দোঁহা

বাঁটুল দি গ্রেট

 



 

অরিজিৎ বাগচী

নির্জন দুপুর, বৃষ্টির আবহে
কাগজের নৌকা ভাসছে...

আশি বা নব্বই দশকের এটি একটি চেনা জলছবি, আমরা যারা আশি বা নব্বই দশকের শৈশব উপভোগ করেছি তারা জানেন, তখনকার শৈশবে একটা খোলামেলা বোধ ছিল একটা খোলা জানলা ছিল, যেখান থেকে প্রতিটা শিশু অমলের মতো দইওয়ালা কে ডাকতে পারত স্বাধীনভাবে, এখন সেই স্বাধীনতা কোথায়?

সেই সময়ের সাদা কালো টিভিতে যে কতটা রঙিন জাদু ছিল আজ শূন্য বা শূন্য পরবর্তী প্রথম দশকে এসে ডিজিটাল দুনিয়ায় টের পাই।

আমার বেশ মনে আছে টিভিতে সুপার ম্যানের কার্টুন দেখতে বসার আগে বাবার লুঙ্গি পিঠে ঝুলিয়ে গলায় সুতো দিয়ে বেঁধে বসতাম, সুপারম্যান উড়লে আমি খাট থেকে সোফায়, সোফা থেকে খাটে লুঙ্গি উড়িয়ে লাফ মারতাম, কিন্তু এখন সেই উন্মাদনা কোথায়? কোথায় সেই শৈশবের অলীক আলস্য? আজকাল তো কিছুই চোখে পড়ে না।

মনে হয় সমস্ত ম্যাজিসিয়ান এখন বুড়ো হয়ে গেছে, তার বদলে শৈশবের চোখে থ্রিডি চশমা হাতে আইফোন ও পির্জা বারগার...একটা এঁচড়ে পাকা সমষ্টির এক সারাংশের জেনারেশন...সেই শৈশব সেই সারল্য আর নেই যা আমরা উপভোগ করেছি, যা আশি বা নব্বই পেয়েছে। এখন সবটাই দরকচা মেরে গেছে কালের সাথে সাথে...

 


আশি বা নব্বই দশকের দাপুটে শৈশব
শূন্য দশকের শেষ দিকে লুপ্ত হতে হতে এখন প্রায় মৃতপ্রায়, এর কারণ দ্রুততা ও অগ্রগতি, যা ভালো হলেও হারিয়েছে শৈশবের পিনকোর্ড।

আবোলতাবোলের সুকুমার রায় এখন শিশুদের পাঠ্য আর নয় তাদের কাছে তা অপরিচিত, তারা সে বই কেনে না, কারণ তারা মোবাইলে রিল দেখতে দেখতে বা ইউটিউবে কার্টুন দেখতে দেখতে ডিনার সারে। ডনালডাক, মিকিমাউস, টম-অ্যান্ড জ্যারি এখন মাঝে মাঝে দেখা যায় তাও মেট্রো রেলের ইনকোডা টিভিতে, অপেক্ষারত যাত্রীদের মনোরঞ্জনের জন্য। শিশুদের জন্য সেগুলো এই জেনারেশনে আর প্রযোজ্য নয় স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।
নেই সোনার কেল্লা, নেই গুপিগাইন বাঘাবাইন, নেই ভূতের রাজার বর, নেই টেনিদা নেই কাকাবাবু নেই ঘনাদা শৈশব জুড়ে এখন শুধুই আধিপত্য নেটদুনিয়ার আনপ্লাগড কাটুর্ন, যার কোনো মূল্যবোধ নেই, যেটা আছে তা হলো বাবা মার ঘোড়দৌড়।

"দ্যাখো আমি বাড়ছি মামি" -

শৈশবের এই অ্যাডটা আজ মহামারি হয়ে দেখা দিল। এমতাবস্থায় যদি আমাকে কেউ আমার শৈশবের দশক থেকে কোনো একটি কার্টুন চরিত্র নিয়ে আমাকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপে চলে যেতে বলে তবে আমি বাঁটুল দি গ্রেট কে হাঁক দেব।


বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কমিকস শিল্পী নারায়ন দেবনাথের সৃষ্ট একটি কাল্পনিক কমিকস চরিত্র। ইংরেজি কার্টুন চরিত্র ডেসপারেট ড্যান-এর আদলে তৈরি বাঁটুলের কমিকস গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রকাশিত হয়ে আসছে শুকতারা পত্রিকায়। বাঁটুল দি গ্রেটকে একমাত্র বাঙালি সুপারহীরো বা অতিমানব বলা যেতে পারে,
বাঁটুল দি গ্রেট প্রচন্ড শক্তিশালী এক মানুষ, যা এই সময় খুব দরকার, নারায়ণ দেবনাথ হয়ত ভবিষ্যত সমাজের আঁচ পেয়েই তার এই কাল্পনিক চরিত্র বাঁটুল দি গ্রেটের জন্ম দেন। যার গায়ে গুলি লেগে গুলি ছিটকে যায়। মাথায় বিরাট হাতুড়ি মারলে তার মনে হয় মাথায় একফোঁটা শিশির পড়ল। তবে তার পোশাক আশাক মোটেও সুপারহীরোর মত নয়, ভেতো বাঙালির পেছনপাঁকা রকবাজ ছেলেদের মতোই, গোলাপী বা কমলা স্যান্ডো গেঞ্জী আর কালো হাফপ্যান্ট। বাঁটুলের নাকি জুতো পরলেই জুতো ছিঁড়ে যায় এতো বাড়ন্ত সে। তবে বাঁটুল একা নয় তার দুই স্যাঙাত ও আছে যাদের নাম বিচ্ছু ও বাচ্ছু, কখনো কখনো তাদের নাম গজা ও ভজা বলেও বর্ণিত হয়েছে সময় বিশেষে। বাঁটুলের আরেক অনুগত স্যাঙাত আছে যার নাম লম্বকর্ণ। লম্বকর্ণের শ্রবণশক্তি প্রখর, সেই হয়ত ভবিষ্যতের সময় দূত। বাঁটুলের পোষা কুকুরের নাম ভেদো আর পোষা উটপাখির নাম উটো।

মাঝে মাঝেই সমসাময়িক বাস্তব ঘটনায় বাঁটুলকে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। যেটা বর্তমান সময়ে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কিনেও পাওয়া যায় না তা হলো একের বিপদে অন্যের অবস্থান...

নারায়ণ বাবু হয়ত জানতেন ভবিষ্যতে এই রকম মানুষের উদাহরণ বিরল হবে তাই তিনি তার তৃতীয়ত চক্ষু থেকে সৃষ্টি করেছিলেন বাঁটুলের চরিত্র।

সত্যিই বর্তমান সভ্যতায় একজন বাঁটুলের খুব দরকার ছিল, যে অবলীলায় ছিঁড়ে ফেলতে পারত যে কোনো মুখোশ, যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে একাই অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা রাখবে...
যে তৈরি করতে পারত আলাদা আলাদা জবাবের আলাদা আলাদা পৃথিবী... আশ্রয় থেকে কাঠগড়ায় যে মানুষের দুঃখের পাশে দাঁড়াবে এমন এক বাঁটুলের খুব দরকার ছিল এই সময়।

যে দিন নারায়ণ দেবনাথ বাবু চলে গেলেন সেদিন খুব বিষণ্ণ মনে লিখেছিলাম-

 


 ● বাঁটুল দি গ্রেট

এখন মৌনতা ও জলছাপের সময়
কাগজের নৌকাটা ভাসতে ভাসতে গলির মুখে গিয়ে দাঁড়ালে, নোনা ধরা দেওয়ালের বাইরে বেরিয়ে আসেন ঈশ্বর।

তার পরনে ছিল লুঙ্গি ও স্যান্ডো গেঞ্জি।

পতপতিয়ে উড়তে থাকা ছেলেবেলার পতাকাগুলো আজ কেমন ম্রিয়মান, কোনো দস্যিপনা নেই সেখানে।

তাকে শেষ বিদায় জানাতে হাজির হয়েছে স্বয়ং মহাকাল ও কতগুলো কার্টুন চরিত্র।

অবক্ষয়চিহ্ন নারায়ণের জন্য নয়
অবক্ষয়চিহ্ন শৈশবের জন্য নয়।

সব হৃদয়ে থাকা বাঁটুল দি গ্রেট-
সে এই সরল সত্যটি জানে।

আশি ও নব্বই দশকের শৈশবে যারা এই কাটুর্নের ভেতর থেকে বিপ্লবের রসদ পেয়েছে, আমার মনে হয় তাদের ভেতরে আজও কোথাও অন্ধকারের ভেতর আলোর রাস্তা বেঁচে আছে, বেঁচে আছে আঙুলের ফাঁকে স্বদেশ ও মানবিকতা। নারায়ণ বাবুর স্বপ্ন কোনো একদিন সত্যি হবে হয়তো। কোনো না কোনো একদিন ফেটে পড়বে আগ্নেয়গিরি কোনো না কোনো একদিন বেড়িয়ে আসবে সত্যি সত্যি বাঁটুল দি গ্রেট, মনুষ্যত্ব উদ্ধারের জন্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন