দোঁহা

পাতুরির ইতিহাস সাথে ভেটকির মেলবন্ধন

 


পিয়াংকী 

"ওরে আমার পারুল বিবি
ওরে আমার জুঁই,
হিয়ার মাঝে ধরি তোরে,
বুকের মাঝে থুই।

আম দিলাম, কলা দিলাম
দিলাম চিনি পাতা দই,
তাতেও আমার পুতিন বিবির
মন উঠলো কই?

নোনতা পানির ভেটিক, ইলিশ
মিষ্টি পানির রুই,
তাতেও দেখি খাবার সময়
বায়না ধরিস তুই।।’’

...বাংলার প্রচলিত ছড়া। ছেলেমেয়েদের বা নাতিপুতির অভিমান ভাঙাতে এই ছড়া কাটার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ছিল একসময় বাংলার ঘরে ঘরে। 
কথাতেই আছে, "মাছে ভাতে বাঙালি"। বাঙালি আর মাছ ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। সেই আদি-অন্তকাল থেকে বাংলার ঘরে ঘরে নিত্যনৈমিত্তিক মাছের আসাযাওয়া। পূজাপার্বণ হোক বা অন্নপ্রাশন উপনয়নের মতো সামাজিক অনুষ্ঠান...সর্বক্ষেত্রেই মাছের রকমারি পদ না হলে আসর জমে না বাঙালির। মীন রাশিচক্রের এ হিসেবের খসড়া নিয়ে বসলে হয়তো আর শেষ হবে না।  
একসময় বাংলার ঘরে ঘরে প্রচলিত ছিল এই ছড়া,

"লিখিব পড়িব মরিব দুখে
মৎস মারিব খাইব সুখে"

অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতার পরিচয় অপেক্ষা বেশি সমাদৃত ছিল জাল ফেলে মাছ ধরা আর দুপুর রাতের নিশ্চিন্ত আহার। সেই মৎসপ্রিয় বাঙালি ঝালে ঝোলে অম্বলে ভর্তায় কোফতায় বড়ায় অথবা পাতুরিতে যে মাছমশাইকে খেলাবে না সেটা আর বলার দরকার পড়ে না। আসলে বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান এবং বিভিন্ন জাতির আগমন ও মিশ্রণ বাংলাকে আরও বেশি করে মাছ রান্নায় পারদর্শী করে তুলেছে।
সেঁকা পোড়া সেদ্ধ ভাঁপা-মৎসরন্ধনের যে কত টেকনিক। পাতুরিও সেই সমস্তর মধ্যে একটি।
 
 
পাতুরি। ভেটকিপাতুরি। রান্না তো হবেই তার আগে চলুন ঘুরে আসি পাতুরির শিকড়ের খোঁজে কিছুটা রাস্তা। পাতুরি শব্দটির মধ্যেই পাতার সন্ধান মিলে যায় খুব স্বাভাবিকভাবেই। পাতুরি অর্থাৎ পাতায় রান্না করা কোনো খাবার। তবে পাতুরি সঠিকভাবে কোনো সময়ের উল্লেখ পাওয়া যায় না ইতিহাস ঘাঁটলে, বরং আজ যে পাতুরির এত রমরমা সেই পাতুরি কিন্তু মধ্যযুগের বাংলা রান্নার ইতিহাসেও কিছুটা অধরা ছিল বলে মনে করা হয়। 

কবি মুকুন্দ মিশ্র তাঁর "বাঁশুলিমঙ্গল" কাব্যে বর্ণনা করেছেন যে, স্বামী ধূসদত্তের জন্য তাঁর স্ত্রী রুক্মিণী যে সমস্ত পদ রান্না করেছিলেন তার মধ্যে পাতুরি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সর্ষে এবং মাছ সহযোগে পাতুড়ির উল্লেখ আছে সেখানে। বঙ্গীয় শব্দকোষ লেখক হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় কিন্তু তার গ্রন্থে পাতুড়ির উল্লেখ করেননি। এর থেকে ঠিক কি প্রমাণ হয় তা অবশ্য আমাদের জানা নেই কিন্তু একথা জোর গলায় বলা যায় পাতুরি শুধুই বাঙালির নয় হয়তো। 
এই প্রসঙ্গে আরেকটি প্রসঙ্গ স্থাপন জরুরি। 'পত্রানি মচ্ছি' নামের যে রান্নাটি কেরালা কর্ণাটক রাজ্যে বহুল পরিচিত সেটিও অনেকটাই পাতুরিরই ভাইভাই ধরণ। পার্সি কুইজিনের সুপারম্যান এই পদের সাথে বাংলার পাতুড়ি কিছুটা এক, দুরকম মাছই রান্না হয় পাতামোড়া অবস্থায়। কিন্তু মশলায় রয়েছে বিরাট ফারাক। বাংলার রান্নায় আসল উপকরণ হল সর্ষে-নারকেল বাটা কাঁচালংকা সমেত, আর সর্ষের তেল নুন হলুদ। সেখানে পার্সি রান্নার প্রধান উপকরণ হল পেঁয়াজ রসুন ধনেপাতা পুদিনাপাতা বাটা। 
বাংলার সাহিত্যের আকাশে তাকালে দেখা যায় প্রায় সব বিখ্যাত কবি-লেখকদেরই পছন্দের পদ ছিল পাতুরি। শক্তি থেকে সুনীল পাতুরিতে মজেননি এমন লেখক বাংলায় নেই। স্যার সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর 'বাঙালি মেনু' নিবন্ধে বলেছেন "মাছের সঙ্গে সর্ষে, যেন রবীন্দ্রসঙ্গীত কথার সঙ্গে সুরের মিলন"। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর প্রিয় পদ ছিল ভাত ফোটার সময় হাঁড়ির মুখে কলাপাতায় মোড়ানো চিংড়ি ভাঁপে। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আবার মায়ের হাতে রান্না করা সর্ষে কাঁচালংকা নারকেল বাটা দিয়ে ইলিশ ভাঁপা। 

"রান্ধি নিরামিষ ব্যঞ্জন হল হরষিত 
মেস্যর ব্যঞ্জন রান্ধে হয়ে সচকিত
মৎস মাংস কুটিয়া থুইল ভাগে ভাগ
রোহিত মৎস দিয়া রান্ধে কলাপাতার আগ"

বাংলা আর বাঙালির মুখরোচক আহারের সাথে সদা সর্বদা জুড়ে যায় কিছু গবেষণা। অনেক রন্ধন বিশেষজ্ঞর মতে পাতুরি সামাজিক অবস্থাকে নির্দেশ করেছে বারবার। মাছ ভাজার জন্য যে পরিমাণ তেল লাগে এবং তারপর রান্না শেষ পর্যন্ত করার জন্য যতটা তেল মশলা প্রয়োজন হয় তা খরচ করার মত আর্থিক পরিস্থিতি ছিল না। ফলত এইভাবে পাতায় মুড়ে কম তেলের সাহায্যে রান্না করায় ছিল অনেক কম খরচ। আর একটা কথা কলাপাতায় মোড়ানোর পরে ভাপে সেদ্ধ হবার সময় কলাপাতার একটা মিষ্টি গন্ধ মাছের ভেতর ঢুকে যেত, ফলে খেতেও হত দারুণ।  

তবে, পাতুরির ইতিহাস বলতে বলতে জানি না কেন বারবার বর্তমানকে টেনে আনতে ইচ্ছে করছে। আসল কথা কি, রান্না একটা শিল্পের মতো, সেখানে একের অনুকরণে আরেকের জন্ম। এই পাতুরির কথাই ধরা যাক, আজকাল অনেককেই দেখা যায় তারা কলাপাতার পরিবর্তে কুমড়োপাতা বা লাউপাতাও ব্যবহার করে একই রান্না করেন। সেক্ষেত্রে উপকার একটাই হয় কলাপাতার মতো এই পাতাগুলো ফেলে দিতে হয় না, মাছের সাথে মেখে পাতাগুলোও বেশ খেয়ে নেওয়া যায়। আরেকটা বিষয়ও দেখা যায়, মাছের বদলে পনির বা ছানা একই মশলা সহযোগে মেখে একই পদ্ধতিতে রান্না কর হয়। নিরামিষ যারা খান তাদের জন্য এ উপায় তো ভীষণই ফলপ্রসূ। 
সবশেষে বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের লেখা 'পাকপ্রণালী'র একটা অংশ রইল যেখানে তিনি কিভাবে পাতুরি রান্না হবে তার বর্ণনা করছেন এভাবে... 
"অনন্তর মাছ কলাপাতায় জড়াইবে।উন্মানে তাওয়া বা কড়া চাপাইবে। তাহার উপর পাতা-জড়ান মাছ রাখিবে। আগুনের আঁচে পাতা পুড়িয়া আসিবে। দু-পিঠ উলটাইয়া দিবে। পরে তুলিয়া লইবে এবং পাতা খুলিয়া মাছ বাহির করিবে। এখন আহার করিয়া দেখ"

