দোঁহা

টিনটিন ও একটি প্রশ্ন

 


সব্যসাচী মজুমদার 

 (Homo sapiens) are the most common and widespread species of primate. A great ape characterized by their bipedalism and high intelligence, humans have a large brain and resulting cognitive skills that enable them to thrive in varied environments and develop complex societies and civilizations. Humans are highly social and tend to live in complex social structures composed of many cooperating and competing groups, from families and kinship networks to political states.(Groves CP (2005). Wilson DE, Reeder DM (eds.). Mammal Species of the World: A Taxonomic and Geographic Reference)

কমিকস সম্পর্কে দু'কথা লেখার প্রস্তাবনা হিসেবে এহেন বিষয়ের অবতারণা আপনাকে কিছুটা বিভ্রান্ত করতে পারে ভেবেই, কথা বলার শুরুতেই উল্লেখ করে রাখা সঙ্গত যে, এই আলোচনায় মূলতঃ এই মানব এবং মানব সংক্রান্ত কিছু চিন্তার উপস্থাপন করতে চাই নস্যাৎ হ‌ওয়ার কাঙ্ক্ষাতেই।

এই কৈফিয়তের অব্যবহিত পরেই আবার লক্ষে রাখতে চাই উদ্ধৃত অংশটি। এবং এই আলোচকের দৃষ্টিকে বারবার আচ্ছন্ন করছে ওই 'complex' শব্দটি। তবে শব্দটির তর্জমা হিসেবে কেবল 'জটিল' শব্দটিকে‌ই গ্রহণ করতে চাইছি না।বহুস্তরীক, বহুবিন্যস্ত এবং বিবিধ সম্ভাবনাময় পরিস্থিতিকেও এক্ষেত্রে প্রসঙ্গে রাখতে চাইছি। কেননা, আপনি সহজেই দেখতে পাচ্ছেন, যে, 'সমাজ' এবং 'সামাজিক বিন্যাস' শব্দ দুটিকে 'complex' চিহ্নিত করা হয়েছে। বস্তুত এ‌ও স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে একটি শব্দ কোন‌ও একটি নির্দিষ্ট অর্থ ভিত্তিক হতে পারে না। পদ হিসেবে যখন সে ব্যবহৃত হয়, প্রয়োগ অনুযায়ী বদলে যেতে থাকে তার অভিপ্রায় বোধ‌‌ও।

এবার আসব, আরেকটি প্রসঙ্গে। বরং বলা ভালো আসতে চাইছি, মানব সংক্রান্ত প্রসঙ্গে। একবার দেখে নেওয়া যাক 'humanities' বলতে ঠিক বুঝতে পারি আমরা,
humanities, those branches of knowledge that concern themselves with human beings and their culture or with analytic and critical methods of inquiry derived from an appreciation of human values and of the unique ability of the human spirit to express itself. As a group of educational disciplines, the humanities are distinguished in content and method from the physical and biological sciences and, somewhat less decisively, from the social sciences. (Encyclopedia Britannica)

হোমো পরিবারের সকলেই এই 'মানবিক' চিন্তার আওতায় যদিও আসে, কিন্তু, কেবল 'মানুষ' বলে পরিচিত প্রাণিটির সাপেক্ষে যদি এই 'মানবিক' শব্দটিকে পড়তে বসি তবে দেখতে পাচ্ছি, এ এমন এক জটিল, বহুস্তরিক, সমাজনৈতিক, সমাজ বিন্যাসের অবস্থা, যার মধ্যে প্রযুক্ত হয় মানুষের ঐতিহ্যগত, শারীরিক এবং জৈবিক অর্জনগুলি। যাকে 'গুণ' হিসেবে চিহ্নিত করলে সম্ভবতঃ আপত্তি হবে না।এখন, এই 'মানবিক গুণ' শব্দদুটিকে পাশাপাশি রাখলে আপনি যদি এমন অর্থ করে নেন যে কেবল বৃহত্তর মানুষ পরিবারের একত্রে পৃথিবীতে টিঁকে থাকার সাপেক্ষে মঙ্গলজনক স্বভাবগুলি, তবে, একদেশদর্শীতা হয়ে যেতে পারে। 'গুণ' বলতে 'বৈশিষ্ট্য' ধরে নেওয়াই অনেক নিরপেক্ষ হতে পারে বলে বলে মনে হয়। এবং আমাদের বিজ্ঞানের ইতিহাস, এই শিক্ষা দিয়েছে যে মানুষ একটি হিংস্র প্রজাতির বানর থেকে ধীরে বিবিধ শারীরিক ও জৈবিক গুণ অর্জন করতে করতে বুদ্ধি বিস্ফারের সহায়তায় সমকালীন (এই সময় সংলগ্ন বিগত একশ বছরকে এই 'সমকালীন' শব্দে বোঝাতে চাইছি) মানুষে পরিণত। এবং এটাও সত্য যে, সমকালীন মানুষ তার বিবর্তনের প্রতিটি স্তরের স্বভাবকে তার স্বভাবে ধারণ করত সামাজিক কানুনের সাপেক্ষে কিছু স্বভাবকে প্রচ্ছন্ন করেছে, সাপেক্ষ চরিতার্থক্ষম অর্জিত স্বভাবের সাহায্যে। কিন্তু তাও, সেই স্বভাব,
"গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল-"(আফ্রিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) এখনও মানুষের মধ্যে সবর্তমান, 'গুপ্ত গহ্বর'টিও।সচরারের তালিবান উত্থান কিংবা রাজনৈতিক রক্তপাতগুলি অনায়াসে সে সাক্ষ্য বহন করতে পারে। এখন, আমার বক্তব্য সংহত করার প্রয়োজনে বলা যেতে পারে, 'মানবিক গুণ' বলতে আমরা বুঝি মানুষের সমস্ত রকম বৈশিষ্ট্যকে। তার খুনে, উগ্র, ঔপনিবেশিক, স্বৈরাচারী স্বভাবের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতে হয় এই 'মানবিক' শব্দটির মাধ্যমে। এক‌ই সঙ্গে তার সামাজিক কানুনের সাপেক্ষে অমঙ্গলজনক ও অকল্যাণকর অর্জিত স্বভাবগুলির অস্তিত্বকেও না মানলেও ভ্রম হতে পারে। অর্থাৎ মানবিক মানেই যে, করণাময়ের মূর্তি ফুটবে তা নয়। বরং মিশ্র মানবিক রূপটাকেই বেশি করে তুলে ধরে। এবং আমাদের স্বীকার করে নিতে হয় যুদ্ধ থেকে ঈর্ষা সবটাই 'মানবিক'। আর এ কারণেই হয়ত দেশ প্রেম বা গোষ্ঠীপ্রেমের সংজ্ঞা প্রতিবেশ অনুযায়ী বদলে যায়।যেমন সে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত হলেও হয়ত ছিল কয়েকজন মানুষের নির্দিষ্ট কিছু চাহিদার প্রতীক। এখন, এই বিশেষ চাহিদাটির অস্তিত্বকে অস্বীকার করলে কিন্তু হবে না।

এখন এত কথা বলার কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, 'মানবিক' এই শব্দটিকে কেবলমাত্র 'কল্যাণকর' এই শব্দের মধ্যে আটকে ফেলার প্রবণতা নিয়ে কথা বললে, কিন্তু মানবতার বিণ্যাসের পুরো বিস্তারকে ধরা হয় না। হয় না বলেই আজ‌ও মানুষের মানবিকতা রক্তপাত ঘটিয়ে চলেছে তার‌ই নেপথ্যে। তাই 'কল্যাণকর' স্বভাবের দিকে যাওয়া আর 'মানবিক' হয়ে ওঠার মধ্যে অনেকটাই তফাৎ রয়েছে। এখন মানুষ এতটাই মানবিক যে, সে পৃথিবীর বিলুপ্ত প্রায় প্রাণিদের এমনভাবে সংরক্ষণ করছে যে, মানুষ ব্যাতিত তাদের আর বেঁচে থাকার কোন‌ও উপায় থাকছে না। মানে, সিংহ বা বাঘ বিলুপ্ত হবে না আর কুমীর বা সাপ‌ও। কিন্তু, সে সব গৃহপালিত সিংহ-হায়না।বনের বাঘের সংখ্যা কমলেও এরা মানুষের ইচ্ছে মতো বাড়বে। মানবিক হ‌ওয়ার আরেক নমুনা এটাও।

কৃষি সভ্যতা গড়ে তুলেছে যে মানুষ কিংবা কৃষি সভ্যতার সঙ্গে বেঁচে আছে যে মানুষ -সেও মানবিক। কিন্তু, এই অর্থেও মানবিক যে, সে পৃথিবীর জলবায়ুকে ভারসাম্যহীন করে তুলতে শুরু করেছে প্রথম এবং করেও চলেছে। প্রাণির অবস্থান দর্শীয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রক করে তোলা যেমন মানুষের একটা স্বভাব, তেমনই কৃষি সভ্যতা আসলে মানুষের ওই নিয়ন্ত্রক স্বভাবের প্রতিনিধিত্ব করেই গাছের ভারসাম্য বিগড়ে দিয়েছে। শস্য হিসেবে ব্যবহার করার জন্য একটি স্থানের গাছকে আরেক স্থানে নিয়ে গিয়ে, সেখানকার স্বাভাবিক উদ্ভিদের বিন্যাস নষ্ট করে শস্য ফলনের হাসিই তো মানুষের পরম অভিপ্রেত, তাই নয় কী! আসলে 'মানবিক' শব্দটি এতটাই বহুমুখী যে তাকে অভিপ্রেত অর্থে গ্রহণ করতে গেলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়, বিভিন্ন তর্কের অবকাশ তৈরি হয় এবং হয়েও চলেছে-কাকে, কোন প্রেক্ষিতে মানবিকতা বলে মনে করব -এমন প্রশ্ন‌ও সমানভাবে সক্রিয় থাকে।

এবার এই বিচিত্র 'মানবিকতা'র প্রেক্ষিতে দেখার চেষ্টা করব কমিকসকে। বস্তুত, পৃথিবীর অধিকাংশ ভালো কমিকস পড়া নেই। সাধারণ বাঙালির মতো ওই গাবলু, ম্যানড্রেক, অরণ্যদেব, বাহাদুর বেড়াল, হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে, টিনটিন, অ্যাসটেরিক্স (অনেক পরে),চাচা চৌধুরী আর মার্ভেলের ছোট ছোট সিরিজ। এই…

ফলতঃ 'কমিকস'কে দেখার সাধ্য আমার নেই। টিনটিনকে নির্ভর করে চেষ্টা করব এই মানবিক বিষয়টিকে অ্যার্জে কীভাবে দেখেছেন।দেখতে পাব কী আদৌ! এ সংশয় নিয়ে প্রথমে চলে যেতে চাইছি টিনটিনের প্রথম এডভেঞ্চার 'রাশিয়ায় টিনটিন'-এ। আমার ভরসা কিন্তু আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত বাংলা সংস্করণগুল।
 
 
অবশ্য এই প্রসঙ্গে ঢোকার আগে আমরা এই অংশটুকু স্মরণ করে রাখব
 "What this means in practice is shown by the discussion in Apocalittici e integrati of such things as comic strips, pop songs, and television programs, a discussion which is supplemented by two essays, published the following year, on Eugene Sue's Mysteres de 
Paris and on the James Bond novels of Ian Fleming.6 The main purpose of these essays and of the discussion of specific mass media in 
the book is to lay bare the ideological implications of different 
forms of popular entertainment, particularly, in the case of the 
comic strips and the novels, the relationship between ideology and 
narrative structures. From the analysis a distinct set of common 
themes emerges. The kind of entertainment that Eco criticizes, as 
did Vittorini, is that which is consolatory, in the sense of reaffirming the public's sense of the essential rightness and permanence of 
the world in which they live. The great fault of the mass media, for 
Eco, is to convey a standardized, oversimplified, static, and complacent vision that masks the real complexity of things and implicitly denies the possibility of change." (umbarto Eco : the open work:transleted by Anna Cancogni: introduction by David Robey: Introduction: page xvi -xvii)

তখন‌ও টিনটিন তার প্রকৃত চেহারায় বিন্যস্ত হয়নি। একটা আউট লাইন দিয়ে চেহারাটা গড়ে তোলা হয়েছে। কুট্টুসের‌ও এক‌ই দশা। ক্যাপটেন, ক্যালকুলাস বা রনসন আর জনসন কেউ নেই।কাস্তাফিওরের কণ্ঠ কানে ঢোকেনি তখনও।(প্রত্যেকটি নামকে পঠিত সঙস্করণে ব্যবহৃত উচ্চারণ অনুসারে উল্লেখ করছি) এবার বেলজিয়ান সাংবাদিক টিনটিন গিয়ে উপস্থিত সোভিয়েত দেশে। না, যা দেখান হয়েছে তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না। নিঃসন্দেহে অ্যার্জে তখন প্রথম দুনিয়ার কমিউনিজম সন্দেহপ্রবণতা ও গুজবের জায়মানতায় আক্রান্ত। যেভাবে একতরফাভাবে লালফৌজ নির্মীত রাষ্ট্রের ছবি দেখান হয়েছে, তা আজকের প্রথম বিশ্বের তরুণরাও হয়তো বিশ্বাস করেন না, তবে, একটা ছিদ্র তো নিঃসন্দেহে ধরা পড়েছিল বহুদূর থেকে। কমিকসের এই অংশটি পড়তে পড়তে অনুমিত হয়, লেখক বহুদূর থেকে, গুজবের মধ্যে বসে রাশিয়াকে দেখেছেন। ফলত অনেক বেশি করে সরলীকরণ করেছেন। এর অব্যবহিত পরেই লেখা হচ্ছে 'কঙ্গোয় টিনটিন'।
 

আনন্দ পাবলিশার্স  প্রকাশিত বাংলা সংস্করণের বাষট্টিতম পাতার ছবিটি যদি আমি বিচ্ছিন্নভাবে দেখি, বা, চোখে পড়ে যায়, দেখব কিছু কালো মানুষ একটি আরণ্যক গ্রামে বসে টিনটিন আর কুট্টুসের স্ট্যাচু বানিয়ে নতজানু গুণগান করে চলেছে। এমনকি পশুরাও কুট্টুসের ফ্যান। যদিও অধিকাংশ কালো মানুষের পরনে অনভ্যস্ত ইউরোপিয় পরিধান। আমাদের মনে হতেই পারে টিনটিন মহান পরিত্রাতা। এবং আক্ষরিক অর্থেই সেভাবেই দেখান হয়েছে টিনটিনকে। স্বাভাবিকভাবেই কিন্তু এই টিনটিন, তার আফ্রিকা ভ্রমণের সময় কী করছে-গ্রাম্য জাদুকরের ষড়যন্ত্র নষ্ট করছে, গ্রামের যুদ্ধ থামাচ্ছে, দয়া-দাক্ষিণ্য শেখাচ্ছে আর অযুত শিকার করে চলেছে। কুমির থেকে শিম্পাঞ্জি, জিরাফ থেকে হাতি। এখন এই শিকার করাটা যেমন মানবিকতা বিকাশের একটা স্তর এবং যে অভ্যাস শিশু থেকেই আমরা বয়ে চলি বলেই হাতে একটা সামান্য অস্ত্র থাকলেই চোখ গিয়ে পড়তে থাকে অপেক্ষাকৃত নিরীহ, দুর্বল প্রাণির ওপর। বড় নির্মমভাবে লিখেছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। 'একটি তুলসী গাছের কাহিনি' আপনাদের অতিপরিচিত একটি আখ্যান। আবার দেখুন শিকার করাটাও মানবিকতা। দেখুন, যখন আপনি পেটের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য শিকার করছেন। অথচ আপনার বেঁচে থাকার জন্য মারা গেল হয়ত এমন একটি প্রাণি যার কারণে মারা গেল তার সন্তান। বৃহদার্থে বা নির্দিষ্ট অভিপ্রায় অর্থে, যেভাবেই মানবিকতাকে দেখি না কেন, তার জায়মানতাকে স্বীকার করতে গেলে তার শিকারকে, সারভাইভের প্রবণতাকেও স্বীকার করতে হবে। এবং মানবিকতার ক্ষেত্রেও একটি 'ফিটেস্ট' শব্দ‌ও এসে পড়ে নাকি! ফলে আবারও প্রশ্ন এসে যায়, তাহলে কী আমাদের স্বপ্নের মানবতা আসলে সারভাইভাল ঘটিয়ে তারপর সারভাইভডদের নিয়ে ভাবে। 

ফলে, অ্যার্জে দেখাতে থাকেন নাগরিক শিকার আর আরণ্যক শিকারের অভিপ্রায় একটি জায়গায় এক হয়ে গিয়ে আগ্রাসন ঘটাচ্ছে নাগরিকতার‌ই। খেলনা ট্রেন আর গ্রামীন কামানের দু'টি ছবিকে মনে করলেই আমাদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যেতে পারে। বিষয়টি আর‌ও নির্মম হয়ে উঠেছে 'আমেরিকায় টিনটিন ' ব‌ইয়ে।

কিন্তু, আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়।আমার প্রশ্ন,আরণ্যক মানুষের কাছে, প্রকৃতি নির্ভর মানুষের কাছে নাগরিক সুবিধাগুলো পৌঁছে দেওয়ার 'মানবিক' দাবি, শেষ পর্যন্ত তাদের স্বভাব এবং জমি-জল-জঙ্গলের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার একটি প্রচ্ছন্ন তাড়না হয়ে দাঁড়ায় নাকি! আসলে তাদের তো আমরা সেই রকম সামাজিক করে তুলতে চাইছি, সে রকম সামাজিককে চাইছে আমাদের ইউটোপিয়ার অভিপ্রেত! এই 'মানবিক' শব্দের সহায়তাতেই গোটা পৃথিবীতে বর্তমানে এই ধরনের উদ্বাস্তুকরণ প্রক্রিয়া সমানভাবে সক্রিয়, ততটা ছিল দুশো বছর আগে।

একটি প্রকৃতি নির্ভর গোষ্ঠীর নিজস্ব কৌমের এবং আচরণের মধ্যে আমাদের ধরণের বা আমাদের সাপেক্ষে কল্যাণজনক গণতান্ত্রিক বিপ্লব করতে যাওয়াটাও কী এক‌ই রকম উদ্বাস্তুকরণ প্রক্রিয়া নয় কী!

'ক্যালকুলাসের কাণ্ড' বা 'চন্দ্রালোকে অভিযান'-এর মতো হার্ডকোর টপিক্যাল হিস্টোরিক্যাল ফিকশন এবং ভীষণ মেধাবী দু'টি লেখার বদলে কিন্তু এক্ষেত্রে টপিক্যাল হিস্টোরিক্যাল ফিকশন‌ই… 'বিপ্লবীদের দঙ্গলে' কে বেছে নেব।
 
 
উনিশশো পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর নাগাদ প্রকাশিত হয় ব‌ইটি। লাতিন আমেরিকার একটি দেশ, যদিও নিশ্চিতভাবে লাতিন আমেরিকার দেশ যে তা উল্লিখিত নয়। কিন্তু, ইকোয়েডর, কলম্বিয়ার, ভেনেজুয়েলার পর কাস্তাফিওরের গন্তব্য'সান থিওডোরস'। সহজেই একে লাতিন আমেরিকা প্রবণ দেশ এবং চিত্রের বর্ণনার ফলেও সেই ভাবেই দেখা যাচ্ছে।সেই দেশের দু'টি বিপ্লবী গোষ্ঠীর বিবাদ ও সেই বিবাদে সদল টিনটিনের দুঃসাহসিক ভূমিকা এই ব‌ইয়ের প্রতিপাদ্য-এ আপনারা সকলেই জানেন। এই নিয়ে বিশেষ বলার কিছু নেই। কিন্তু, দুটো ছবি এই ব‌ইটিকে ভুলতে দেয় না। প্রায় এক‌ই রকম দুটো ছবি, কেবল পরিপ্রেক্ষিত বদলে গিয়ে ভয়াবহ করে তুলেছে বক্তব্যকে।

বিয়াংকাকে গ্রেফতারের পর এবং হ্যাডক ও টাপিওকার উত্তপ্ত বাদানুবাদের পর যখন ক্যালকুলাস আর হ্যাডক টিনটিনকে ছাড়াই টাপিওকার আমন্ত্রণে সান থিওডোরসের রাজধানী টাপিওকাপোলিসে নামছেন, দেখা যাচ্ছে, একটা আস্তাকুঁড়ের পাহাড়ের সামনে টহল দিয়ে ফিরছে দুই পুলিশ। আস্তাকুঁড়ে থেকে মাথা তুলেছে দুই একটা ভাঙা বাড়ি -ঘর, দু-চারটে রোগা রোগা মানুষ। জঞ্জালের এক কোণে উঁকি মারছে একটা বোর্ড। পড়া যাচ্ছে, 'টাপিওকা/ন্দাবাদ'।হ্যাডকদের প্লেন তখন নামছে।
 
 
এবার চলে যাব মাঝখানের ঘটনা প্রবাহ অতিক্রম করে বিপ্লবের একেবারে শেষ পর্যায়ে। টিনটিনের সহায়তায় বনবাসী জেনারেল আলকাজার টাপিওকাকে হারিয়ে তখতে বসেছেন। কিন্তু ঝামেলা বেঁধেছে মানবিক টিনটিনকে নিয়ে। সে দেশের প্রচলিত প্রথা, পরাজিত অধিনায়ককে এবং তাঁর উল্লেখযোগ্য সঙ্গীদের হত্যা করা হয়। টিনটিন এই প্রাচীন প্রথা বদলে দিতে চায়। সে চায় ক্ষমা। কিন্তু তাতে জয়ি এবং পরাজিত দুই অধিনায়ক‌ই ক্ষুব্ধ। কারণ বেঁচে থাকা মানে অপমান এবং ঐতিহ্যের লাঞ্ছনা। তাও টিনটিনের জোরাজুরিতে সাব্যস্ত হল।সাব্যস্ত হল যে, আলকাজার টাপিওকাকে একটি বিমান দেবে, যাতে চেপে টাপিওকা যেখানে খুশি চলে যেতে পারে। তারপর কিছু উত্তেজনার প্রহর কাটিয়ে ফেরার পালা। টিনটিন, হ্যাডক, ক্যালকুলাসকে নিয়ে প্লেন ফিরে চলেছে। নীচে সেই জঞ্জালের স্তূপ। দু'জন পুলিশ টহল ফিরছে। ভাঙা বাড়ি, রোগা মানুষ…সব অবিকল। কেবল বোর্ডটা একটু স্পষ্ট।তাতে লেখা 'আলকাজার জিন্দাবাদ'।


আমার কেবল বাঙালি কবির একটি কবিতার কয়েকটি পঙক্তি মনে পড়ে,
"রাজা আসে যায়/রাজা বদলায়/লাল জামা গায়/নীল জামা গায়/দিন বদলায় না…"(বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)

কিন্তু, এরপরেও আমার একটি প্রশ্ন আসে। মানবিকতা কী তাহলে শ্রেণি সাপেক্ষ! কেননা, মানবিকতার সদর্থক প্রতিটি পদক্ষেপের অন্তরালে একটি করে অন্ধকার জায়মান থাকে। বিগত সহস্রাব্দের সত্তর দশকে অ্যার্জ তাঁর নায়কের প্রশ্নাতীত মানবিকতাকেও কিন্তু প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিলেন। যেটা হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই পারা যায়নি বাস্তবিক প্রয়োগ প্রসঙ্গে।

আলোচনা সংক্ষেপ করার প্রয়োজন। অভিপ্রায় ব্যক্ত অতি দ্রুত না করলে আপনার ধৈর্য চ্যূতি স্বাভাবিক। মানবিকতার অনেকগুলি স্তর ও অর্থ বিস্তারের অবকাশ আছে। মানবিকতা বিবিধ শ্রেণি সাপেক্ষে পাল্টে পাল্টে যেতে পারে। যেমন ন্যাশনাল বুর্জোয়াদের মনে হতেই পারে, তাদের পন্থা‌ই প্রকৃত সমাজ নির্মাণের দিকে নিয়ে যেতে পারে।ফ্যাসিস্টরাও ভাবতে পারে তাদের সাপেক্ষে মাবিকতার বিকাশকে। একজন শিকারী একরকম করে ভাবেন আর শিকার কী সবসময় বিপরীত মেরু থেকেই ভাবনা শুরু করে! এমন প্রশ্নের অবকাশ রেখে বলা যায়, শিকার আরেকরকম ভাবে ভাবতেই পারে। আবার শিকার-শিকারী এবং ভোক্তার ভাবনা এক‌ই সূত্রে মিলেও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে মানবিকতার চিত্র আরেক বিন্যাস নিতে পারে। মোদ্দা কথা, এই 'মানবিকতা' শব্দটি ঠিক সেই অভিপ্রায়কেই নিশ্চিত করতে পারছে না সম্ভবতঃ, যে অভিপ্রায় শ্রমজীবী শ্রেণির সাপেক্ষে সমাজ গড়ার কথা বলে।

এই প্রশ্নটাই অ্যার্জে করতে চেয়েছিলেন তাঁর এই দ্ব্যর্থক উপস্থাপনে। প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন প্রচলিত সংজ্ঞাকে। প্রশ্ন করে আর‌ও নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। যদিও নিশ্চিতভাবে কিছু হয় না।

কমিকস আর সামাজিক পরিবেশ, কিংবা কমিক্সের গুরুত্ব ইত্যাদি বহুচর্চিত বিষয়গুলোর দিকে যেতে চাইছি না। এই আলোচনা মূলতঃ একটা প্রশ্নকে তুলে ধরতে চেয়েছি। প্রশ্নটি অবশ্য‌ই প্রচলিত ধারণাকৃত গুণগুলির প্রতি নয়, প্রশ্নটি আসলে শব্দটির তাৎপর্য নিয়ে। এখন মনে হয়, এই ব্যবহারিক বহস্তরিকতার কারণেই এই শব্দটি পরস্পর বিরোধীতার সূত্রপাত করে অনেকক্ষেত্রেই। এবং করেওছে বলেই প্রায়োগিক ক্ষেত্রে মৌলবাদ শেষ পর্যন্ত মাথা চাড়া দিয়ে থাকতে পারছে এবং এক‌‌ই সঙ্গে সারভাইভ‌ও করছে।করতে করতে সে বজায় রাখছে তার ব্যাপ্তীকে। আর তারাও তাদের মতো মানবিক দৃষ্টি থেকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে আবিশ্ব। আর সেই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে‌ই আমাদের বিক্ষোভ কয়েকটা জেনোসাইড তৈরি করছে মাত্র স্রেফ কয়েককটা প্রশ্ন না করার জন্যে হয়তো…

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন