অজয়কৃষ্ণ ব্রহ্মচারী
প্রাচীন বটগাছটার তলায় শুয়ে আছে তন্ময়। চতুর্দিকে শুকনো পাতা ছড়িয়ে। কয়েকটি হনুমান ডালে ডালে। কয়েকটি আবার তন্ময়ের কাছাকাছি। নিশ্চিন্তে। হনুমানগুলোও যেন মেনে নিয়েছে মানুষটাকে। কিন্তু ও এখানে কেন! সেই কবে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছিল। তারপর থানা-পুলিশ করেও কিনারা হয়নি। নেহাৎ আজ এই বসন্তে শান্তিনিকেতন ঘুরতে আসা। সঙ্গের সাথিরা আসেনি আজ আমার সাথে। তারা সোনাঝুরির মাঠে। গতকাল হোটেলের কেয়ারটেকারের মুখে ফসিল গ্রামের কথা শুনে মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই একা একা বেরিয়ে পড়ি। গ্রামটি বেশ ভালো। ফসিল গ্রামের পৌরাণিক ঐতিহ্যও হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এইমাত্র এক আদিবাসী পরিবারের সাথে আলাপ হল। বাড়ির চারদিকে আট-দশ ফুট মাটির পাঁচিল। ভিতরে বড় বড় বারান্দা। বারান্দার উপরে টাঙানো ধামসা, মাদল, শিঙা। বাড়ির মধ্যে বড় উঠোন। ভিতরে বেশ কয়েকটি গাছ। একটি বড়গাছের নিচে বেদি করা। আমায় বসতে দিল বাড়ির কর্তা-কর্ত্রী । তারা আপ্যায়ন করে জলের বোতল দিল আর বড় মোটা স্টিলের গ্লাসে ঘোলা মতো একটা সরবত দিল। কিছুটা জল খেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম গ্লাসে কি? ওরা অতি সাধারণভাবেই বলল, হাড়িয়া আছে বাবু। আমি একটু চমকে উঠলাম। ওরা বলল, কলকাতার মত নয়। এজিনিস এখানে এলে সবাই খায়।
অনেকদিন এসব খাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু খেতে পারিনি। বাড়ির মানুষেরা আর পাড়ার মানুষেরা এসব ভালো চোখে দেখে না। আজ কেউ তো আমার সাথে-পাশে নেই। আজ খাওয়া যেতেই পারে! চিন্তা করতে করতে ওদের সাথে সাথে আমিও গ্লাসে চুমুক দিলাম। দু-তিন ঢোকে সম্পূর্ণটা খেয়ে ফেললাম। ওরা হাসল। বলল, বাবু আপনার অভ্যাস আছে বুঝি! আমি বললাম, অভ্যাস করছি গো। বেশ ভালোই তো লাগল। আরও আছে নাকি!
-কত্ত লিবে বাবু! আছে তো অনেক। বলে, বাড়ির কর্ত্রী উঠোনের পৃর্ব কোণে চলে গেল। পাতার ছাউনি দেওয়া ঘরে মাটির উনোনের পাশে জেলের মাছ রাখা বড় হাড়ি থেকে তুলতে লাগল হাড়িয়া। গ্লাস ভরে নিয়ে এল সামনে। আমিও ঢক ঢক করে সাবার করলাম। কর্ত্রী বলল, এমন করে খাসনি বাবু। আমরা আইসতে আইসতে খাই।
আমি হেসেছিলাম। তারপর উঠে চলতে লাগলাম। গেট থেকে বেরোতেই শুনতে পেলাম, ‘খিদে পেলে চলে আসিস বাবু। এই সুখা বাউরী কাউকে ফেরায় না।' হাত নাড়িয়ে বেরিয়ে যাই বাড়ির বাইরে। হাল্কা নেশা ধরেছে। তবে ফুরফুরে মেজাজ শরীরটাকে চাঙ্গা করে দিল। বাবা-মায়ের হোটেলে খাওয়া নিশ্চিন্তে বসন্তের হাওয়া লাগানো ছেলেটার মতো লাগছে। মোড়ের কাছে এসে একটু থমকে গেলাম, প্রাচীন বটগাছটার তলায় তন্ময়কে দেখে। ভাবছিলাম ঠিক দেখছি তো! আর একটু সামনে গেলাম। ছেলেটা আমাকে দেখেই বলল, আরে অজয় বল কেমন আছিস! আমি তন্ময়। চৈতালি এসেছে! না আসে ক্ষতি নেই। শালা, বছরে সামান্য কয়েকদিন বসন্তের বাতাস গায়ে লাগলে প্রেম জাগে ওদের। সাড়ে তিনহাতে অতো গর্ব অহংকার কিসের রে! সংসার শুয়োর, কুকুর, শিয়ালও করে। ও সংসারে আমার বেঁধে থাকবার কোনও ইচ্ছা নেই। এই শান্তিনিকেতনে, এই ফসিল গ্রামে ঐ বাউরীদের মনে সারাবছর বসন্ত খেলে যায়। এখানে পাতা ঝরে আবার পাতা গজায়। ফুল ফলে। ফল ফলে। চামচিকে বাদুর মানুষ খেয়েও ফোরাতে পারি না। আর বাউরীদের গাছতলায় বসে কবিতা লিখি, গান লিখি। ওরা গানের সাথে নাচে। বাজনা বাজায়। হাড়িয়া খায়। হাড়িয়া দেয়। অহমিকা’কে কর্মের দৌলতে মাতাল করে রাখে। আমি নিজেকে দেখি আর ওকে দেখি। পাড়ার সকলের কথায় আমিও তন্ময়কে খারাপই ভেবেছিলাম। কিন্তু আজ আমার দিকে তাকিয়ে দেখি অনেক যেন বুড়ো বুড়ো লাগছে নিজেকে। কিন্তু একই বয়সি তন্ময় অনেক অনেক সতেজ। তন্ময় বলল, দিন তো তার কাজ করবেই। আসবে আর যাবে। মনটাকে রাখ না তুলে এই বসন্তের মতো…