যাক, অনেক কথা হল ইতিহাস নিয়ে কিন্তু এবার পেটপূজার সময় উপস্থিত তাই  রান্নায় আসা যাক

পদ- ভেটকি পাতুরি
উপকরণ- ভেটকিমাছ, সর্ষে কাঁচালংকা নারকেল বাটা, সর্ষের তেল 
পদ্ধতি- ভীষণ ভীষণ সোজা। যারা নতুন রান্না শিখছেন অথচ ইচ্ছে দারুণ কোনো অথেনটিক পদ রান্না করে প্রিয়জনকে খাওয়ানো তাদের জন্য পাতুড়ি বেস্ট অপশন।

(১)
 মাছের টুকরোগুলো ভালো করে ধুয়ে নুন হলুদ লেবুর রস আর কাঁচা সর্ষের তেল মাখিয়ে ম্যারিনেট করে রেখে দিতে হবে অন্তত কুড়ি মিনিট। 

(২)
এরপর কলাপাতা নিয়ে মাঝের মোটা শিরটা কেটে বাদ দিয়ে পাতার অংশটুকু মাঝারি পিস করে কেটে নিতে হবে, এমন মাপে কাটতে হবে যাতে একটা মাছের টুকরো ভালোভাবে এঁটে যায়। 

(৩)
এদিকে একটি বড় বাটিতে সর্ষে কাঁচালংকা নারকেল একসাথে বেটে নিয়ে তাতে নুন হলুদ পরিমাণ মতো সর্ষের তেল দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে রেখে দিতে হবে।  

(৪)
এরপর কলাপাতার টুকরোগুলো আগুনের তাপে খুব সামান্য সেঁকে নিতে হবে যাতে মাছ সমেত ভাঁজ করার সময় ফেটে না যায় পাতাগুলো।
  
(৫)
এবার আসল রান্নার পালা। একটা করে কলাপাতার টুকরো নিয়ে তাতে এক পিস মাছ বাটা মশলায় কোট করে ওতে রেখে ভালো করে চারদিক থেকে ভাঁজ করে একটা পার্সেল টাইপ তৈরি করে সুতো দিয়ে খুব ভালো করে পাক দিয়ে শেষে গিঁট দিয়ে রেখে দিতে হবে পাশে।

(৬)
এভাবে সবকটা মাছের টুকরোয় সব পকেট পার্সেল তৈরি হয়ে যাবার পর বড় একটি পাত্রে জল বসিয়ে সেই জল ফুটতে শুরু করলে তার ওপর একটি ছিদ্র থালা বসিয়ে সেই থালায় তেল মাখিয়ে নিয়ে এক একটা পার্সেল রেখে ওপর থেকে উঁচু কোনো চাপাঢাকা দিয়ে কম আঁচে ভাঁপাতে হবে অন্তত পনেরো মিনিট।  মাঝে আট দশ মিনিটের মাথায় একবার উলটে দিতে হবে পার্সেলগুলো। পনেরো মিনিট পর ঢাকা সরিয়ে থালায় নামিয়ে খুললেই তৈরি ভেটকি পাতুরি। 
 

তাহলে? চলুক উৎসব। বৈশাখ নিয়ে আসুক উপাচার নিরাময়। সমস্ত বাধা কেটে যাক, চলুক খাওয়াদাওয়া। চলুক আনন্দ। সকলকে শুভ পয়লা বৈশাখ।  অনেক শুভকামনা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন