দোঁহা

বিপর্যস্ত সময়ের প্রয়োজনে অপস্রিয়মাণ রাজনৈতিক স্থিরতা




রক্তিম ভট্টাচার্য

 একবিংশ শতকের কবিতার বাজারে ‘প্রতিবাদ’ নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রতিবাদী স্বর, প্রতিবাদী বক্তব্য, প্রতিবাদী শ্লোগান, প্রতিবাদী কবিতা এখন মানুষের কাছে সহজলভ্য। কিন্তু প্রতিবাদ-প্রকাশের যে মাধ্যমসমুদয়, তাঁর সার্বিকভাবে যে নির্দিষ্ট মাত্রা ও সীমিত ক্ষমতা রয়েছে, তাকে বিপর্যস্ত করার মধ্যে এক নতুনত্বের আভাস মেলে বই কি! কবি শুভদীপ দে-র কবিতা এই নতুনত্বের প্রতি এক নবনির্মিত ইঙ্গিত, অথবা আহ্বান বলা চলে।

শুভদীপ পেশায় মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, যার কথা তাঁর প্রতিটি কবিতার বইয়ের ব্লার্বে জ্বলজ্বল করে। রোগকে চিহ্নিত করার পর ওষুধের ব্যবহার করে তাকে নির্মূল করার বিষয়টি তাঁর অজানা নয়। কিন্তু তিনি এ-ও জানেন, রাষ্ট্রীয় রোগের কোনো প্রতিকার নেই। এই রোগ যুগে-যুগে তার লক্ষণ পরিবর্তন করেছে, কিন্তু সমাজ থেকে নির্মূল হয়ে যায়নি কখনও; অনেকটা অধুনা কোভিড-ব্যধির মতো। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শুভদীপের কবিতার এক ওষুধের মতোই অবস্থান, যাকে গলাধঃকরণ করা রাষ্ট্রের পক্ষে বিরক্তির, অসহ্যকর; কিন্তু অসম্ভব নয়। কী-কারণে অসম্ভব নয়, সে-কথা কবি নিজেই জানিয়ে রেখেছেন -

 
চেয়ার ফাঁকা থাকে না কখনো

আপনি না বসলেও

অন্য যে কেউ বসে পড়তে পারে

বা অন্য কেউ বসে আছে হয়ত!



চেয়ারের হাতলে আপনি হাত না রাখলে

অন্য যে কেউ হাত রেখে দিতেই পারে।


তবে যাই হোক–

চেয়ার ফাঁকা থাকে না কখনো”

 

(‘চেয়ার ফাঁকা থাকে না কখনো’, “ছিঁড়ে দাও কাঁটাতার” কাব্যগ্রন্থ থেকে)

 

রাষ্ট্রশক্তি কখনও নিজেকে খোয়াতে পারে না। মান্না দে-র “কফিহাউসের সেই আড্ডাটা” গানের সেই ‘একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি, শুধু সেই সেদিনের মালি নেই’ লাইনটির মতোই এখানে শুধু চরিত্র-বদল হয়, শাসনের চিত্রনাট্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। সেই চিরাচরিত ডিসটোপিয়া, কিন্তু অনুচ্চ-স্বরে শুভদীপ বুঝিয়ে দেন, কবিতার কাজ সমাজ-বদল নয়, বরং সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া তার সময়টাকে, চিহ্নিত করে দেওয়া তার বিপন্নতা। ফলত, শুভদীপ তাঁর কবিতায় সোচ্চার হতে চাননি ইচ্ছাকৃতভাবেই। বরং সভ্যতার নগ্ন চরিত্রটি প্রকাশ করেছেন তদ্রুপ নগ্নভাবে, কোথাও কোনো বাহুল্য নেই, কোথাও কোনো অতি-কথন নেই। পরিপার্শ্বের একেকটি ছবিকে তিনি লেখেন, একেকটা মুহূর্তকে অনুবাদ করেন সচেতন ভাষায় ও শব্দ-চয়নে। একটি কবিতায় তিনি বলছেন–

 “শিশুকন্যাটি কফিনবাক্স থেকে চেয়ে আছে

চোখ বাঁধা মহিলাটির দিকে।

আমার দেশ এগোচ্ছে,

উন্নয়ন সূচক এ আরও এক ধাপ”

 (‘উন্নয়নশীল দেশের কবিতা’, “ছিঁড়ে দাও কাঁটাতার” কাব্যগ্রন্থ থেকে)

 
রাজনৈতিক সচেতনতার প্রকাশ প্রকট, রাখঢাক করতে চান না কবি। তিনি বলেন, “রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে থাকলে অনুন্নয়নের কবিতা আসে পাতায়, অস্পষ্ট শব্দগুলো বাক্য হতে হতে একটা সত্তার জন্ম দেয়। আর এই সত্তাটাই হলো আমার কবিতা”(“ছিঁড়ে দাও কাঁটাতার” কাব্যগ্রন্থের ‘মুখবন্ধ’ থেকে)। তিনি বুঝতে পারেন সামাজিক অস্বাচ্ছন্দ্য, বুঝতে পারেন তাঁর সময়ের অস্থির ও হতভাগ্য মানুষের আর্তি। কিন্তু সেই আর্তনাদকে মোড়কে মুড়ে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়ে দায়সারাভাবে সমাজের কাছে সততার জয়গান গাইতে চান না। তিনি চান বিপন্নতা পর্যুদস্ত করুক আমাদের, আমরা বিপন্নতার পরিচয় প্রখর বাস্তবেই খুঁজে পাই। তিনি অনায়াসে লেখেন–

 “ডোমেরা যে কবে ধর্মঘট ডাকবে জানি না!

মর্গ থেকে লাশগুলোকে

বাণ্ডিল না করে, বা,

হিন্দু সৎকার সমিতির হাতে তুলে না দিয়ে–

আসন্ন শারদীয়ায় আলোকমালায় সজ্জিত করে–

ঝুলিয়ে দিক!

বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী এসে দেখুক –

এই মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক নয়।"

 (‘এই মৃত্যুগুলো স্বাভাবিক নয়’, “নরকের দরজায়” কাব্যগ্রন্থ থেকে)

 

শুধু লেখা নয়, শব্দ ও দীর্ঘশ্বাসের খাঁচাটিকে পাঁজরে প্রতিস্থাপিত করেন কবি নিপুণভাবে। শুধুমাত্র “ঝুলিয়ে দিক!” কথাটিকে আলাদা লাইনে লেখা এবং তার-পরে বিস্ময়সূচক যতিচিহ্নের ব্যবহার তাঁর যাবতীয় ধিক্কার, যাবতীয় প্রতিবাদকে সূচীত করে প্রবল ঘৃণায়, প্রবল বিতৃষ্ণায়।

ব্রেখটীয়ান এপিক থিয়েটারের মতো এলিয়েনেশন এফেক্টের স্পেস সৃষ্টি করেন কবি। লেখার পর সেখানে নিমজ্জিত না-হয়ে বার্ডস-আই ভিউ থেকেও যদি পর্যবেক্ষণ করা যায়, সেই অনুনাদ হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক ও বহুধা-বিস্তৃত। তিনি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করেন তার আবেগ ও বাস্তবের চেনা গলি-পথ থেকে, এক অননুধাবনীয় দূরত্ব থেকে কবি “ভাবনারা” কবিতায় লিখছেন–

 “আকাশে সূর্যাস্ত দেখা দিলে আমি ঘরে

ফিরে আসে গোধূলি গায়ে মেখে,

পুঁজিবাদী ভাবনারা টুপটুপ ঝরে পড়ে

দরমার ফাঁকটুকু দেখে।"

 (‘ভাবনারা’, “হেমন্তের আজান” কাব্যগ্রন্থ থেকে)

 

এখানে প্রথম-পুরুষের ব্যবহার থাকলেও তাকে সাধারণীকরণ যতটা না করা যায়, তার থেকে নৈর্ব্যক্তিক বিচারে আপেক্ষিকতার উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। আমাদের ভাবনার মধ্যে যে চেতনা বিদ্যমান, তার দক্ষিণ অথবা বাম কোনো পন্থাই যে সার্বিক বিচারে কার্যকর নয়, সে-কথাই আপাত-মসৃণ, অথচ গভীর ত্বরণায়িত অব্যয়ে ব্যক্ত করেন কবি।

স্তরীয় সমাজব্যবস্থার অন্তরালে যে অন্ধকার চৌখুপি বর্তমান, তার প্রকোষ্ঠ থেকে বাস্তবের আলোকে শুষে নেন শুভদীপ। নির্দ্বিধায় নিজস্ব লৌকিক অস্থিরতাকে নির্মাণ করেন আত্মজৈবনিক বৈষম্যের সমান্তরালে–“নগ্নতাকে তো আমিই তুলেছি আমার দোতলায়” (‘এই কি নগ্নতা?’, “নরকের দরজা” কাব্যগ্রন্থ থেকে), বা, “আরও দুটো বোমা দাও / বোমাতঙ্ক ছড়াই সারা জীবন জুড়ে” (‘তিনটি কবিতা’ শীর্ষক কবিতার ‘২’ নামাঙ্কিত কবিতা, “নরকের দরজায়” কাব্যগ্রন্থ থেকে)। তিনি মানতে চান না ঐশ্বরিক অনুপস্থিতি, তিনি মনে করেন, “দাবানল লাগলে ওই বনাঞ্চলও ঈশ্বর হয়ে ওঠে” (‘ঈশ্বর’, “মানচিত্র কখনও দেশ হতে পারে না” কাব্যগ্রন্থ থেকে। এক আদিম দ্বি-পার্শ্বীয়ভাবে প্রতিসম তরলে অবগাহন করেন শুভদীপ, তীব্র রাষ্ট্র-বিরোধিতায়, এবং একই-সঙ্গে, ফসলের ভবিষ্যৎ-শঙ্কা সত্ত্বেও অনিবার্য ও অক্লান্ত-ভাবে কুপিয়ে চলেন নিজের শরীর-মৃত্তিকা, ঘেঁটে ফেলেন গণতান্ত্রিক সতর্কতা।

কাঁটাতারের প্রসঙ্গ শুভদীপের কবিতার এক অঙ্গুলি-নির্দেশক। এই একটা ক্ষেত্রে তাঁর লেখার সার্বজনীনতা কোথাও গিয়ে শ্লোগানধর্মিতার কাছে আত্মসমর্পণ করে, ব্যক্তিগত শোক-সন্তাপ অথবা ব্যথাতুরতা আবেগের অসংযত প্রকাশে কিছুটা ম্লান করে দেয় অন্তর্নিহিত আবেদন। কিন্তু প্রকারান্তরে, এখানেই কবি একমাত্র তাঁর চোরা শৈথিল্যের আড়াল ভেঙে দেন, মতামত দেন পরিষ্কার, সুতীব্র স্বরে। উদ্বাস্তু-হাহাকারের বার্তাকে অবলম্বন করে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত করেন দ্রোহের সোচ্চার–

 “ছিঁড়ে দাও কাঁটাতার।

উঠে যাক সীমানা,

অভিমানী কাঁটাতারের গা বেয়ে নামুক ঘাম,

স্বপ্নের চোরাস্রোত বয়ে যাক

কাঁটাতার দিয়ে।

দাবানল নিভে যাওয়া উপত্যকায় আসুক হেমন্ত।

 ছিঁড়ে দাও,

ছিঁড়ে দাও কাঁটাতার।"

 (‘ছিঁড়ে দাও কাঁটাতার’, “ছিঁড়ে দাও কাঁটাতার” কাব্যগ্রন্থ থেকে)

 

দেশভাগের অব্যক্ত যন্ত্রণা শুভদীপের লেখায় সহজাত। অত্যন্ত প্রচলিত, বহুল-বর্ণিত ও বহুল-চর্চিত বিষয়গুলির মধ্যে লুকিয়ে থাকা অস্বস্তি, মর্মস্পর্শী উপলব্ধি তিনি লিখতে পারেন সহজ-সরল কথায়, অথচ তার মধ্যে উঁকি মারে প্রবল যন্ত্রণা, এক অব্যাখ্যেয় কারুণ্য। কী অবলীলায় ও অক্লেশে তিনি লেখেন–

 

সব ফেলে চলে রেখে যাব

সব সব



শুধু নিয়ে যাব তোমার সিঁদুর কৌটো”

 
(‘সিঁদুর কৌটো’, “মানচিত্র কখনও দেশ হতে পারে না” কাব্যগ্রন্থ থেকে)

 
অথবা, “মানচিত্র কখনও দেশ হতে পারে না” কাব্যগ্রন্থের নাম-কবিতায়,

 “দিদার হাতের নাড়ু

সেও তো একটা দেশেরই নাম”

 

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তরুণ শুভদীপের লেখায় তারুণ্যের প্রথাগত বৈপ্লবিক দ্বন্দ্বের অবস্থানটা ঠিক কোন ভিত্তিতে? এখানেই শুভদীপ নিস্তেজ-চিত্তে পাঠককে ভাবিয়ে তোলেন এক অনিশ্চিত দোটানায়, যেখানে লেখকের অবস্থান তাঁর মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের সঙ্গে কীভাবে বজায় রাখবে পাঠকের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সংঘর্ষ, অথবা নিশ্চেষ্ট থেকে প্রাকৃতিক অভিঘাতে বা অন্তর্ঘাতে এক ছিন্নমূল অববাহিকার দিকে এগিয়ে দেবে উদ্বিগ্ন জনতাকে? বস্তুত, দ্বিচারিতার অনিবার্য সুযোগটিকে এড়াতে পারেননি শুভদীপ, অবশ্যম্ভাবীভাবে তাঁর কবিতায় প্রতিবাদ স্থান পেয়েছে রাজনৈতিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে। কিন্তু সেই সুযোগকে নেহাত অপব্যবহার করেননি শুভদীপ, বরং তাকে বিলীন করে দিয়েছেন সমসাময়িক রাষ্ট্র-ক্ষমতার শক্তিশালী প্রদর্শনীকে প্রশ্ন করতে। চিরাচরিত তার্কিক শুদ্ধতাকে ব্যাহত করে, অপরিসীম দ্বন্দ্ব ও প্রতিবাদী আকাঙ্খার মিশ্র সহাবস্থান ঘটিয়ে শুভদীপ তাঁর কবিতাকে পাঠকের করায়ত্ত হতে বাধ্য করিয়েছেন–এখানেই তাঁর চারিত্রিক ও স্বভাবসিদ্ধ বৈপরীত্য মার্জনীয়।



1 মন্তব্যসমূহ

  1. শুভদীপ দে আমার শহরের(চুঁচুড়া)সাংস্কৃতিক চর্চার অন্যতম নেতৃত্বে। তার কবিতার প্রতি বরাবরই আমার আগ্ৰহ থাকে। উদীপ্ত করে ওর socio-political consciousness. রক্তিমের আলোচনা এত ভালো হয়েছে যে, শুভদীপ-কে নতুন করে আবিষ্কার করলাম।

    উত্তরমুছুন
নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন