হিয়ার মাঝে
পাঁচ বছর পরে অর্ণব ট্রেনিং সেরে দেশে ফিরে জয়েন করেছে এক স্বনামধন্য কর্পোরেট সেক্টরে। জীবনের বিভিন্ন চড়াই উৎরাই কাটিয়ে আগামী বৈশাখে দশ বছরের সম্পর্কটা এবার গাঁটছড়ায় বাঁধা পড়বে। দীর্ঘদিন পরে তিথি ও অর্ণব মুখোমুখি মিলেনিয়াম পার্কে। সময়ের আগেই পৌঁছে গেছে তিথি। পড়াশোনা শেষ করে কম্পিটিটিভ এক্সামের প্রস্তুতি নিচ্ছে। চাকরি করতেই হবে। অর্ণবের সঙ্গে দেখা করার জন্য আলাদা করে কিছু সাজগোজ করতে হবে বলে সে মনে করে না। রূপ ঈশ্বর প্রদত্ত কিন্তু মানুষ মহান হয় কর্মে। ঈশ্বর যে রূপ দিয়েছেন তার উপর যদি বাড়তি আর্টিফিশিয়াল মেকাপ চাপানো হয় তবে চেহারায় লাবণ্য হারিয়ে যায়, এটা তিথি বিশ্বাস করে। তাই কপালে ছোট্ট একটা টিপ, পরনে গোলাপি তসর শাড়ি, চুলে একটা আলগোছে খোঁপা বেঁধে নিয়েছে। মিনিট দশেক দাঁড়ানোর পর পিছন থেকে পরিচিত স্বর কাঁধে হাত রেখে বলল, "এবার বল, কোথায় যাবি?" তিথি অপলকে দেখল এতগুলো বছর ব্যবধানে অর্ণবের কোন চেঞ্জ নেই। শুধু চশমার ফ্রেমটা বদলেছে। এখনো ঠোঁটের কোণে সেই দুষ্টু মিষ্টি হাসিটা লেগে গেছে। তিথি বলল, "কোথায় আর যাব? এখানেই তো আমাদের সম্পর্কের শুরু।" তিথির কথা শেষ না হতেই অর্ণব বলল, “একদম না, পাশেই আমার অফিস, লোকে দেখলেই ট্রোল করবে, তাছাড়া এখানে বসলেই ডাস্ট এলার্জি হবে। এখন অনেক বড় অফিসার হয়ে গেছি বুঝলি! যেখানে সেখানে বসতে পারব না। আমি তাজবেঙ্গল এ সিট বুক করেছি। লাঞ্চ সেরে তোকে ড্রপ করে আবার অফিস ব্যাক করতে হবে।" কথাগুলো আকাশের দিকে তাকিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে এবার চোখ রাখলে তিথির দিকে। “বাহ্ বেশ সুন্দর শাড়ি পড়তে শিখে গেছিস! কিন্তু সেই ট্রিপিকাল স্কুল গার্ল। আমার অফিসে সুন্দরী রমণীরা পরিপাটি করে নিজেকে সাজিয়ে তোলে। আর তুই সেই একই রকম থেকে গেলি।” তিথির মনের মধ্যে তোলপাড় করছে দুই কাল। অতীতের স্মৃতিরা আনন্দের গল্প শোনাচ্ছে আর বর্তমান কী সাংঘাতিক ভয়াবহ। অর্ণবের কথায় মনে হচ্ছে মাটির শিকড় ছেড়ে আকাশে হাত বাড়াচ্ছে। ওর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ সবই চেঞ্জ হয়েছে। এই গঙ্গার পাড়ে বসে কত সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছে কলেজ জীবন থেকে। ন্যাচারাল বিউটিকে অর্ণব বরাবরই প্রায়োরিটি দিত। আসলে সময়ের সাথে সাথে সবাই পরিবর্তন হয়,অর্ণব ও ব্যতিক্রম নয়। তবে যে অর্ণবকে তিথি মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসত, সেই অর্ণবকে ফিরে পাবে কি করে? না,না অর্ণবের ভালোলাগার সঙ্গে নিজের ভালোলাগার এডজাস্টমেন্ট করতে বা কম্প্রোমাইজ করতে পারবে না। কারণ এই আ্যডজাস্টমেন্ট এর চক্করে কম্প্রোমাইজ করতে করতে একদিন ভালবাসা ফুরিয়ে যাবে শেষে থেকে যাবে শুধুই কর্তব্য। অর্ণব বলল, “কিরে চুপ করে থাকবি? কিছু বল?” তিথি বলল, “তুই একটা যন্ত্রে পরিণত হয়েছিস। আমি একটা উবের ডাকছি, বাড়ি ফিরে যাচ্ছি, তুই অফিসে চলে যা।" হঠাৎ ঘনিয়ে আসা জলীয়বাষ্প তিথির মনে হু হু করে ঢুকে পড়ল, একটু পরেই অঝোরে বৃষ্টি নামবে দুচোখে। তিথির এই রিয়াকশনটা অর্ণবের খুব চেনা। অর্ণব পকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, "আজ মনে হয়েছিল বহুদিন পরে ট্রামলাইনের উপর একসাথে হাঁটবো, খোলা আকাশের নিচে মাটির ভাঁড়ে চা খাব, গোধূলির অস্তমিত আভায় গঙ্গা পাড়ে সময় কাটাবো, গঙ্গার বুকে কাঠের পালতোলা নৌকায় ঘুরে বেড়াবো। সাথে থাকবে আমার তিথির প্রিয় ডার্ক চকলেট।" বুক পকেট থেকে চকলেট বার করে তিথির হাতে দিয়ে বলল, "হ্যাপি বার্থডে পাগলি। তুই ভাবছিস আমি ভুলে গিয়েছি? আরো একটি গিফ্ট আছে, বাড়ি ফিরে দেখতে পাবি। আজ ছুটি নিয়েছি, কারণ ইউ আর মাই ইউনিভার্স”! কেমন ঘোল খাওয়ালাম! অর্ণব হো হো করে হাসতে লাগলো। ঘন কুয়াশা সরে গিয়ে চতুর্দিক তখন আলোয় ভরে উঠেছে। তিথির মনে ঘনিয়ে আসা অভিমানী মেঘ এক নিমেষে সরে গেল। হাসতে হাসতে তিথি বললো, "তুই ও একই থেকে গেলি। সেই একই রকম বদমায়েশি বুদ্ধি, আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা, খুব মজা হয় বল?” অর্ণব বলল,
“যদি কখনো ভুল করি, বিষাদ আনি তোমার মনে,
ব্যপ্ত করো তোমার হাত, শুদ্ধ করো চেতনাকে।
যদি কখনো পরদেশী মেঘ, আঁধার ঘনায় তোমার ঘরে,
সোহাগ সুধায় ভরিয়ে তোমায়, প্রেমের ধ্বনি অহংকারে।"
অর্ণবের বুকে মাথা রেখে ফেনিলোচ্ছল যৌবনে সাতরঙা বাসন্তিকায় ভিজে মধুর আবেশে পরিপূর্ণ মুহূর্তরা।