॥ ৫ ॥
আজ উদ্দালকের ব্যাঙ্ক ধর্মঘট। তাই ব্যাঙ্কে পা মাড়াবার কোনো দায় নেই তার। কী হবে ব্যাঙ্কে গিয়ে? এ তো ধর্মঘট-ধর্মঘট খেলা। ইউনিয়নের নিজেদের দাপট দেখানোর খেলা। জনগণও জানে আর ইউনিয়নও জানে-- সরকার, বিশেষ করে হিন্দু-নয়নমনি সরকার যা ভেবেছে তা করবেই। যদি দম থাকে তো দেশজোড়া লাগাতার ধর্মঘট করুক! যেমন করছে কৃষকরা দিল্লির সীমানায়। গোটা দেশ জুড়ে আর্থিক ব্যবস্থাকে তছনছ করে দাও। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখোমুখি দাঁড়াও, বুকের পাটা থাকে তো। ভাবে সে।
আজ দেরি করে উঠেছে উদ্দালক। এখন সাড়ে এগারোটা। চা-জলখাবার খেয়ে, একেবারে স্নান সেরে নিয়েছে সে। এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত সে। কেননা জীবন, তার বিস্তারধ্যান। আম্রপালির সঙ্গে আজ দেখা করার দিন। ভোটের ডিউটি, বেড়ে চলা করোনার কারণে অনেকদিন দেখা হয় নি তার প্রেমের সঙ্গে।
নিউ আলিপুরে থাকে আম্রপালি। পেট্রোল পাম্পে অপেক্ষা করবে সে। কাছেই। তবুও এইটুকু রাস্তাই যেন অনেকখানি। বিরক্ত হয় উদ্দালক। না, প্রিয়ামিলনের উত্কণ্ঠা! মনে মনে হাসে সে। ভোটের মিছিল বেরিয়েছে। রোজই প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীর লাখ-লাখ লোকের মিটিং-মিছিল। অন্য দলেরও তাই। ভোট—ক্ষমতার লড়াই। এদিকে করোনা কী শহরে, কী গ্রামে হু-হু করে ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষ মরলে নেতাদের কিছু যায় আসে না বোধহয়। ভাবে সে।
নিউ আলিপুর পেট্রোল পাম্পে সে পৌঁছতেই আম্রপালি যেন ঝাঁপিয়ে ওঠে গাড়িতে।
--উঃ, যা রোদ! বলেই সে নারী চকাস করে চুমু খায় উদ্দালককে। একটু হকচকিয়েই যায় উদ্দালক। ভাগ্যিস এসি গাড়ি। জানলা বন্ধ। বাইরে থেকে সহসা নজর চলে না ভেতরে। সামলে নিয়ে উদ্দালক গাড়ি স্টার্ট দেয়, বলে—ঠোঁট স্যানিটাইজ করা আছে তো? চিমটি কাটে সে নারী তার পায়ে।
করোনা, তারপরে ভোটেরকাল। কোথায় আর যাবে তারা? সিধে আউট্রাম ঘাটে গাড়ি ভেড়ায় উদ্দালক। গাছের ছায়ার নিচে বাঁধানো বেদীতে বসে দু-জনে। সামনে পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা বয়ে যায় সভ্যতার পাপ বুকে নিয়ে। ধীর গতিতে। নিঃশব্দে। প্রখর গ্রীষ্ম। আর ভাঁটাও বোধহয়। তাই পাড়ে ছলাত্ছল ঢেউ নেই। গঙ্গার এই শান্ততা অ-বাক করে তোলে যেন দুটি মানুষকে। উদ্দালক সিগারেট ধারায়। ধোঁয়া ছাড়ে। আম্রপালিও দুটো টান দেয়। নদীর জলে দুপুরের যুবক সূর্যের রোদ ছলকে ওঠে। চোখ ধাঁধায়। তাকানো যায় না যেন। হঠাত্ একটা প্রাণী রোদ ছিটিয়ে ভেসে উঠে আবার ডুবে যায়। নীরবতা ভেঙে যায় এ প্রাকৃতিকতায়।
--দেখো, দেখো... শুশুক! দুজনেই সমস্বরে বলে ওঠে যেন।
বছরব্যাপী লকডাউনে গঙ্গা এখন নাকি টলটলে, আরও নিষ্পাপ। ভাবে উদ্দালক। আম্রপালিও তাই-ই ভাবে বোধহয়। সে ভাবনা পরক্ষণেই ভাসিয়ে তোলে করোনায় মৃত অগণন লাশ। উদ্দালক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, যা ছুঁয়ে যায় তার দয়িতাকে। যার অভিঘাতে অনভ্যস্ত দুজনেই নির্জন গ্রীষ্ম দুপুরের প্রচণ্ডতায় আর মুগ্ধ হতে পারে না। তারা উঠে গাড়ির নিয়ন্ত্রিত শীতাতপে অভ্যস্ত স্বাচ্ছন্দ খুজে নেয়।
উদ্দালক গাড়ি চালিয়ে পার্ক স্ট্রিটে এক নামী রেস্তঁরায় হাজির হয়। খোঁজ নিয়ে জেনেছে সে, এখানে করোনাবিধি মেনেই খাবার দেয়। ওরা প্রথমে দুটো চিলড বিয়ার নেয়। তারপর লাঞ্চ সারে চাইনিজ ডিশে।
দুটো নবীন শরীর জীবনের ধর্মে আপাতত শ্রান্তি মেখে শুয়ে থাকে পাশাপাশি শব্দহীন। সে নৈঃশব্দতাকে আরও ঘন করে তোলে যেন নির্জন ফ্ল্যাটখানির এসি-র মৃদু বিন-বিন ধ্বনি। গায়ে চাদর টেনে নিয়ে আম্রপালি পাশ ফিরে হাত রাখে উদ্দালকের উলঙ্গ বুকে।
--এভাবে আর কতদিন?
--কী কতদিন?
--তুমি কি বিয়ে করবে না? আমাকে—কথাটা ঊহ্যই রাখে আম্রপালি।
--বিয়ে তো সেক্সের জন্য। সেটা তো...।
--কিন্তু সমাজ! বাড়িতে কথা ওঠে।
নিরুত্তর থাকে উদ্দালক, সমীরণ-অপর্ণার সন্তান যে। হঠাত্ই নিরুচ্চার কান্নার শব্দ সচকিত করে তাকে। পাশ ফেরে সে। দেখে তার নারীর গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে নামে। এই প্রথম কাঁদতে দেখে সে আম্রপালিকে। ফলে সে জলধারার নিচে মাটি দেখতে পায় উদ্দালক। নারী তো মাটির মতনই—যাতে আছে বীজধ্যান, বপন আকাঙ্খা। বুকে টেনে নেয় সে পুরুষ তার নিজের নারীকে। সে আলিঙ্গনে ভরসা থাকে,-- এ বছরেই। করোনা একটু কমলেই।
ভবানীপুরের নাগরিক ফালি আকাশে তখন হয়তো বিকেলের কনে দেখা আলো!
উদ্দালকের ঘুম-ঘুম অবচেতনে তখন মঞ্জিপুরের স্বপ্নের আকাশ। তার অগণন নক্ষত্র সকল। সে নক্ষত্ররাজি মুহূর্তে যেন জমাট বাঁধে। তার বাবা সমীরণ মুখার্জীর মুখ যেন বা আলো পায় সে রাত্রিসীমায়। পরক্ষণেই যা মুছে গিয়ে ফুটে ওঠে ঠাকুরদা সুজিত কুমার মুখার্জীর আদল। উদ্দালক চিত্কার করে ওঠে—বা-বা! দা-দু! সে শব্দত্তীর্ণ কম্পাঙ্কে সব তারা মিলিয়ে গিয়ে রাত্রির নিকষ সৌন্দর্য চিরে একটা অপরূপ তারা খসে যায়। তার ঠাকুরদা-বাবা শিশু উদ্দালকের হাত ধরে উড়ে চলে সে ঝরে পড়া নাক্ষত্রিক পথে। তারা পেরিয়ে যায় ঈশ্বরপুরের ধু-ধু লাল চকচকি ডাঙা। পেরিয়ে যায় ধরমগড়ের বিল, বামনী নদী, হরি সায়র। দূরে হাতছানি দিয়ে ডাকে কুসুমডাঙা। পেছন মা যেন ডাকে তাকে ক্ষীণ রিনরিন সুরে—যাস না সোনা। ফিরে আয়। তেপান্তরের মাঠ পেরোলে ঘরের পথ হারিয়ে যায় সোনা।
ধড়মড় করে উঠে বসে উদ্দালক। ঘোরের ঝলকে সহসা বুঝতে পারে না কোথায় সে। ধীরে ধীরে নিজের ঘরখানি আদল নিলে ধাতস্থ হয় সে। জল খায়। ব্যালকনিতে গিয়ে সিগারেট ধরায়। প্রতি রাতের মতো সামনের কেবল-এর তারে নিঃসঙ্গ কাকটিকে ঘুমোতে দেখে। ওর কি কোনো সঙ্গী নেই? ভাবে উদ্দালক। কাকটা হঠাত্ই একটা ডানা আলতো ছড়িয়ে ডেকে ওঠে আলস্যে—ক্ব! ওপরের ফালি ধূসর আকাশে একটা তারা ঝক-ঝক করে একলা আলো দেয়। ভোর হবে বোধহয়।
সকালে অনেকদিন পর উদ্দালক ফোন করে তার বিজন কাকাকে, সংকোচে—তবুও। না, ও তরফে আপ্যায়নের ঘাটতি হয় না তেমন, অন্তত প্রকাশ্যে। দূরত্ব সময়েরও যেমন, দূরত্ব অর্থনৈতিকও। না, সে অযাচিতভাবে প্রথমেই জানিয়ে দেবে সে ধানের-ফসলের ভাগ নিতে আসে নি। উদ্দালক আগামী শনিবার গ্রামে যাবে ঠিক করে। শনি-রবি এমনিই ছুটি। মঙ্গলবার আম্বেদকরের জন্মদিন, বুধবার পয়লা বৈশাখ। মাঝে সোমবারটা সিএল নিলেই হবে।
খুব ভালো উপন্যাস।প্রতি পর্বের পর অপেক্ষা বেড়ে যায়।... বন্যা
উত্তরমুছুনখুব খুশি।
উত্তরমুছুন