আছো তো? কিন্তু ওই ঝলক মাত্রই পরক্ষণেই বিনা উত্তরে তার চোখ আবার ডুবে যেত হাতে ধরা বই বা কাগজের অক্ষরে প্রতিবাদও যে নীরব হয়েও কতটা চরম হতে পারে এবং তাচ্ছিল্যভরা—বাবার কাছ থেকেই শিখেছিল সে। অবশ্য তার মেসোর সে বোধ ছিল কিনা, তাও জানে না সে। সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে দেয় সে ওপর পানে। ধোঁয়ার টানে আকাশে তাকায় উদ্দালক। নাঃ, আজকেও ঘোলাটে আকাশে সেই দুটো কী তিনটে তারার আভাস। ওই দুটো কী তিনটে তারার একটা কী তার বাবা? অন্য একটা তার ঠাকুরদা? নিজের ছেলেমানুষিতে নিজের মনেই হাসে সে। যদিও এ খোঁজে একটা চাপা পড়া সত্য প্রাণ পায়

     হ্যাঁ, সমীরণ মুখোপাধ্যায়, উদ্দালকের বাবা, এক সময়ের তুখোড় ছাত্র যে, সাগ্নিক বিপ্লবীও ছিল—সত্তরের সময়ের আগুনব্রতী। এবং উদ্দালকের বিশ্বাস, অন্তত দূরত্ব সত্ত্বেও যতটুকু চিনেছিল সে তার বাবাকে, সে বিপ্লবব্রত নেহাতই সময়ের হুজুগ ছিল না তার বাবার ক্ষেত্রে। একটা প্রখর রাজনৈতিক চেতনা থেকেই যুবক সমীরণ বিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছিল মানবমুক্তির শপথে। উদ্দালকের মনে পড়ে যায় তার বাবার শেষ গোপন কথাগুলো, মৃত্যুর আগের দিন রাত্রে—আমি তো হেরে গেলাম। তোরা নতুন, যদি পারিস...। কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেছিল তার বাবা। অবাকই হয়েছিল সে, নিজের মধ্যে গুটিয়ে রাখা মানুষটার এমন কথায়। বাবা কী মৃত্যুর আভাস পেয়েছিল কোনও? তাই নিজের স্বপ্নের, জীবনের অপূর্ণতার কথা ছেলের কাছে বলে একটুখানি শেষ ছায়া পেতে চেয়েছিল? দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে মিশে যায় উদ্দালকের মনখারাপি মায়া।

     তখন সে ফাইনাল ইয়ার। কলেজ বেরোবে বলে স্নানে যাচ্ছিল সে হঠাত্‍ই একটা আর্তনাদ সচকিত করে তাকে। মালতী মাসি চিত্কারে বেজে উঠেছিল—দা-দা!

সকালে চা দিতে গেয়ে মালতী মাসি ডেকেছিল অভ্যাস মতো তার সমীরণ দাদাকে। সাড়া না পেয়ে মায়ায় আর ডাকে নি তখন। ভেবেছিল—আহা! ঘুমোচ্ছে মানুষটা। ঘুমোক একটু। সে তো সবই দেখতো, সবই বুঝতো। কিন্তু পরে চা দিতে গিয়ে আবার সাড়া না পেয়ে গায়ে হাত দিতেই পাশফেরা মানুষটা গড়িয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গেই এসেছিল। কিন্তু তার আগেই স শেষ। হার্ট অ্যাটাক। দেখতে দেখতে পনেরো বছর হয়ে গেল। ভাবে উদ্দালক। সে ভালোভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আই টি চাকরি না নিয়ে ম্যানেজমেন্ট পড়েছিল তারপর পরীক্ষা দিয়ে ব্যাঙ্কের কাজ। সরকারি কাজ, কিছুটা হলেও তো জনগণের সেবা সবাই দুয়ো দিয়েছিল তাকে। মায়ের সঙ্গে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছিল নিঃশব্দে। মায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ? বাবার প্রতি মায়া? জানে না সে।

     এটুকুই কেবল জানে উদ্দালক যে তার বাবা ছাত্রবেলায় খুবই উচ্ছল ছিল। আবৃত্তি, ডিবেট সবেতেই চৌকস। অন্তত তেমনটাই শুনেছিল সে তার ঠাকুরদার কাছে। সে তখন যাদবপুরে। আন্ত:কলেজ, আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায়-- আবৃত্তি, তাত্ক্ষনিক বক্তৃতা, ডিবেট, কুইজ-এ প্রাইজ আনছে।  যদিও তার আগে থেকেই এ সব বিষয়ে স্কুলে সে ডাকসাইটে, দক্ষ। এ সব পুরস্কার দেখে তার ঠাকুরদা প্রতিবারই পিঠ চাপড়ে বলত— বাঃ! খুব খুশি আমি। বাবাকে দেখিয়েছ তো দাদু? সঙ্গে চাপা দীর্ঘশ্বাস নিশ্চয়ই থাকত। বয়সের উচ্ছলতায় হয়তো খেয়াল করে নি সে। শুধু একবার। ঠাকুরদা সেদিন বলেছিল মুখে হাসি টেনে— হবে না! বাপ কা বেটা! একটু থেমে আবারও বলেছিল-- তা কোনো গোপন পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়ছ না তো দাদু? সেদিন যুবক সে প্রথম জেনেছিল কখনো হাসির আড়ালে অতল কান্নাও লুকিয়ে থাকে। হাইকোর্টের বাঘা অ্যাডভোকেট শ্রী সুজিত কুমার মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে এক অসহায় পিতাকে দেখতে পেয়েছিল সে। কেমন যেন মায়া হয়েছিল সেদিন উদ্দালকের। তার কয়েক মাস পরেই অশীতিপর তার ঠাকুরদাও মারা যান। সে মৃত্যুও হঠাত্‍ই ছিল। দু-দুবার বাইপাস সার্জারীর পর তৃতীয়বারের আক্রমনের ধাক্কা তাঁর হার্ট আর নিতে পারে নি। লোক ভেঙে পড়েছিল। সেদিন। কাগজে শোক সংবাদও বেরিয়েছিল। এখান সে দুঁদে লোকটার নাম শুধু নেমপ্লেট হয়ে ঝুলে থাকে তাদের এই ফ্ল্যাটের দরজায়। সেটুকু থাকাও তো থাকতে পারে নি তার বাবা। বুক ভরে শ্বাস নেয় উদ্দালক।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন